শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

গণহত্যার বীভৎসতা রোকেয়া হলে

আপডেট : ১৩ ডিসেম্বর ২০২১, ০৯:১৬

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বিকাল থেকেই থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে| থমথমে পরিস্থিতির আঁচ পড়েছিল রোকেয়া হলেও| কিন্তু তার আগেই হল ছাড়ে ছাত্রীরা| ছাত্রীরা হল ছেড়ে গেলেও রয়ে যান সাত জন ছাত্রী আর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা| সেদিনের মধ্যরাত ছিল রোকেয়া হলের ছাত্রীদের জন্য একটি নৃশংসতম রাত| এদিন রোকেয়া হলের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও তাদের পরিবারের সদস্যসহ মোট ৪১ জন শহিদ হন|

তৎকালীন সময়ে দেশ স্বাধীনের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা| তাই পাক হানাদার বাহিনীর প্রধান লক্ষ্যবস্তু ছিল জগন্নাথ হল, রোকেয়া হল এবং ইকবাল হল (বর্তমান শহিদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল)| রেসকোর্স ময়দান, হলের ছাদে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন ছাত্রীরা| যুদ্ধ প্রস্তুতির খবর পৌঁছে যায় পাক বাহিনীর কাছে| তাই ২৫ মার্চ গণহত্যার রাতে অন্যতম টার্গেট ছিল রোকেয়া হল| তবে ৭ মার্চের ভাষণের পর একটা বড় কিছুর আশঙ্কায় হল ছেড়েছিলেন প্রায় সব ছাত্রী| সংগঠনের কাজে সেই রাতেও অবশ্য হলে ছিলেন ছাত্রলীগের কয়েক জনসহ সাত ছাত্রী|

গণহত্যার তাণ্ডব শুরুর পর পরই এই ছাত্রীদের নিরাপদে লুকিয়ে রেখেছিলেন তত্কালীন সময়ের হাউজ টিউটর সাহেরা খাতুন| যার ফলে বেঁচে যান সাত জন ছাত্রী|

অভিযানটি কতটা নৃশংস ছিল তা জানা যায় রোকেয়া হলের তত্কালীন বাসিন্দা ফুল বানুর বর্ণনায়| স্বামী তৎকালীন মালী শহিদ আব্দুল খালেকের চাকরিসূত্রে থাকতেন হলের স্টাফ কোয়ার্টারে| স্বামী-সন্তান ও ছোট বোনের সঙ্গে ফুল বানু ছিলেন কোয়ার্টারের টিনশেড বাসায়| সে রাতে অপারেশন সার্চলাইটের তাণ্ডবে পঙ্গুত্ব বরণ করেন তিনি| হারান স্বামী আর বোনকে|

ফুল বানু ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, বিকালে বাপ কল দিয়া কইল, ঢাকার পরিস্হিতি ভালো না| যত দ্রুত সম্ভব নারায়ণগঞ্জের বাড়িতে চলে যাওয়ার জন্য| বাড়িতে চলে যাওয়ার জন্য উনার সঙ্গে জোরাজুরি করি| কিন্তু উনি রাজি হচ্ছিলেন না| এ নিয়ে কান্না করছিলাম| তখন রাত আনুমানিক ১২টা বাজে| আমি তখনো কাঁদতেছি| এমনি শুনি বোম্বিং শুরু হয়ে গেছে| ট্যাংক দিয়া হলের গেট ভাঙতেছে| আমি আতঙ্কিত হয়ে গেলাম| কিছুক্ষণ পরই বাসার বারান্দায় বুটের শব্দ শুনলাম| স্বামীকে বললাম, মনে হয় আর্মি এসে পড়েছে| দরজা খুলতেও না করছিলাম| স্বামী বলল, মনে হয় ছাত্রদের মারতেছে| আমি বারবার বলতে লাগলাম, এত শব্দ হচ্ছে, মানে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে| বারান্দায় ধীরে ধীরে শব্দ বাড়তে লাগল| স্বামী বলল, মনে হয় ছাত্ররা আশ্রয় নিতে আসছে| আমি একটু দেখে আসি| তারে তখন আমি সাবধান করে দিলাম যে আগে দেখ| দরজার ফাঁক দিয়া তাকায়ে দেখে মিলিটারে হাঁটতাছে|

তিনি বলেন, এরপর স্বামী এসে পেছনের জানালা ভাঙার চেষ্টা করল| আমরা চাইলাম যেভাবে হোক পিছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যাব| কিন্তু লোহাগুলো অনেক শক্ত ছিল, ততক্ষণে মিলিটারি লাথি মেরে দরজা ভেঙে ফেলে| দরজা থেকেই গুলি আর গুলি| একনাগাড়ে তারা গুলি করে যেতে লাগল| আমার স্বামী নুরীরে (ফুল বানুর বোন) নিয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে মাটিতে শুয়ে পড়ল| কিন্তু এত গুলি করেছে, স্বামী ও নুরীর শরীর ঝাঁজরা হয়ে গেছে| আমি বাচ্চাটাকে নিয়ে কাত হয়ে পড়ে গেছি| পা-টা বাইরের দিকে আর মাথাটা ভিতরের দিকে ছিল| পায়ে গুলি লেগেছিল| সকালবেলা মিলিটারিরা এসে আবার বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে যায়| শনিবার লাশ গর্তে নিয়া ফেলে দেয় তারা|

সেই রাতে প্রিয়জন হারিয়ে ভাগ্যগুণে বেঁচে গিয়েছিলেন ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র এস এম মহসীন| মহসীনের বর্ণনায়ও ফুটে ওঠে সে রাতের বীভত্সতার চিত্র| তিনি বলেন, মধ্যরাতে আমার মা আমাকে ডেকে তুললেন| তিনি বললেন, বাবা কীসের শব্দ শোনা যাচ্ছে, তোমরা রুমের ভেতরে ঘুমাও| আমি কাকার ঘরে বিছানা করে বাতি নিভিয়ে ঘুমাব, ঠিক সেই সময় দরজায় লাথির আঘাত শুনতে পেলাম| ছিটকিনি ভেঙে গেল| মিলিটারিরা হ্যান্ডসআপ বলতেই মোসলেম হাত মাথার ওপরে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গুলি করল| মোসলেম মাটিতে লুটিয়ে পড়ে| আমি এবং গিয়াস উদ্দিন কাকা দরজার পাল্লার সঙ্গে আড়াআড়ি চলে গিয়েছিলাম| মোসলেম তখনো বেঁচে ছিল, পানি, পানি করছিল| এরপর গিয়াস উদ্দিন কাকা আমাকে খাটের নিচে লুকিয়ে থাকতে বলে, নিজে একটি ড্রামের ভেতরে লুকালেন| ওরা ভেতরে ঢোকেনি, বাইরে থেকেই গুলি করে চলে গিয়েছিল| শুনতে পাচ্ছিলাম চারদিকে গোলাগুলির প্রচণ্ড শব্দ, লোকজনের চিত্কার| এভাবে কোনোমতে ভয়াল রাত পার করলেন মহসীন| কিন্তু জানতেন না জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ দৃশ্যটি অপেক্ষা করছে তার জন্য|

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন ছাত্রীদের একটি মাত্র হল ছিল| রোকেয়া হলের পেছনের অংশ বর্তমান শামসুন্নাহার হলের গেট| এখানেই গণকবর দেওয়া হয় রোকেয়া হলের শহিদদের|

ইত্তেফাক/কেকে