বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

জঙ্গিরা কি ফের সক্রিয় হচ্ছে

আপডেট : ০৭ ডিসেম্বর ২০২১, ১৭:৩৭

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধারাবাহিক অভিযানের ফলে দেশে জঙ্গিদের তৎপরতা প্রায় শূন্যের নেমে এসেছিল। তবে, চলতি বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে জঙ্গি-তৎপরতার কিছু ঘটনা আবারও শুরু হয়েছে।  সর্বশেষ নীলফামারী সদরের মাঝাপাড়া এলাকার একটি ‘আস্তানা’ থেকে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)-এর হাতে  ৫ জঙ্গি গ্রেফতারের পর নতুন করে  প্রশ্ন উঠছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জঙ্গিরা কি ফের সক্রিয় হয়ে উঠছে?   

সর্বশেষ শনিবার (৪ ডিসেম্বর) নীলফামারী সদরের মাঝাপাড়া গ্রামের  একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে পাঁচ জঙ্গিকে গ্রেফতারের  পাশাপাশি বোমা তৈরির সরঞ্জামও উদ্ধার করে র‌্যাবের বোমা ডিজপোজাল ইউনিট। জিজ্ঞাসাবাদের সময় এই জঙ্গিরা র‌্যাবকে জানিয়েছে, তারা জেএমবির সামরিক শাখার সদস্য। ইন্টারনেটের বিভিন্ন ওয়েব পেজ দেখে তারা দীর্ঘদিন ধরে বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ নেয়। মূলত জেলখানায় অন্তরীণ থাকা শীর্ষ জঙ্গিদের আদালতে নিয়ে যাওয়ার পথে হামলা চালিয়ে মুক্ত করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, গুরুত্বপূর্ণ ও জনবহুল স্থাপনায় বোমা হামলা চালিয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করার লক্ষ্যে তারা এসব অত্যাধুনিক বোমা তৈরি করে আসছিল।

এরআগে, চলতি বছরের  ১৭ মে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকায় ট্রাফিক পুলিশ বক্সের সামনে প্লাস্টিকের ব্যাগের ভেতর থেকে শক্তিশালী একটি বোমা উদ্ধার হয়। ওইসময় জঙ্গিবাদে জড়িত থাকার অভিযোগে আবদুল্লাহ আল মামুন নামে স্থানীয় এক মসজিদের ইমামকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই গত জুলাই মাসের  দ্বিতীয় সপ্তাহে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের নোয়াগাঁও মিয়াবাড়ি এলাকায় জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে  প্রায় আড়াই ঘণ্টা ঘিরে রাখার পর বাড়িটিতে অভিযান শুরু করেছিল র‌্যাব।

ময়মনসিংহের খাগডহর এলাকা থেকে ৪ জঙ্গিকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। (ফাইল ছবি)

ওই ঘটনার পর ৪ সেপ্টেম্বর ময়মনসিংহের খাগডহর এলাকা থেকে ৪ জঙ্গিকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদকালে তারাও বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে বলে জানিয়েছেন র‍্যাবের মুখপাত্র খন্দকার আল মঈন। সংবাদ সম্মেলনে তিনি আরও জানান, ৪ জঙ্গি জানিয়েছে, ময়মনসিংহে ব্যাংকসহ কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান, এনজিও, স্বর্ণের দোকান টার্গেট করে ডাকাতির প্রস্তুতি নিচ্ছিল তারা। র‌্যাবের  ধারণা, হচ্ছে অর্থের জোগান পেতে জঙ্গিরা এখন ডাকাতির পথ বেছে নিচ্ছে। 

ময়মনসিংহের খাগডহর এলাকা থেকে গ্রেফতার চার জঙ্গি রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বসিলার এক জঙ্গি আস্তানার তথ্য দেয়। ওই তথ্যের ভিত্তিতে গত (৯ সেপ্টেম্বর)  বসিলায় জঙ্গি আস্তনাটিরও খোঁজ পায় র‍্যাব। পরে  সেখানে অভিযান  চালিয়ে উজ্জ্বল মাস্টার নামে জেএমবির এক শীর্ষ নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। 

হঠাৎ করে জঙ্গিদের এমন সক্রিয়তায়  নতুন করে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে।  এই বিষয়ে ইত্তেফাক অনলাইনকে র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন  বলেন, ‘সম্প্রতি যে অভিযানগুলো চালিয়েছি, সেখানে দেখেছি, যারা পুরনো ধারার জেএমবি,  তারাই নতুন করে সংঘবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করছে। এই জঙ্গিদের সবাই আব্দুর রহমান ও বাংলা ভাইয়ের অনুসারী।’

ফাইল ছবি

র‌্যাবের এই মুখপাত্র আরও বলেন, ‘পরবর্তী সময়ে  সারোয়ার জাহান ও তামিম নতুন গ্রুপটি তৈরি করেছে। তারা হলি আর্টিজানের হামলার মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করছে। এরপর তাদের গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।  পুরনো জঙ্গিদের অনেকেই আত্মসম্পর্ণ করেছে।’

খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘পুরনো ধারার যেসব জেএমবি সদস্য রয়েছে, তারা মনে করে, তাদের শিক্ষা অন্যান্য জঙ্গি সংগঠন থেকে আলাদা ব্যবস্থা। সারোয়ার ও তামিমদের মতো  এই জঙ্গিদের ভিত্তি ততটা শক্তিশালী না। এই জঙ্গিদের মধ্যে যে শক্তি,  সেটা ততটা শক্তিশালী না। উজ্জ্বল মাস্টাররা পুরনো ধারার যে জেএমবিদের নতুন করে সংগঠিত করার চেষ্টা করেছিল। গ্রুপ সংগঠিত হচ্ছে। সদস্য সংগ্রহের কাজ চলছে। আর সংগঠিত হতে হলে বড় অঙ্কের অর্থের প্রয়োজন হয়। তারা মনে কর,ছে অন্যান্য জঙ্গির মতো তাদের অর্থ নেই। এমনকি তারা অর্থ সংগ্রহের কাজটিও ঠিকঠাক করতে পারছে না। এজন্যই তারা ব্যাংক ডাকাতির পরিকল্পনা করেছে।’

এই র‌্যাব কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘আরেকটা ব্যাপার হলো, আইটি সেক্টরে ততটা জ্ঞান বা দক্ষ ছিল না  পুরনো ধারার জেএমবি সদস্যদের। তারা সাইবার ওয়ার্ল্ডে দক্ষ ছিল না। এখন তারা ভাবছে, কাজ করতে গেলে সাইবার ওয়ার্ল্ড, অনলাইন অ্যাক্টিভিটিস, আইটি সেক্টরের প্রয়োজন আছে। এজন্য তারা কিছু মানুষকে যুক্ত করছে। এভাবে তারা নতুনভাবে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছিল।’ 

র‍্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘জামালপুর, মইমনসিংহ  উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায়, নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলায় তারা সদস্য সংগ্রহ করছিল। পাশাপাশি পুরনো ধারার জেএমবি অর্থাৎ সেই সময়ে যারা ছিল, তাদের আস্তে আস্তে খোঁজে বের করা হচ্ছে। এরই মধ্যে ১০ থেকে ১২ জনের একটি দলে খোঁজে বের করতে তারা সক্ষম হয়েছে। এসব কার্যক্রম বিভিন্ন  তথ্যের ভিত্তিতে আমরা তাদের নজরদারিতে রাখছি। এই বিষয়ে আমরাও তৎপরতা বাড়িয়েছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘নীলফামারী থেকে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে, সেই ৫ জঙ্গি ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি) দিয়ে বোমা হামলা চালিয়ে দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি ও শীর্ষ জঙ্গিদের জেল থেকে মুক্ত করার পরিকল্পনা করছিল।’

নতুন করে জঙ্গি তৎপরতায় উদ্বেগ জানিয়ে নিরাপত্তা বিশ্লেষক আব্দুর এলাহী ইত্তেফাক অনলাইনকে বলেন, ‘জঙ্গিরা তো চাইবেই নতুন করে সংগঠিত হতে। তাদের কার্যক্রম দক্ষতার সঙ্গে চালিয়ে যাওয়ার জন্য কাজ করবে। তবে এ বিষয়ে যদি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কিংবা সরকারের কাছে কোনো তথ্য থাকে, তাহলে বিষয়টি নিয়ে জোরালো পদেক্ষেপ নেওয়া উচিত।’ তিনি আরও বলেন, ‘এজন্য জনমত তৈরি করতে হবে। শুধু তাই নয়, এ বিষয়গুলো নিয়ে মুক্ত আলোচনা দরকার। বিশেষ করে গণমাধ্যমকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। বিষয়গুলো নিয়ে আরও বেশি লেখালেখি করতে হবে।’ 

দেশে জঙ্গিরা নতুন সংঘবদ্ধ হচ্ছে কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মো. আব্দুর রশীদ ইত্তেফাক অনলাইনকে বলেন, ‘নিশ্চয়ই নতুনভাবে জঙ্গিরা সংঘবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করবে ।  জঙ্গিদের রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত করার আশঙ্কা আছে। সংগঠিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে তাদের সাংগঠনিক ক্ষমতা, অর্থনৈতিক সাপোর্ট, লজিস্টিক পাওয়ার না থাকায় সেভাবে মাথাছাড়া উঠতে পারছে না।  কিন্তু আমাদের এ বিষয়গুলো ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। সবসময় সতর্ক থাকতে হবে।’

সিটিটিসির প্রধান মো. আসাদুজ্জামান ইত্তেফাক অনলাইনকে বলেন, ‘নতুন করে জঙ্গিদের সংঘবদ্ধ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সম্প্রতি বিভিন্ন জায়গা থেকে জঙ্গিদের যে গ্রেফতার করা হচ্ছে, সেইগুলো আইনশৃঙ্খলা ররক্ষাকারী বাহিনীর কর্মদক্ষতার ফল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সতর্ক রয়েছে। তাই জঙ্গিরা গ্রেফতারও হচ্ছে।’

ইত্তেফাক/এনই