শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

বিজয়ের মাস

ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে পাকিস্তান

আপডেট : ০৩ ডিসেম্বর ২০২১, ১১:৩১

একাত্তরের ৩ ডিসেম্বর ভিন্নমাত্রা পায় বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম। পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে শুরু হয় সম্মুখযুদ্ধ। এতদিন চোরাগোপ্তা আক্রমণ থেকে সরে এসে ভারতীয় যৌথবাহিনীর সঙ্গে একসারিতে সম্মুখযুদ্ধে এগিয়ে যায় বীর বাঙালি। মনোবল বাড়ে বাংলার দামাল ছেলেদের, পরাজয়ের সময় ঘনিয়ে আসতে শুরু করে এই মাটি আর বাংলার স্বাধীনতার শত্রুদের।

এদিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কলকাতা সফরকালে ব্রিগেড প্যারেড ময়দানের সভা সংক্ষেপ করে সন্ধ্যায় হঠাৎ দিল্লি রওয়ানা হন। 

রাতে জাতির উদ্দেশে এক বেতার ভাষণে তিনি বলেন, পাকিস্তান আজ ভারতের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক হামলা চালিয়েছে। ভারতকে এ যুদ্ধ মোকাবিলা করতে হবে। পাকিস্তানের আক্রমণ ঐক্যবদ্ধভাবেই প্রতিহত করতে হবে। তিনি দেশবাসীকে চরম ত্যাগ স্বীকারের জন্য তৈরি হবার আহ্বান জানান।

বাঙালির মুক্তিযুদ্ধকে আন্তর্জাতিক যুদ্ধে পরিণত করার মত শেষ অস্ত্র বেছে নেয় পাকিস্তানি বাহিনী। তারা আকস্মিকভাবে স্থল ও আকাশ-পথে ভারতের পশ্চিমাঞ্চল আক্রমণ করার ফলে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়। ভারতের অমৃতসর, পাঠানকোট, শ্রীনগর, অবন্তীপুর, যোধপুর, আম্বালা ও আগ্রা বিমান ঘাঁটিতে আক্রমণ চালায় পাকিস্তান। মধ্যরাতে ভারতও সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। 

পাকিস্তানের ভারত আক্রমণের জের ধরে এ দিনে গঠন হয় বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ড। ভারত ও বাংলাদেশ বাহিনী সম্মিলিতভাবে পূর্ব সীমান্তে অভিযান শুরু করে। ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশের পাক অবস্থানকে ঘিরে ফেলার প্রচেষ্টায় সীমান্তের ৭টি এলাকা দিয়ে প্রচণ্ড আক্রমণ পরিচালনা করে। পূর্বাঞ্চলে পাকিস্তানের চার ডিভিশন সৈন্য ভারতের সাত ডিভিশন সৈন্য ও মুক্তিযোদ্ধার মুখোমুখি হয়।

একাত্তরের এ দিনেই বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর সার্থক হামলায় নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল ও চট্টগ্রামের ফুয়েল পাম্প মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বীর মুক্তিযোদ্ধারা এ সময় একের পর এক যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন ও ক্ষতিগ্রস্ত করে পাকিস্তানি সেনাদের ফাঁদে পড়া ইঁদুরের মতো কোণঠাসা করে তোলে। পাশাপাশি যথাযথ সমর পরিকল্পনা নিয়ে ভারতীয় সেনা সাহায্য বিশেষ করে ছত্রীসেনাদের অবতরণের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে। পরে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অনেক কর্মকর্তা মুক্তিযোদ্ধাদের অসীম সাহস ও সুচতুর পরিকল্পনার প্রশংসা করেছেন।

এদিন কুমিল্লায় মেজর আইনউদ্দিনের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী মিয়াবাজারে পাকসেনাদের ওপর হামলা চালায়। ভারতীয় আর্টিলারি বাহিনীর সহযোগিতায় মুক্তিযোদ্ধারা মিয়াবাজার দখল করে নেন। আখাউড়ার আজমপুর স্টেশনে দুই পক্ষই নিজ নিজ অবস্থানে থেকে দিনভর যুদ্ধ চালিয়ে যায়। সিলেটের ভানুগাছায় পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে ১৭ জন মুক্তিযোদ্ধা নিহত হন। নোয়াখালীতে সুবেদার মেজর লুৎফর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল সোনাইমুড়ি মুক্ত করে। এরপর তারা চৌমুহনীতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায়।

মেজর জাফর ইমামের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী মাইজদীতে পাকবাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায়। রংপুরের পলাশবাড়ীতে ১২ জন পাকসেনা আত্মসমর্পণ করে। সাতক্ষীরা থেকে পিছু হটে দৌলতপুরের দিকে যায় পাকিস্তান বাহিনী। সব সেতু ভেঙে দেওয়ায় মুক্তিযোদ্ধারা তাদের পিছু নিলেও বাধাগ্রস্ত হন।

মার্কিন সিনেটর উইলিয়াম স্যাক্সবি রাওয়ালপিন্ডিতে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনাকালে বলেন, তিনি বেআইনি ঘোষিত আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সাক্ষাৎ করতে পারেননি। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার আলোচনাকালে শেখ মুজিবুর রহমান প্রসঙ্গ নিয়ে তার কথা হয়। তিনি শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য পুনরায় পাকিস্তান আসতে রাজি হন।

এদিকে, জামায়াতে ইসলামীর আমীর গোলাম আজম পূর্ব পাকিস্তান থেকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করা উচিৎ বলে লাহোরে মতো প্রকাশ করেন। পাকিস্তান বিমানবাহিনী ভোর রাতে আগরতলা শহরের ওপর আক্রমণ পরিচালনা করে। 

মুক্তিযোদ্ধারা বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেলেও হাল ছাড়েনি শত্রুরা। এদিন জুম্মার নামাজের পর ভারতীয় হামলার প্রতিবাদে একটি মিছিল চট্টগ্রাম শহর প্রদক্ষিণ করে লালদীঘি ময়দানে জড়ো হয়। জামে মসজিদের ইমাম মওলানা আল-মাদানীর সভাপতিত্বে এ সভায় বক্তব্য রাখেন কনভেনশন লীগ প্রধান ফজলুল কাদের চৌধুরী, পিডিপির মাহমুদুন্নবী চৌধুরী, ছাত্রনেতা আবু তাহের, অধ্যাপক শামসুল হক প্রমুখ।

এদিকে, পাকিস্তান এয়ারলাইন্স পূর্ব ও পশ্চিম অংশের মধ্যে সব ফ্লাইট বাতিল করে। সামরিক কর্তৃপক্ষ সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত ঢাকায় সান্ধ্য আইন জারি ও নিষ্প্রদীপ ব্যবস্থা পালনের নির্দেশ দেয়। ১১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিবাহিনী কামালপুর বিওপি আক্রমণের প্রস্তুতি গ্রহণ করে।

ইত্তেফাক/এএএম