বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

আকাশপথের মুক্তিসেনা: কিলোফাইটার্স

আপডেট : ০৪ ডিসেম্বর ২০২১, ০৪:৩৪

মহান মুক্তিযুদ্ধ ছিল পাকিস্তানের প্রশিক্ষিত সুসজ্জিত বাহিনীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের অসম অথচ বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের কাহিনী। কিলোফাইটার্সরা ছিলেন প্রতিকূল পরিবেশে এক অনন্য বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের সৈনিক। যে যুদ্ধ মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের। যে যুদ্ধ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মনোবল ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। বলছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপ ক্যাপ্টেন শামসুল আলম বীর-উত্তম।

শুক্রবার আগারগাঁওয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে মুক্তিযুদ্ধের সেই ঐতিহাসিক দিনের সকালে তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে আলোচনা করছিলেন চট্টগ্রাম তেল ডিপোতে হামলা চালানো বৈমানিক শামসুল আলম বীর-উত্তম। বলছিলেন যুদ্ধ দিনের কথা। কিলো ফ্লাইট ছিল একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তি বাহিনীর যুদ্ধবিমান চালনার সাংকেতিক নাম। এ বাহিনীর অ্যালুয়েট-৩ হেলিকপ্টারটি এখন সজ্জিত রয়েছে জাদুঘরের দেওয়ালে। সেখানেই যুদ্ধ দিনের গল্প বলছিলেন চট্টগ্রামের তেল ডিপোতে বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়া অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা শামসুল আলম।

২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭১, উন্মোচিত হলো মুক্তিযুদ্ধের নতুন দিগন্ত। কিলো ফ্লাইট গঠনের মাধ্যমে জন্ম নেয় বাংলাদেশ বিমান বাহিনী। শুরু হয় আকাশপথে যুদ্ধের প্রস্তুতি। কিলো ফ্লাইট গঠন করা হয়েছিল একটি ডিএইচসি-৩ অটার বিমান, একটি অ্যালুয়েট-৩ হেলিকপ্টার এবং একটি ডিসি-৩ ডাকোটার সমন্বয়ে। ১৯৭১ এর সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকারের নেতৃত্বে ৯ জন বাঙালি পাইলট এবং ৫৮ জন প্রাক্তন পিএএফ সদস্যদের নিয়ে এই ইউনিট গঠিত হয়েছিল। বিমানগুলো ভারতীয় কর্তৃপক্ষ সরবরাহ করেছিল এবং স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদের নেতৃত্বে সজ্জ্বিত হয়েছিল যা আইএএফ বেস জোড়হাট থেকে পরিচালিত হতো। ইউনিটটি ১৯৭১ সালের অক্টোবরে নাগাল্যান্ডের ডিমাপুরে প্রশিক্ষণ শুরু করে এবং এই ইউনিটটি সর্বপ্রথম ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর রাতে নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামে তেল ডিপোতে আক্রমণ করে অধিকৃত বাংলাদেশে পাকিস্তানি লক্ষ্যবস্তুতে বিমান হামলা চালায়। পরবর্তী সময়ে এই কিলো ফ্লাইট ইউনিটটি একাত্তরে ডিসেম্বর ৪ থেকে ১৬ ডিসেম্বর এর মধ্যে ৯০টি অভিযান এবং ৪০টি যুদ্ধের মিশন পরিচালনা করেছিল।

ছবি: সংগৃহীত

ঐতিহাসিক এই দিনটিতে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে আয়োজন করা হয়েছিল স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠানের। এতে অংশ নেন ক্যাপ্টেন কাজী আলমগীর সাত্তার, বীরপ্রতীক ও গ্রুপ ক্যাপ্টেন শামসুল আলম বীর-উত্তম। স্বাগত বক্তব্য রাখেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ডা. সারওয়ার আলী, শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন জাদুঘরের ট্রাস্টি  ও সদস্যসচিব সারা যাকের।

চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জে অপারেশন
প্রথমে অপারেশন বাতিল পরে এক দফা তারিখ বদলে শেষমেশ প্রথম অপারেশনের তারিখ নির্ধারিত হয় ৩ ডিসেম্বর। স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ ও ফ্লাইং অফিসার বদরুল আলম অ্যালুয়েট হেলিকপ্টার নিয়ে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলের তেলের ডিপো এবং ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম ও ক্যাপ্টেন আকরাম আহমেদ অটার বিমান নিয়ে অপারেশন করেন চট্টগ্রামের ইস্টার্ন রিফাইনারিতে। ভারতের কমলপুর থেকে তিনি ও আকরাম আহমেদ অটার বিমান নিয়ে যাত্রা শুরু করেন চট্টগ্রামের উদ্দেশে। এই বিমানে কাঁটাকম্পাস ছাড়া দিক নির্ণয়ের আর কোনো আধুনিক সরঞ্জাম ছিল না। এ জন্য তাদের বলা হয়েছিল, চট্টগ্রাম অপারেশনে যাওয়ার সময় তারা যেন তেলিয়ামুড়ার ওপর দিয়ে উড়ে যান এবং সেখানে উপস্থিত হলে বিমানের দৃশ্যমান বাতিগুলো যেন তারা কয়েকবার জ্বালিয়ে আবার নিভিয়ে দেন। তখন প্রত্ত্যুতরে নিচ থেকে মশালবাতি জ্বালানো হবে। এতে বোঝা যাবে, বিমানটি যথাসময়ে ও সঠিক সময়ে অগ্রসর হচ্ছে। পথচ্যুতি ঘটলে তারা সঠিক পথ নির্ধারণ করে নিতে পারবেন।

শামসুল আলম ও আকরাম আহমেদ চট্টগ্রামের উপকূল রেখা-বরাবর উড়ে যথাসময়ে পৌঁছান ইস্টার্ন রিফাইনারির তেলের বিশালাকার ট্যাংকগুলোর কাছে। আক্রমণের নির্ধারিত সময় ছিল মধ্যরাত। ঠিক রাত ১২টা ১ মিনিটে গর্জে ওঠে তাদের বিমানে থাকা রকেটগুলো। প্রথম দুটি রকেট তেলের ডিপোতে নির্ভুল নিশানায় আঘাত হানে। মোট চার বার তারা সেখানে আক্রমণ চালান। সফল এই আক্রমণে ইস্টার্ন রিফাইনারির চারদিকের তেলের ডিপোগুলো দাউ দাউ আগুনে জ্বলতে থাকে।

সিদ্ধান্ত ছিল, শামসুল আলমেরা চট্টগ্রামের ইস্টার্ন রিফাইনারিতে একবারই আক্রমণ করবেন। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল, প্রথম আক্রমণে মূল লক্ষ্যস্থলে রকেট নির্ভুল নিশানায় আঘাত হানলেও কয়েকটা তেলের আধার অক্ষত। বিমানে তাদের কাছে মজুত আছে বেশ কয়েকটি রকেট। তখন তিনি ও তার সহযোদ্ধা সিদ্ধান্ত নেন পুনরায় আক্রমণের। পরের আক্রমণ ছিল যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ, ততক্ষণে নিচ থেকে শুরু হয়েছে পাকিস্তানিদের গুলিবর্ষণ। কিন্তু কোনো কিছুই দমাতে পারেনি সেদিনের অকুতোভয় যোদ্ধাদের। রাত ১২টায় নারায়ণগঞ্জ এবং চট্টগ্রামের ইস্টার্ন রিফাইনারি এলাকা দিনের আলোর মতো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। 
বাংলাদেশের সাহসি বৈমানিকেরা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অপারেশন সাফল্যের সঙ্গে সমাপ্ত করলেন। তাত্পর্যপূর্ণ ঘটনা রচিত হলো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে। তেলের ডিপো ধ্বংস হওয়ায় ভয়াবহ জ্বালানি সংকটের সম্মুখীন হয় পাকিস্তানি বাহিনী। ৬ ডিসেম্বর থেকে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর স্যাবর জেটসহ সব বিমান উড্ডয়নে অক্ষম হয়ে পড়ে। আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনীর মনোবল হোঁচট খায়। অপর পক্ষে এই অপারেশনের পরেই বাংলাদেশ-ভারত সশস্ত্র বাহিনীর যৌথ ও চূড়ান্ত অভিযান শুরু হয়ে যায়। ত্বরান্বিত হয় বিজয়ের ক্ষণ।
প্রস্তুতিপর্ব
শুরু হয় যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, পাশাপাশি চলে বেসামরিক বিমানগুলোকে যুদ্ধ বিমানে পরিণত করার কর্মযজ্ঞ। অটার এবং অ্যালুয়েটের স্ট্রাকচার বদলানো হয়। অটারের উইংসের নিচে দুটি রকেট র্যাক লাগানো হয়, দুটি র্যাকে সাতটি করে ১৪টি রকেট বসানোর ব্যবস্থা হয়। হেলিকপ্টারে তিনটি বোমা র্যাক লাগানো হয়, প্রতি র্যাকে চারটি করে ১২টি বোমা বসানোর ব্যবস্থা হয়। ডাকোটা বিমানের প্রশিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত হন স্কোয়াড্রন লিডার সঞ্জয় চৌধুরী, অটার বিমানের প্রশিক্ষক হলেন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট ঘোষাল এবং অ্যালুয়েট হেলিকপ্টারের প্রশিক্ষক ছিলেন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট কেসি সিংলা। ১৪ অক্টোবর কিলো ফ্লাইটের কমান্ডিং অফিসার স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ ১ নম্বর সেক্টর থেকে এসে যুক্ত হলেন কিলো ফ্লাইটের সঙ্গে।

ইত্তেফাক/বিএএফ