শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

ফ্যানের ইতিহাস

আপডেট : ১৬ ডিসেম্বর ২০২১, ১৬:৩৬

ড্রয়িংরুমেই ঢুকেই প্রশ্ন করেন আফসার আহমেদ, বেয়াই ঘুমিয়েছিলেন ঠিকভাবে?

নাহ! সিরাজউদ্দিন শোয়া থেকে উঠে বসেন। দেখে ক্লান্ত মনে হচ্ছে। সিরাজউদ্দিনের শরীরটা বেশ ভারী। শরীরের রংটা ফর্সাসাদা। গোলগাল মুখের নিচে হালকাপাতলা দাড়ি। চোখের নিচে সামান্য কালির আভাস। চোখেমুখে বিধ্বস্ত ভাব। বোঝা যাচ্ছে—ঘুমটা ভালো হয়নি। এই বয়সে ঘুম না হলে শরীর ভেঙে পড়ে।

ঘুম ভালো হয়নি আপনার? অবাক আফসার আহমেদ। বসেন বিছনার পাশে, বলুন আমাকে কেন রাতে ঘুমুতে পারেন নি? কেউ আপনাকে বিরক্ত করেছিল?

মাথার ওপর বন্ধ ফ্যানটা ইঙ্গিত করে দেখান সিরাজউদ্দিন, ফ্যানের শব্দে।

আফসার আহমেদ অবাক। এবং দেখেছেন রুমের ফ্যান বন্ধ। গরমের সময়ে ফ্যান বন্ধ! তিনি দেখলেন, রুমের পূর্ব দিকের তিনটি জানালা খোলা। অল্প অল্প বাতাস আসছে। কিন্তু জুনের শেষ দিক যদিও, গরম কম না। ঢাকা শহরে কেউ ফ্যান বন্ধ করে ঘুমানো চিন্তাও কতে পারে না। গ্রাম থেকে আসা মানুষ বলেই কী ফ্যান বন্ধ করে রেখেছেন বেয়াই?

অপরাধী গলায় বলেন আফসার, বেয়াই ফ্যানটা পুরানো, অনেক বছরের...। হ্যাঁ, একটা খট খট শব্দ হয় বটে, কিন্তু হালকা শব্দ কানে গভীরভাবে শোনাই যায় না। কিন্তু আপনি বেয়াই এই ফ্যানের শব্দের জন্য সারা রাত ঘুমুতে পারেন নি? অবাক ঘটনা, আমাকে ডাকলেন না কেন?

রাতে যখন বৌমা বিছানা ঠিক করে দিয়ে লাইট নিভিয়ে দিয়ে যায়, তখন স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু রাত যত গভীর হয়েছে, ফ্যানের খট খট শব্দ তত বেড়েছে। ভেবেছি, ঘুমিয়ে গেলে শব্দটা কানে ঢুকবে না। কিন্তু না, অনেক চেষ্টা করেও ঘুমটা আসছিল না। ফ্যানের শব্দটা কান দিয়ে একেবারে বুকের মধ্যে কলিজায় গিয়ে আঘাত করেছে। উঠে বসলাম, দেখলাম রাত গভীর, আড়াইটা...। অতো রাতে আপনাদের ডেকে আর বিরক্ত করতে চাইনি। শেষে ফ্যান বন্ধ করে জানালা খুলে ঘুমিয়েছি...।

নাস্তা নিয়ে ঢোকে কল্যাণী, বাবা ওঠেন। দুজনের জন্য নাস্তা এনেছি। শ্বশুরের দিকে তাকিয়ে বলে আর ট্রলি ট্রে থেকে খাবারের প্লেট নামিয়ে টি টেবিলের ওপর রাখতে থাকে।

বিছানা থেকে নেমে স্যান্ডেল পায়ে বাথরুমে ঢাকেন সিরাজ-উদ্দিন। আফসার আহমেদ উঠে ফ্যান ছাড়েন। রুমের গরম ঘুমোট ভাবটা মুহূর্তে কেটে যায়। ঘূর্ণায়মান ফ্যানের দিকে তাকিয়ে কল্যাণী অবাক কণ্ঠে প্রশ্ন করে পিতাকে, আব্বা ফ্যান বন্ধ ছিল কেন?

তোর শ্বশুর বন্ধ করে রেখেছিল, খাবারের টেবিলের সামনে সোফায় বসতে বসতে বলেন আফসার আহমেদ।

অবাক কল্যাণী, কেন ফ্যান বন্ধ করেছিলেন বাবা?

ফ্যানের বিকট শব্দে বেয়াই ঘুমাতে পারেন নাই।

বলেন কী? কল্যাণী প্রশ্নবোধ দৃষ্টিতে পিতার দিকে তাকায়।

আফসার আহমেদ বলেন, বাড়িটা পুরোনো। ফ্যানও অনেক দিনের। আমরা তো এই রুমে খুব একটা আসি না। তোর শ্বশুর এলে বড় রুম ভেবে থাকতে দিলাম। কিন্তু সারা রাত ফ্যানের খট খট খট শব্দে ঘুমাতে পারেননি বেয়াই। শেষ ফ্যান বন্ধ করে জানালা খুলে ঘুমিয়েছেন।

রুমে ঢোকে মিথুন। বছর তিনেক আগে মিথুনের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে কল্যাণীর। দুজনেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল। সেখানেই দেখা প্রেম এবং বিয়ে। যদিও আফসার আহমেদ বিয়েতে রাজি ছিলেন না। বিশেষ করে গ্রামের কোনো ছেলের কাছে তো নয়ই। তার ওপর মিথুনের বাড়ি বরিশাল এলাকায়। অনেকের মুখে শুনেছেন, বরিশাল অঞ্চলের মানুষ ভালো না। মাথা গরম করে। পুরুষেরা একের অধিক বিয়ে করে। কিন্তু মেয়ে কল্যাণীর জেদের কাছে হেরে গেছেন।

কল্যাণীর একটাই সংলাপ, বিয়ে করলে মিথুনকেই, নইলে জীবনে আর বিয়ে নয়।

অনেক ভেবে দেখলেন আফসার আহমেদ—একমাত্র মেয়ে আমার! মিথুনের সঙ্গে বিয়ে না দিলে সত্যি সত্যি আর জীবনে বিয়ে না করে?

মেয়ের মা, রেবেকা আহমেদ মেয়ের সঙ্গেই বাদ্য বাজায়, মেয়ে যা বলে শোনো। বলা যায় না, এই যুগের মেয়ে। যা বলে করে ছাড়বে। শেষে তোমাকে আমাকে কাঁদতে হবে...।

বিয়ের পরে দেখলেন, মিথুন ছেলে খুবই ভালো। ভদ্র, হিসেবি। মানবিক। একটা প্রাইভেট ব্যাংকের বড় পদে চাকরি করছে। ওর বাবা সিরাজউদ্দিনও অসম্ভব ভালো মানুষ। গ্রামের মানুষ তিনি। স্কুলে পড়াতেন। চার বছর হলো অবসরে গেছেন। চোখে এখন একটু কম দেখেন সিরাজউদ্দিন। বাবাকে ভালো চিকিত্সার জন্য ঢাকায় নিয়ে এসেছে মিথুন। বিয়ের পর আলাদা বাসা নিয়েছিল, কিন্তু কল্যাণীর মায়ের কারণে এই বাসায় উঠতে বাধ্য হয়েছে মিথুন। যদিও ভাড়া নেয় না আফসার আহমেদ, কিন্তু মিথুন প্রতি মাসে ত্রিশ হাজার টাকা ব্যাংকে রেখে দেয়। বেয়াইকে বিশাল বাসার বড় রুমটাতেই থাকতে দিয়েছেন। কিন্তু ফ্যানের খট খট খট শব্দে...।

কল্যাণীরা দুই বোন। ওর ছোট বোন পার্বণী। পার্বণী কলেজে পড়ে। বিয়ের পর শ্বশুর বাড়িতে থাকছে মিথুন। কারণ, চারতলা বিশাল বাড়ি। দোতলায় ছোট বড় আটটা রুম নিয়ে থাকেন আফসার আহেমদ। আফসার বলেন, আমি তোমার শ্বশুর। মেয়ে বিয়ে দিয়েও তোমার বাবা হতে পারলাম না।

মিথুন মাথা নিচু করে, সরি বাবা।

সিরাজউদ্দিন বাথরুম থেকে বের হয়ে এক সঙ্গে নাস্তা খেতে বসেন। খেতে খেতে সিদ্ধান্ত হয়, নাস্তার পর কল্যাণী শ্বশুরকে নিয়ে চোখের ডাক্তারের কাছে যাবে। মিথুন চলে যাবে অফিসে। আর আফসার আহমেদ ইলেকট্রিক মিস্ত্রি ডেকে ফ্যান সারাবেন। নাস্তার পর কল্যাণী শ্বশুরকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যায়। ডাক্তার পরিচিত। আগে থেকেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়া। অনেক সময় নিয়ে সিরাজউদ্দিনকে দেখে বলেন, ডায়াবেটিসের কারণে চোখের পাওয়ার কিছুটা কমেছে। ডাক্তার একই সঙ্গে ডায়াবেটিসের ওষুধ ও একটা চশমা দিলেন। ডাক্তারের চেম্বারের লাগোয়া দোকানে ঢুকে ছেলের বৌ আর শ্বশুর মিলে অনেকগুলো ডিজাইন দেখতে থাকে। কল্যাণী বলে, আব্বা আপনার বেয়াইতো এই দোকান থেকে চশমা নেন।

ঠিকাছে, আমাকেও বানিয়ে দাও।

মিথুন বলছিল, আপনি বাড়িতে প্রচুর বই পড়েন।

হাসেন সিরাজউদ্দিন, হ্যাঁ মা। অবসর জীবনে কী আর করব? শৈশব থেকে বই পড়ার নেশা। আমার মনে হয় কি জানো, দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ বা প্রয়োজনীয় বইটি এখনো পড়তে পারিনি।

কিন্তু আপনার চোখেতো চাপ পড়ছে...

পড়ুক, পড়া ছাড়া বাঁচতে পারব না।

পুত্রবধূকে নিয়ে রিকশায় উঠলেন সিরাজউদ্দিন। রিকশা চলতে শুরু করে, কল্যাণী মা, বত্রিশ নম্বর বাড়িটা কত দূর?

কল্যাণী প্রশ্নবোধক চোখে তাকায়।

আরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িটার কত দূর?

লজ্জা পায় কল্যাণী, যাবেন?

যদি কাছে হয়, একটু যেতে চাই।

চলেন... এই রিকশাঅলা, রিকশা ঘুরাও...।

গ্রিনরোড থেকে ঘুরাতে ঘুরাতে বলে রিকশাঅলা, আফা! বাড়াইয়া দিতে অইবে।

ঠিকাছে, তোমাকে ঠকাব না। চলো, উত্তর দেয় কল্যাণী।

রিকশা এসে ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বর বাড়ির সামনে দেখল, বত্রিশ নম্বর বাড়ির গেট বন্ধ। বরিবার। কিন্তু পুত্রবধূকে সঙ্গে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বত্রিশ নম্বর বাড়ির সামনের চওড়া জায়গায় অনেকক্ষণ হাঁটলেন। ফিরে ফিরে বাড়িটা দেখলেন। কল্যাণীর সঙ্গে এক চাঅলার কাছ থেকে চা খেয়ে আবার রিকশায় উঠলেন।

বাড়িতে এসে দেখলেন, বিয়াই আসফার আহমেদ ইলেকট্রিক মিস্ত্রি এনে ফ্যান ঠিক করে রেখেছেন। ফ্যান চলছে। প্রচুর বাতাস। দুই বেয়াই গল্পে মেতে উঠলেন। কিন্তু পরের রাতে ঘুমানোর সময়ে সিরাজউদ্দিন ফ্যানের একই শব্দ শুনলেন, খট খট খট...। রাত যত গভীর হয়, ফ্যানের শব্দ তত বাড়ে। অসহ্য যন্ত্রণায় সিরাজউদ্দিন বিছানা থেকে চাদর নিয়ে দুই রুমের মাঝখানের প্যাসেজে ঘুমিয়ে থাকেন। সকালে সিরাজউদ্দিনেক প্যাসেজে শুয়ে থাকতে দেখে বিস্মিত আফসার আহমেদ, কল্যাণী, মিথুন।

ঘটনা কি? আব্বা আপনি এখানে কেন শুয়ে আছেন? জিজ্ঞেস করে কল্যাণী।

উঠে বসতে বসতে বিব্রত সিরাজউদ্দিন বলেন, মা আমি বোধহয় অসুস্থ হয়ে গেছি।

কাছে এসে কপালে মাথায় হাত রাখে কল্যাণী, কেন? কি হয়েছে?

তোমার বাবা আমার বেয়াই গতকালইতো মিস্ত্রি ডেকে ফ্যানটা ঠিক করালেন। কিন্তু গত রাতে রাত যত গভীর থেকে গভীর হয়, ফ্যানের মধ্যে থেকে সেই খট খট খট শব্দটা পাই। মনে হচ্ছে খট খট শব্দ করতে করতে আমার মাথার ওপর ভেঙে পড়বে। আমার মাথার মধ্যে খুব যন্ত্রণা করতে শুরু হলো, অসহ্য যন্ত্রণা। বাধ্য হয়ে এখানে ঘুমিয়েছি মা। রাতে ঘুম না হলে শরীর খুব খারাপ করে।

বেয়াইসাব,কি বলছেন বুঝতে পারছি না। যাই হোক, আজকে পুরোনো ফ্যানটাই রাখব না। নতুন একটা ফ্যান লাগিয়ে দেব আপনার রুমে।

সেটাই করুণ বাবা, পিতাকে সমর্থন করে মেয়ে কল্যাণী। আপনি এখন উঠুন, শ্বশুরকে তাগাদা দেয়। নাস্তাটা সারুন। আজকে আপনার চশমা আনতে যেতে হবে।

মিথুন মামুন বিব্রত। আজব ঘটনা, রাত যত বাড়ে ততই ফ্যানের রেগুলেটর থেকে খট খট খট শব্দ বের হয়? এমন অদ্ভুত ঘটনা কেউ শুনেছে? বাবা কি মাসনিকভাবে অসুস্থ? নাকি কল্যাণীর সঙ্গে আমার বিয়ে মেনে নিতে পারেনি এখনো? কল্যাণীর সঙ্গে বিয়ের সময়ে বাবা আসেননি। তিনি মিথুনকে গ্রামের মেয়ে বিয়ে করাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মিথুন যখন জানিয়ে দেয়, কল্যাণীকে ছাড়া আর কাউকে কখনো বিয়ে করবে না, তখন ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ের অনুমতি দিয়েছিলেন। কিন্তু বিয়ের সময়ে আসেননি। কিন্তু বিয়ের পর কল্যাণী বাড়ি গেলে, ওকে দেখে গ্রহণ না করে পারেন নি। এবং দুজনের মধ্যে এখন ভালো সম্পর্ক। তাহলে?

বাবা এমনিতে খুব সহজ সরল; কিন্তু কোনো বিষয়ে একবার প্রশ্ন তুললে, সহজে ভোলেন না। মিথুন পিতাকে চেনে। কোনো খেলা শুরু করেছেন? কিন্তু কি করতে পারে মিথুন? শ্বশুর আফসার আহমেদ মাটির মানুষ। ঢাকা শহরের বুকের ওপর বাড়ি, আরো আছে কয়েকটা, সবই পিতার সূত্রে পেয়েছেন। কোনো অহংকার নেই। এই সহজ সরল মানুষটাকে অপদস্হ করার কোনো পরিকল্পনা নয় তো?

কি ভাবছ? জিজ্ঞেস করে কল্যাণী।

চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে উত্তর দেয় মামুন, বলতে পারো আব্বার ফ্যান শব্দের রহস্যটা কি?

রহস্য আবার কি? ফ্যানের কয়েলের মধ্যে নিশ্চয়ই কোনো ঝামেলা আছে,সেই কারণে শব্দ হয়।

কিন্তু ইলেকট্রিশিয়ান ঠিক করল না গতকাল? আমরা অনেক রাত পর্যন্ত আব্বার সঙ্গে গল্প করলাম না? কই, তখন কোনো শব্দ পেয়েছিলে?

আরে আজকালকার ইলেকট্রিশিয়ানদের কিছু ঠিক আছে? চিন্তা করো না। বাবা তো আজকেই নতুন ফ্যান লাগিয়ে দিচ্ছেন। সুতরাং সমস্যা নেই...।

দেখি, কি হয়! আমি অফিসে যাই, এক ধরনের দ্বিধার সঙ্গে মিথুন মামুন অফিসে চলে যায়।

কল্যাণী প্রস্তুত হয়ে শ্বশুরকে নিয়ে চোখের ডাক্তারের কাছে যায়। ডাক্তারের কাছ থেকে নতুন চশমা চোখে দিয়ে বেশ আরাম বোধ করেন সিরাজউদ্দিন। রাস্তার পাশে বসে চা খেলেন পুত্রবধূকে সঙ্গে নিয়ে। বাসায় ফেরার সময়ে কল্যাণীকে জিজ্ঞেস করেন সিরাজউদ্দিন, মা সোহরাওয়াদী‌র্ উদ্যান কি অনেক দূরে?

না বাবা, যাবার পথেই পড়বে। যাবেন?

একটু যেতাম।

সোহরাওয়াদী‌র্ উদ্যান পার হওয়ার সময়ে কল্যাণী গাড়ি থামায়। শ্বশুরকে নিয়ে উদ্যানে ঢোকে। প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে নিঃশব্দে হেঁটে বেড়ালেন সিরাজউদ্দিন। অবাক কল্যাণী, শ্বশুর এত নীরব কেন? সাধারণত এমন নীরব থাকেন না। জিগ্যেস করে, বাবা চুপ হয়ে গেলেন যে!

শুনছি মা।

শুনছেন? হতভম্ব কল্যাণী, কি শুনছেন আব্বা?

মৃদু হাসেন সিরাজউদ্দিন, আমি যা শুনছি তুমি সেটা কোনোদিনও শুনতে পারবে না মা। চলো, যাই...।

বাসায় এসে দেখেন ইলেকট্রিক মিস্ত্রি পুরোনো ফ্যান খুলে ফেলেছে। নতুন ফ্যান লাগাচ্ছে। চোখে নতুন চশমা নিয়ে টেবিলের ওপর পুরোনো ফ্যানটা দেখেন সিরাজউদ্দিন। দেখতে দেখতে চিত্কার করে ডাকেন, বৌমা? বৌমা?

দৌড়ে আসে কল্যাণী, কি বাবা?

দেখো! সিরাজউদ্দিন হাতের ইশারায় দেখান পুরোনো ফ্যানটা, গলায় এক ধরনের ক্রোধ খেলা করছে। শ্বশুরের এই পরিবর্তনে বিস্মিত কল্যাণী।

ফ্যানের দিকে তাকিয়ে কি করবে বুঝতে পারে না কল্যাণী, বাবা কি দেখব?

আরে তুমি দেখো, ফ্যানটার ওপর কি লেখা! নির্দিষ্ট জায়গায় তর্জনি রেখে দেখান সিরাজউদ্দিন। অবাক চোখে কল্যাণী দেখে, ফ্যানের ওপর ছোট ছো্ট ইংরেজি অক্ষরে লেখা মেইড ইন পাকিস্তান। ফ্যানের দিক থেকে চোখ এনে আরো বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকায় কল্যাণী শ্বশুরের দিকে, আব্বা!

তোমরা ভাবছ, আমি পাগল হয়ে গেছি! না গো মা, পাগল হইনি, আমি ঠিকই আছি। মেইড ইন পাকিস্তান লেখা একটা ফ্যানের বাতাস একজন মুক্তিযোদ্ধা কখনোই সহ্য করতে পারে না, কেউ না বুঝুক, না জানুক, একজন মুক্তিযোদ্ধা ঠিকই বুঝবে।

কল্যাণী দুটি হাত ধরে সিরাজউদ্দিনের, আপনি...

আমার জামা খুললে দেখবে পিঠের ওপর ওদের আঘাতের চিহ্ন এখনো জেগে আছে। সাত দিন সাত রাত এক নাগারে টাঙিয়ে রেখেছিল টর্চার ক্যাম্পে। শেষে মৃত ভেবে ফেলে দিয়েছিল মৃতদের ভাগাড়ে। শকুন উড়ছিল, মুক্তিযোদ্ধাদের লাশ খুবলে খুবলে খাচ্ছিল। সেখান থেকে অবিশ্বাস্যভাবে বেঁচে এসেছি...

কল্যাণী নিবা‌র্ক চোখে সামনে দাঁড়ানো ইতিহাসের নতুন একজন মানুষকে দেখতে থাকে। 

ইত্তেফাক/এএএম