মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ১৬ বৈশাখ ১৪৩২
The Daily Ittefaq

সাক্ষাৎকারে মিথিলা

‘শুধু দেশে নয়, শিশুদের জন্য আমি বিশ্বব্যাপী কাজ করে যাবো’

আপডেট : ২৭ নভেম্বর ২০২১, ১৭:৩৯

রাফিয়াত রশিদ মিথিলা একাধারে শিল্পী, সুরকার, অভিনেত্রী এবং মডেল। তবে শো-বিজের বাইরে তার রয়েছে আলাদা এক কাজের জগৎ। পেশাদার উন্নয়নকর্মী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করা এই তারকা ভালোলাগার জায়গা থেকেই কাজ করেন শিশুদের নিয়ে। বর্তমানে কর্মরত আছেন ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনালের আর্লি চাইল্ডহুড ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের প্রধান হিসেবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের পর তিনি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্লি চাইল্ডহুড ডেভেলপমেন্ট নিয়ে পড়াশোনা করেন, সর্বোচ্চ সিজিপিএ পেয়ে অর্জন করেন গোল্ড মেডেল। বর্তমানে জেনেভা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছেন। ২০ নভেম্বর বিশ্ব শিশু দিবসকে সামনে রেখে নিজের ভাবনার কথা জানিয়েছেন এই তারকা। ইত্তেফাক অনলাইনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে শিশুদের বিকাশের নানা প্রসঙ্গ।

ইত্তেফাক: আপনি একজন শিল্পী, সে পরিচয়েই আপনি সকলের কাছে সমাদৃত। এর বাইরে এসে শিশুদের নিয়ে কাজ করার কথা ভেবেছেন কখন থেকে?

মিথিলা: অনেকে মনে করেন আমি চাকরির খাতিরেই শিশুদের নিয়ে কাজ করছি।  বিষয়টি এমন নয়। আমি যেহেতু অভিনয় করি, তাই এই চাকরিটা হয়তো না করলে হতো। আসলে শিশুদের জন্য কাজ করার শুরুটা ভালোবাসার জায়গা থেকেই। আমার মা একজন শিক্ষক, ছোটবেলা থেকে তাঁকে দেখেছি শিশুদের সংস্পর্শে থাকতে। নিজের প্রিয় অনেক শিক্ষককে দেখেই আমার মনে ইচ্ছা জাগত আমি বড় হয়ে ছোটদের পড়াবো।  একসময় স্কুলে পড়িয়েছি। ব্র্যাকে যোগদানের পর ২০১১ সালে যখন আফ্রিকার কয়েকটি দেশে যাই, তখন সেখানকার শিশুদের বিভিন্ন সমস্যা চোখে পড়ে। সেসময়টায় মনে হলো, শিশুদেরকে বুঝতে হলে তাদের ব্যাপারে আরও ভালো করে পড়াশোনা করতে হবে। ব্র্যাকের এডুকেশন প্রোগ্রামের প্রোগ্রাম ম্যানেজার হিসেবে চাকরিটা আমি উপভোগ করছিলাম, কখনো একে গৎবাঁধা চাকরি মনে হয়নি। এরমধ্যেই ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্লি চাইল্ডহুডের উপর মাস্টার্স শুরু করি। শিশুদের আচরণ, তাদের মনোভাব, মেধার উন্নয়ন, এমনকি জেনেটিকসহ মজার অনেক বিষয় জানতে পেরেছি। এই পড়াশোনাটা কেবল সার্টিফিকেটের জন্য করিনি, ভালোলাগার জায়গা থেকেই ধারণ করে নিয়েছি। এভাবে একসময় আমার কাজের বিষয়ই হয়ে ওঠে শিশুরা। এক পর্যায়ে ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনালের আর্লি চাইল্ডহুড ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের দায়িত্ব পাই।

ইত্তেফাক: দেশের বাইরে কাজ করতে গিয়ে শিশুদের কোন সমস্যাগুলো চোখে পড়েছে, যেটি বাংলাদেশে নেই? 

মিথিলা: ব্র্যাক যেসব দেশে কাজ করে সেসব দেশ উন্নত নয়, অর্থনীতির দিক দিয়ে তারা খুব পিছিয়ে। সে তুলনায় বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থা অনেক ভালো। উগান্ডা, তানজিনিয়া, লাইবেরিয়া, সুদান, এসব দেশে গিয়েছি। এ দেশগুলোতে এখনো ডায়রিয়ায় শিশুরা মারা যাচ্ছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোতে শিশুদের মৌলিক অধিকার, শিক্ষা, খাদ্য, স্বাস্থ্য, বাসস্থান সবগুলোই প্রয়োজনের তুলনায় একেবারে অপ্রতুল অবস্থায় আছে।

ইত্তেফাক: শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের পাশাপাশি শিশুদের বিকাশে সুস্থ বিনোদন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কোনো জনগোষ্ঠীর শিশুরা এর থেকে বঞ্চিত থাকে, তাহলে তা তাদের ভবিষ্যতের উপর কেমন প্রভাব ফেলে? 

মিথিলা: আজ যারা শিশু আগামী দিনে তারাই দেশের কর্ণধার হয়ে উঠবে। ফলে শিশুদের জন্য পুষ্টিকর খাবার কিংবা নির্দিষ্ট বয়স থেকে পড়াশোনার ব্যবস্থা করা যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি হল বিনোদন। ২ থেকে ৫ বছর বয়সে শিশুদের মেধার বিকাশ ঘটে, এই সময়টায় বিনোদনের যথাযথ ব্যবস্থা না থাকলে তাদের সঠিক বিকাশ বাঁধাগ্রস্থ হয়। তাই ভবিষ্যতের জন্য সুনাগরিক হিসেবে শিশুদের গড়ে তুলতে হলে সবগুলো বিষয়ের পরিমিত উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে।

বিশ্ব শিশু দিবস উপলক্ষে ইত্তেফাকের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে রাফিয়াত রশিদ মিথিলা
 
ইত্তেফাক: আপনি শিশুদের নিয়ে একটি বই লিখেছেন। এটি শিশুদের জন্য উপযোগী। প্রশ্ন হল, কেন উপযোগী? 

মিথিলা: আমি ছোটবেলায় অনেক বই পড়াতাম, এখনো পড়ি। যখন আর্লি চাইল্ডহুড ডেভেলপমেন্ট নিয়ে কাজ করতে শুরু করেছি তখন আমি দেখলাম প্রত্যেকটা শিশুর বয়সভিত্তিক বই প্রয়োজন। বই লেখার ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলোতে শিশুদের বয়স, বইয়ের বিষয়বস্তু, প্রচ্ছদ, এমনকি ফন্টও অনেক গবেষণা করে নির্বাচন করা হয়। আমাদের দেশে সে তুলনায় শিশুদের উপযোগী বই কম। এক গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুদের জন্য ভ্রমণ সংক্রান্ত বইয়ের সংখ্যাও খুব কম। আমার মেয়ের বয়স যখন ৩ বছর ছিল, ওই বয়সেই তাকে নিয়ে অনেক জায়গায় ঘুরেছি। সেসব অভিজ্ঞতা যদি গল্পে তুলে আনা যায়, তাহলে হয়তো অন্যরাও মজা পাবে, এমনটা ভেবেই 'আইরা আর মায়ের অভিযান' সিরিজ শুরু করেছি। এর প্রথম বই 'তানজানিয়া দ্বীপে'। এটি ২০২১ এর বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে, যেটি ৮ বছরের কম বয়সই শিশুদের জন্য। আরও একটি বই আসবে খুব শিগগিরই।   

ইত্তেফাক: শিশুদের মাঝে সচেতনতা ও দেশপ্রেম জাগ্রত করতে আলাদা চলচ্চিত্র কতটা গুরুত্বপূর্ণ?

মিথিলা: আমাদের দেশে শিশুদের বিনোদনের পরিসর একেবারে কমে আসছে। শিশুদের বিনোদন কিন্তু নিছক বিনোদন নয়, এটি শিশুদের বেড়ে ওঠার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শিশুদের জন্য সিনেমা হওয়া খুবই জরুরি। আমি দেখলাম, সম্প্রতি অনেকে  শিশুদের সিনেমা নির্মাণের জন্য সরকারি অনুদান পেয়েছে। এটা শুনে আমি খুবই খুশি হয়েছি। সরকারের এই বিষয়টির প্রতি আরও বেশি নজর দেওয়া উচিৎ।

 
ইত্তেফাক: ধর্ষণের মত ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। শিশুরাও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। 'সাহসিকা' ফিচার ফিল্মটি  সমাজের জন্য অনেক বড় একটি মেসেজ ছিল, আমাদের প্রেক্ষাপটে সাহসিকাদের বাঁধা আসলে কোথায়?

মিথিলা: সাহসিকা বলে তাদেরকে বোঝানো হয়েছে যারা ভিক্টিম, কিন্তু প্রতিবাদী। আমাদের দেশে শিশু ধর্ষণ, শিশু নির্যাতন খুবই বেশি। সেই জায়গাতে শিশুদের মতামতকে প্রধান্য দেয়া দূরে থাক, তাদের কথা শোনাই হয়না। সে যখন নির্যাতনের শিকার হয় তখন বুঝতেই পারেনা কাকে তা খুলে বলবে। কিশোরী বা তরুণীদের ক্ষেত্রেও কিন্তু ভিক্টিম ব্লেমিংয়ের ভয় থাকে। অনেকক্ষেত্রেই দেখা যায় সমাজ পোশাকের দোষ দিচ্ছে, ভিক্টিমের ভুল বের করছে। ভিক্টিমদের প্রতিবাদের ভাষা নেই, শিশুদের তো একেবারেই নেই। 

ইত্তেফাক: এবারের বিশ্ব শিশু দিবস উপলক্ষে একজন শিশু অধিকারকর্মী কিংবা উন্নয়নকর্মী হিসেবে কী বলবেন? 

মিথিলা:  আমরা বাবা-মায়েরা যখন সন্তান ধারণ করবো পৃথিবীতে আনবো, তখন সেই সন্তান যেন নিরাপদে বেড়ে ওঠে, ভালো পরিবেশ পায়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিনোদন, বই পড়া, পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন সহশিক্ষামূলক কার্যক্রমে উৎসাহ দিয়ে তাকে মানবিক মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা—এ সকল বিষয় নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব। কিন্তু অনেকক্ষেত্রেই সচেতনতার অভাবে বাবা-মায়েরা কিছু ভুল করেন। ভালোবাসার দাবি থেকেই কেউ কেউ প্রয়োজনের বেশি অধিকার ফলান। অনেকেই ভাবেন, অ্যাকাডেমিক পড়ার বাইরে অন্য কিছু দরকার নেই। আসলে এই বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা করতে হবে। গর্ভাবস্থা থেকে শুরু করে পরবর্তীতে শিশুর সঠিক বিকাশের জন্য অনেকগুলো বিষয়ের উপর নজর দিতে হবে। আমাদের সমাজের জন্য এটি এখনো বড় চ্যালেঞ্জ। আগামীতেও যারা সন্তানের বাবা-মা হবেন তাদেরকে এই বিষয়গুলো ভাবতে হবে। শিশুরা বড়দের চেয়ে বেশি আবেগপ্রবণ হয়, নরম অনুভূতির হয়,  তাই তার মতামতকে প্রাধান্য দিতে হবে। এর বাইরে বলব, আমরা যেসব দেশে কাজ করি সেসব দেশের সরকারের সাথে সমন্বয় করে কাজ করে যাচ্ছি যেন শিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়। শিশুদের সঠিক বিকাশের জন্য আমি কেবল আমার দেশেই নয়, বিশ্বব্যাপী কাজ করে যাব।

ইত্তেফাক/এসটিএম