শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

রাস্তার পাশের খোলা খাবার কেন খাবেন না

আপডেট : ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৭:২১

দিনে দিনে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে সড়ক-ফুটপাতে বেড়েছে খাবারের দোকান। এসব দোকানের খাবারকে সাধারণত স্ট্রিট ফুড বলা হয়। এসব খাবার একদিকে সহজলভ্য, অন্যদিকে সস্তা হওয়ায় ব্যাপক জনপ্রিয় হচ্ছে দিন-দিন। কিন্তু সাম্প্রতিক এক গবেষণার পর জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেশিরভাগ স্ট্রিট ফুডেই বাহারি জীবাণু রয়েছে। রকমভেদে এসব খাবারে এসব খাবারের ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ ভয়ঙ্কর জীবণু রয়েছে।

জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে খাদ্যদ্রব্যে রাসায়নিক দূষণ ও জীবাণু সংক্রমণ বিষয়ে এক সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকার প্রায় ৯০ শতাংশ রাস্তার খাবারেই ই-কোলাই, সালমোনেলা ও ইস্ট মোল্ডের মতো মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর জীবাণু পাওয়া গেছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ৬০ কোটি মানুষ দূষিত খাবার খেয়ে অসুস্থ হয় এবং প্রায় সাড়ে ৪ লাখ মানুষ মারা যায়। এছাড়া, ৫ বছরের চেয়ে কম বয়সী শিশুদের ৪৩ শতাংশই অনিরাপদ খাবারজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়, যার মধ্যে প্রতিবছর মারা যায় ১ লাখ ২৫ হাজার শিশু।

স্ট্রিট ফুডের দোকানগুলো সাধারণত খোলা আকাশের নিচে  রয়েছে। এসব খাবার পোকামাকড়, মাছি দ্বারা দূষিত হয়। সাধারণত সস্তা, তৈলাক্ত ও ঝাল হওয়ার কারণে রাস্তার খাবারের বেশ কদর রয়েছে। এ জাতীয় খাবার খেলে মানুষ যেসব রোগে আক্রান্ত হতে পারে, তার মধ্যে রয়েছে ডায়রিয়া, আমাশয়, টাইফয়েড, হেপাটাইটিসসহ বিভিন্ন সংক্রামক রোগ, আলসার, হৃদরোগ ইত্যাদি।

রাজধানী ঢাকাসহ বড় বড় শহরের ফুটপাত, পার্ক, রেল-বাস স্টেশন ও জনাকীর্ণ এলাকায় খোলা আকাশের নিচে প্রচুর খাবারের দোকান দেখতে পাওয়া যায়। ফুটপাতে বিভিন্ন ধরনের লোভনীয় খাবার পথচারীদের আকৃষ্ট করে। গরমের সময় বেশি দেখা যায়, বিভিন্ন ধরনের সরবত বিক্রি করতে। পথচারী ও শিশুরা ক্ষুধা-তৃষ্ণা নিবারণের জন্য  কখনো কখনো কম দামে রাস্তার পাশ থেকে খাবার কিনে খায়।  শিশু থেকে বৃদ্ধ; সব শ্রেণির মানুষের পছন্দ হলেও এসব খাবার স্বাস্থ্যের জন্য নানা ঝুঁকি তৈরি করে। এর মধ্যে রয়েছে ফ্রাইড চিকেন, ফ্রেন্স ফ্রাইড, নুডুলস, বার্গার, সিঙ্গাড়া, সমুচা, ফ্রাইড রাইসের মতো বিলাসবহুল খাবারও এসব দোকানে পাওয়া যায়। কিন্তু কোথায়, কিভাবে তৈরি হয় এসব খাবার, তার খোঁজ সাধারণত কেউ রাখে না।  

রাস্তার পাশে ডিম ভাত ও ডিম খিচুড়ি রিকশা ও ভ্যান চালকসহ নিম্নআয়ের মানুষের নিত্যদিনের পছন্দের খাবার। রাস্তার পাশে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি করা হচ্ছে এসব খাবার। কোনো সতর্কতামূলক ব্যবস্থা বা ভোক্তাদের স্বাস্থ্যের বিষয় উপেক্ষিত থেকে যায়।

স্ট্রিড ফুড প্রসঙ্গে দোকানিরা বলেন, ‘রাস্তার খাবারে টুকটাক ধুলাবালি থাকতে পারে। এরপরও আমরা যতটা সম্ভব, পরিচ্ছন্ন রেখে পরিবেশনের চেষ্টা করি। ফিল্টার পানি দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি।’

স্ট্রিট ফুড কেন খাচ্ছেন, জানতে চাইলে পথচারী বিপ্লব মল্লিক বলেন, ‘সহজেই রাস্তার পাশে খাবার পাওয়া যায়। অনেকটা কম মূল্যেও পাওয়া যায়। এছাড়া চলাচলের সময় ব্যস্ততার মধ্যে হাতের কাছে এসব খাবার মেলে। খেতেও সুস্বাদু।  তাই খাই।’

সম্প্রতি জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সম্মেলন কক্ষে খাদ্য নিরাপত্তা সমীক্ষার দ্বিতীয় পর্যায়ের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শহরের ৯০ শতাংশ ফুচকা ও ঝালমুড়িতে রয়েছে টাইফয়েডের জীবাণু। ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ ভেলপুরি, ফুচকা ও ঝালমুড়িতে কলেরার জীবাণু ই কোলাইয়ের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এর মধ্যে পাঁচটি ভেলপুরি ও তিনটি ঝালমুড়ির নমুনায় টাইফয়েডের জীবাণু সালমোলিনা পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে খাবারের মান পরীক্ষায় দেশের একমাত্র রেফারেন্স প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরি। এছাড়া ৩০টি ফুচকার নমুনায় জীবাণু আছে, ১২টি ভেলপুরির নমুনায় ৭৫ শতাংশ, ঝালমুড়ির ১৩টি ও চারটি আচারের নমুনায় স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি মাত্রায় ইস্ট পাওয়া গেছে, যা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। 

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা শহরের ৪৬টি থানায় অবস্থিত স্কুলের সামনে থেকে ৪৬টি ঝালমুড়ি, ৩০টি ফুচকা, ১৬টি ভেলপুরি ও ৪২টি আচারের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। সংগৃহীত নমুনার মাইক্রো বায়োলজিক্যাল পরীক্ষার জন্য ইস্ট ও মোল্ড, কলিফর্ম, সালমোনিলা, ই-কোলাইয়ের উপস্থিতি পরীক্ষা করা হয়। এতে ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ ভেলপুরি, ফুচকা ও ঝালমুড়িতে ই-কোলাইয়ের উপস্থিতি পাওয়া যায়।

গবেষণা প্রতিবেদনে বিএআরসির খাদ্য ও পুষ্টি বিভাগের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘ঢাকায় ১৪০ রকমের পথের খাবার পাওয়া যায়। যা শহরের ৭০ শতাংশ মানুষ খেয়ে থাকে। এ সব খাবারে প্রাণীর মলের ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেছে। মূলত পানি থেকেই এ ব্যাকটেরিয়া খাবারে ঢোকে। আর খাবার থেকে ঢোকে মানুষের পেটে। এসব খাবার তৈরি হওয়া থেকে শুরু করে খাওয়ার আগ পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়াটাই অস্বাস্থ্যকর। এসব খাবার খাওয়ার ফলে ভয়াবহ স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিতে পারে।’

মনিরুল ইসলাম আরও বলেন, ‘বেঁচে থাকার জন্য নিরাপদ খাদ্য অত্যন্ত জরুরি। খাদ্য ও স্বাস্থ্য একটি আরেকটির পরিপূরক। টেকসই জীবন ও সুস্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাবারের বিকল্প নেই। অনিরাপদ খাদ্য স্বাস্থ্য ঝুঁকির অন্যতম কারণ। অনেক জটিল ও দূরারোগ্য ব্যাধির জন্য দায়ী অনিরাপদ খাবার।’

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন ও পরিপাকতন্ত্র বিশেষেজ্ঞ সাবেক অধ্যাপক ডা বশির আহমেদ বলেন, ‘বাইরের এসব খাবার বর্জন করতে হবে। বিপরীতে নিজেকে সুস্থ রাখতে শাকসবজি-ফলমূল, আঁশযুক্ত খাবার শরীরের ওজন, হৃদরোগ, রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও কোলেস্টরেল নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিরাট ভূমিকা রাখে। তাই শিশুকাল থেকেই ছেলে-মেয়েদের শাকসবজি ও ফলমূল খাওয়ানোর অভ্যাস করতে হবে।’ 

ইত্তেফাক/এনই