শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

দুর্গম পাহাড়ে ভাগ্য বদলায়নি প্রান্তিক মানুষের

আপডেট : ০৪ ডিসেম্বর ২০২১, ০৮:১৮

প্রত্যন্ত পাহাড়ি পল্লি নাথাপাড়া। গ্রামটি খাগড়াছড়ি জেলা সদরের গোলাবাড়ি ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত। এই গ্রামের মানুষের একমাত্র অবলম্বন জুমচাষ।  নাথাপাড়ার খুব কাছেই রয়েছে দীঘিনালা উপজেলার রাইন্না পাড়া ও কলিপাড়া। বলতে গেলে তাদের অবস্থা একই। 

‘রাইন্না’ চাকমা শব্দ হলেও রাইন্নাপাড়ার সব পরিবারই ত্রিপুরা। দুই উপজেলার এ তিনটি পাহাড়ি পল্লির মানুষ সব ধরনের উন্নয়ন বঞ্চিত। তারা সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার আশাও করে না। যুগ যুগ ধরে জুম ফসলের খাবার খেয়ে গহীন পাহাড়ে নানা সমস্যা সংকটের মধ্যেও প্রকৃতির মায়ায় তারা বেঁচে আছেন। আজও অভাব ও দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রাম তাদের। এসব ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। 

যোগাযোগ, শিক্ষা, চিকিত্সাসহ প্রায় সব ক্ষেত্রেই তারা  পিছিয়ে আছেন। রাস্তা না থাকার কারণে পাহাড়ি এসব গ্রামে যেতে হয় ছড়া, গভীর জঙ্গল আর কঠিন পথ পেরিয়ে।  গ্রামগুলোতে নেই কোনো উন্নয়নের ছোঁয়া। শিক্ষা, চিকিত্সার মতো মৌলিক অধিকার হতে বঞ্চিত এসব এলাকার পাহাড়িরা। ১০-১৫ কিলোমিটারের মধ্যে নেই সরকারি স্কুল। গুটিকয়েক ছেলে-মেয়ে যায় পাহাড় ডিঙিয়ে দূর স্কুলে। ফলে অধিকাংশ শিশুই বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ বঞ্চিত। 

জেলার অন্তত ৪০/৫০টি পাহাড়ি গ্রামের হাজারো প্রান্তিক পরিবার যুগ যুগ ধরে উন্নয়ন বঞ্চিত হয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। শুধুই জুমচাষ নির্ভর তাদের জীবন-জীবিকা। অনেকেই জুমের সীমিত ধান, বাঁশ কড়ুল, শাকসবজি ও পাহাড়ের বিভিন্ন লতাগুল্ম খেয়ে জীবন চালায়। টিউবওয়েল না থাকায় ছড়া, কুয়ার পানি খেয়ে রোগাক্রান্ত হবার ঘটনা ঘটে। 

দীঘিনালার ছোট মেরুং হয়ে রাইন্নাপাড়ায় যেতে হয়। ছড়া-উঁচু পাহাড়-জুম-জঙ্গলাকীর্ণ দুর্গম কঠিন পথ। রাইন্নাপাড়ার শান্তি রানী ত্রিপুরা (৭৫) নামের জুমিয়ার সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘জুম করে খাই। সমস্যাটমস্যা জানি না।’ 

বৃদ্ধ বলাই দাশ ত্রিপুরার (৮২) বলেন, সমস্যার অন্ত নেই। চলাচলের মেঠো রাস্তাও নেই। স্কুল নেই। পুজা-অর্চনার একটি মন্দিরও নেই। তিনি আরো বলেন, ভোট দিতে যেতে হয় ১২ কিলোমিটার দূরে সেই ছোট মেরুং হাইস্কুলে। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া মোহন ত্রিপুরা (১৩) বলল, বহু দূরে স্কুল। যেতে ভয় হয়। সকালে স্কুলে গেলে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। মেরুং ইউনিয়নের লম্বাছড়া ত্রিপুরাপাড়া ও চাকমাপাড়া দুটিতেও অন্তহীন সমস্যা। গোটা গ্রামে স্থানীয় বৌদ্ধ বিহারের একটি ডিপটিউবওয়েল। দূর-দূরান্তের পাহাড়িরা পানির জন্যে আসেন। 

লাকি দেওয়ান জানান, ছড়ার পানি খেয়ে প্রায়ই পাহাড়িরা ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হন। ত্রিপুরা পাড়ার মুরব্বি মশিপোকা ত্রিপুরা অভিযোগ করে বলেন, যোগাযোগ, শিক্ষা, চিকিত্সা, পানিসহ অসংখ্য সমস্যায় জর্জরিত হয়ে আছি। 

১ নম্বর মেরুং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. রহমান কবীর রতন জানান, রাইন্নাপাড়া এত দুর্গম যেখানে পৌঁছানো কঠিন। রাস্তা, বিদ্যুত্, পানি, স্কুল কিছুই সেখানে নেই। তবে যোগাযোগের অভাবে এ গ্রামে উন্নয়ন করা সম্ভব হয় না।

দীঘিনালা সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান শিক্ষাবিদ নবকমল চাকমা জানিয়েছেন, প্রত্যন্ত গ্রামের পাহাড়িরা একেবারেই অবহেলিত ও বঞ্চিত। 

খাগড়াছড়ি সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মো. শানে আলম বলেন, সদর উপজেলার গোলাবাড়ী ইউনিয়নের নাথাপাড়াসহ এমনও কিছু পাহাড়ি পল্লি আছে, যেখানে শিক্ষার আলো পৌঁছায়নি। যারা আজও উন্নয়নের ছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। তাদের জন্যে বিশেষ সুবিধা দেওয়া দরকার। 

দীঘিনালা উপজেলা চেয়ারম্যান মোহাম্মদ কাশেম জানান, সব কাজ একসঙ্গে করা সম্ভব নয়। পর্যায়ক্রমে দুর্গম এলাকার উন্নয়নে যারা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন আমরা উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, উন্নয়ন বোর্ড, এলজিইডিসহ সব সংস্থার সমন্বয়ে এসব এলাকার উন্নয়ন করব। ইতিমধ্যে এসব দুর্গম এলাকার বিষয় নিয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরার সাথে কথা হয়েছে।

ইত্তেফাক/এএইচপি