মুক্তিযুদ্ধের সময় দৈনিক ইত্তেফাককে সরকারের নির্দেশ মেনে সংবাদ প্রকাশ করতে বাধ্য করা হয়। সেই অবরুদ্ধ ও কণ্ঠরোধ করা দিনগুলোতেও ইত্তেফাক সতর্কতার সঙ্গে সত্য উচ্চারণ করেছিল। এই দিন থেকেই পরিকল্পিতভাবে দেশের কৃতী সন্তানদের হত্যা করা হয়। আর তা শুরু হয় দুই সাংবাদিককে হত্যার মধ্য দিয়ে।
১০ ডিসেম্বর, ১৯৭১। এদিন রাতে পিপিআইয়ের চিফ রিপোর্টার সৈয়দ নাজমুল হককে তার বাসভবন থেকে অপহরণ করা হয়। চামেলীবাগের বাসা থেকে ইত্তেফাকের কার্যনির্বাহী সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে তার বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায় সশস্ত্র ব্যক্তিরা। লাশও পাওয়া যায়নি এই শহিদ সাংবাদিকের।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পাকিস্তান ও তাদের দোসর রাষ্ট্রগুলো যুদ্ধ বন্ধের আলোচনা চালাচ্ছিল। এত দিনে তারা বুঝে গেছে এই যুদ্ধে জয়ের সম্ভাবনা একদমই নেই। এ সময় তারা দেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করার এক সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করে। সপ্তাহখানেকের বেশি সময় ধরে চলছিল এই তালিকা তৈরির কাজ। দেশের শিক্ষিত শ্রেণি, অর্থাৎ শিক্ষক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, চিকিৎসক, আইনজীবীদের রাখা হচ্ছিল এই তালিকায়।
এদিকে রণাঙ্গনে ‘মুক্তি’ শব্দটি আতঙ্ক হয়ে দেখা দিয়েছে নিজেদের প্রবল প্রতাপশালী মনে করা পাকিস্তানি সৈন্যদের কাছে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যুদ্ধের মাঠে দ্রুত তাদের নিয়ন্ত্রণ হারাতে থাকে। ফলে সৈন্যদের মনোবল ভেঙে পড়েছিল।
একাত্তরের এই দিনে খুলনা শিপইয়ার্ডের কাছে দায়িত্ব পালন করছিলেন বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ রুহুল আমীন। পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের মুখে মৃত্যুকে তোয়াক্কা না করে প্রতিরোধ গড়ে শহিদ হন এই যোদ্ধা।
বাংলাদেশের দামাল মুক্তিযোদ্ধারা এবং ভারতীয় বাহিনী কয়েক দিন ধরে সম্মিলিতভাবে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিল। এদিন এসব বাহিনীকে একটি এক কমান্ডের অধীনে এনে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সিনিয়র কমান্ডারদের যৌথ বাহিনী পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়।
এদিন মিত্র বাহিনীর জঙ্গি বিমানগুলো ঢাকা বেতার কেন্দ্রের ওপর আক্রমণ করে এবং কুর্মিটোলার ওপর বারবার রকেট হামলা অব্যাহত রেখে নিজেদের কর্তৃত্ব স্থাপন করে। মিত্র বাহিনীর বিমান আক্রমণে চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দর অচল হয়ে পড়ে। কয়েকটা জাহাজ ভর্তি পাকিস্তানি বাহিনী বঙ্গোপসাগর দিয়ে পালানোর সময় ধরা পড়ে। একটি জাহাজে নিরপেক্ষ দেশের পতাকা উড়িয়ে পাকিস্তানি বাহিনী সিঙ্গাপুরে পালানোর পথে মিত্র নৌবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে।
এ সময় সম্মিলিত বাহিনী উত্তরাঞ্চলের যুদ্ধে সর্বাত্মক সাফল্য অর্জন করেছে। মিত্র বাহিনী ও মুক্তিবাহিনী যৌথ অভিযান চালিয়ে দিনাজপুর, রংপুর ও সৈয়দপুরের শত্রু বাহিনীকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। যৌথ বাহিনী এই তিন শহর ছাড়া রংপুর ও দিনাজপুর জেলা সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত করে। রাতে পাকিস্তানি বাহিনী জামালপুর গ্যারিসন ছেড়ে ঢাকার দিকে পালানোর সময় শহরের অদূরে যৌথ বাহিনীর মুখোমুখি হয়। এই যুদ্ধে প্রায় ১ হাজার ৫০০ পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। বাকিরা আত্মসমর্পণ করে।