শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

রেইনট্রি হোটেল ধর্ষণ মামলা: লিখিত রায়ে নেই সেই পর্যবেক্ষণ

আপডেট : ১৮ নভেম্বর ২০২১, ০৭:৩০

রেইনট্রি হোটেল ধর্ষণ মামলার লিখিত পূর্ণাঙ্গ রায়ে নেই সেই আলোচিত পর্যবেক্ষণ। যে পর্যবেক্ষণ দেশজুড়ে জন্ম দিয়েছিলো নানা সমালোচনার। যার প্রেক্ষিতে পর্যবেক্ষণ দানকারী ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭ এর বিচারক মোসাম্মাৎ কামরুন্নাহারকে বিচারকাজ কাজ থেকে প্রত্যাহার করে নেয় সুপ্রিম কোর্ট। 

কিন্তু প্রকাশ্য আদালতে ঘোষিত রায়ের সময় দেওয়া সেই পর্যবেক্ষণ (৭২ ঘণ্টা পর ধর্ষণ মামলা না নিতে পুলিশকে সুপারিশ) পূর্ণাঙ্গ রায়ে নেই। রায় প্রকাশের পরই এ বিষয়ে জানা গেল। 

রেইনট্রি হোটেল ধর্ষণ মামলার রায়ে আপন জুয়েলার্সের কর্ণধার দিলদার আহমেদের ছেলে সাফাত আহমেদসহ পাঁচ আসামিকে বেকসুর খালাস দেয় বিচারক কামরুন্নাহার। গত ১১ নভেম্বর প্রকাশ্য আদালতে ঘোষিত ওই রায়ের তিনি ধর্ষণ মামলায় ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ভিকটিমের মেডিক্যাল পরীক্ষার উপর জোর দেন। ওই সময়ের মধ্যে মেডিক্যাল পরীক্ষা সম্পন্ন না হলে মামলা প্রমাণ দুরহ হয়ে যায়। এ কারণ ৭২ ঘণ্টার মধ্যে মেডিক্যাল পরীক্ষা করা না হলে এ ধরনের ঘটনায় মামলা না নেওয়ার বিষয়ে সুপারিশ করার কথা বলেন বিচারক। এ সময় আদালত কক্ষে রাষ্ট্র ও আসামি পক্ষের আইনজীবী, বিভিন্ন গণমাধ্যম প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। রায় ঘোষণা শেষে ৭২ ঘণ্টা পর মামলা না নেওয়ার বিষয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন উভয় পক্ষের আইনজীবীরা। 

পরে এ নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে গুরুত্বসহকারে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তখন থেকেই সমালোচনায় সরব হন বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন। পৃথক পৃথক বিবৃতি দেন তারা। এমন অবস্থায় শনিবার ওই বিচারকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রধান বিচারপতি বরাবর চিঠি লেখার কথা জানান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। এরপরই রবিবার প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বিচারক কামরুন্নাহরকে বিচারকাজ থেকে প্রত্যাহারের নির্দেশ দেন। 

ওই নির্দেশে বলা হয়, সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ বিচারপতিদের সঙ্গে আলোচনাক্রমে বিচারক কামরুন্নাহারকে রবিবার (১৪ নভেম্বর) সকাল সাড়ে ৯টা হতে আদালতে না বসার নির্দেশ প্রদান করেছেন। তার বিচারিক ক্ষমতা সাময়িকভাবে প্রত্যাহার করে তাকে বর্তমান কর্মস্থল হতে সরিয়ে নিয়ে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগে সংযুক্ত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হলো। সুপ্রিম কোর্টের এই চিঠি পাওয়ার পরই আইন ও বিচার বিভাগ সংশ্লিষ্ট বিচারককে ট্রাইব্যুনাল থেকে সরিয়ে নিয়ে আইন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করে। 

এমন অবস্থায় রেইনট্রি হোটেল মামলায় পূর্ণাঙ্গ রায়ের অনুলিপি প্রকাশ পায়। সেখানে বিচারক লিখেছেন, এই ট্রাইব্যুনাল বহু ধর্ষণ মামলা দেখেছেন। প্রাপ্তবয়স্ক ও যৌনজীবনে অভ্যস্ত নারী বিচারের জন্য আসেন, যেখানে কথিত অপরাধ সংঘটিত হওয়ার অনেক দিন পর তাদের (ভিকটিম) মেডিকেল পরীক্ষা হয়েছে। অনেক দিন পর মামলা হলে যৌন সহিংসতার প্রমাণ পাওয়া যায় না। মামলা করার সময় যদি বিষয়টি দেখা হয়, ৭২ ঘণ্টার মধ্যে যদি মেডিক্যাল পরীক্ষা করা হয় (যেমনটি বহু মামলায় চিকিৎসকেরা মতামত দিয়েছেন) এবং ফরেনসিক পরীক্ষায় (ডিএনএ) যদি প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে ধর্ষণ মামলায় তা গুরুত্বপূর্ণ নথি বলে গণ্য হয়। তখন ধর্ষণ মামলার অভিযুক্ত ব্যক্তির বিচার নিশ্চিত করা যায়। ন্যায়বিচার সর্বোত্তমভাবে করা সম্ভব হয়।

 

রায়ে বিচারক বলেছেন, প্রাপ্তবয়স্কদের (ভিকটিম) যদি ঘটনার পরপর বা দ্রুততম সময়ের মধ্যে ডাক্তারি পরীক্ষা হতো, তাহলে ধর্ষণের আলামত বাদিদের পক্ষে যেত। এমনকি তারা যদি পরদিন অথবা ঘটনার পরপর মামলা করতেন, তাহলে পুলিশ যৌন সহিংসতার কারণে আঘাতের চিহ্ন তাদের মুখে, গালে বা শরীরের অন্য কোথাও পেত। রেইনট্রি মামলাটি সম্পর্কে রায়ে বলা হয়েছে, দীর্ঘ ৩৮ দিন পর মামলা করা ও পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে ধর্ষণ ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। 

প্রসঙ্গত রবিবার সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, রায় দিলেই যে কোন বিচারকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তা নয়। তারা মেরিটের উপরে, আইনের উপরে, রায় দেয়ার ব্যাপারে সম্পূর্ণ স্বাধীন। কিন্তু এখানে যে ঘটনাটা ঘটেছে সেটা হচ্ছে একজন বিচারক তিনি প্রকাশ্য আদালতে রায় দেয়ার সময় তার পর্যবেক্ষণে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে বলেছেন, ৭২ ঘণ্টা পর কেউ যদি কোন ধর্ষণ মামলা করতে আসে, তাহলে সেই মামলাটা গ্রহণ না করতে। এটাই হচ্ছে আপত্তির জায়গা। তিনি বলেন, সরকার বা নির্বাহী বিভাগ যদি বিচারকের পর্যবেক্ষণের বিষয়ে তাদের বক্তব্য পরিষ্কার না করতো, বিচার বিভাগ যদি পদক্ষেপ না নিতো, তাহলে ভুল বার্তা হয়তো যেত কিন্তু এই পদক্ষেপ নেওয়ার পর আমার মনে হয় না ভুল বার্তা যাওয়ার কোন সম্ভাবনা আছে।

 

 

 

 

 

 

 

ইত্তেফাক/এমএএম