শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে এখনো তারা মেডিক্যাল অফিসার 

আপডেট : ১৯ ডিসেম্বর ২০২১, ০০:৩২

উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে মেডিক্যাল অফিসার পদে দায়িত্ব পালন করছেন চিকিৎসকরা। এতে একদিকে চিকিৎসকদের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে। অন্যদিকে রোগীরা সুচিকিৎসা এবং মেডিক্যাল শিক্ষার্থীরা সুশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

চিকিৎসকদের পদোন্নতি ২০ ভাগ পিএসপির মাধ্যমে এবং ৮০ ভাগ ডিপিসি’র মাধ্যমে হয়ে আসছে। প্রায় ৫ বছর ধরে চিকিৎসকদের ডিপিসি বন্ধ রয়েছে। এখন সিনিয়র স্কেল পরীক্ষায় পাস করার পর পদোন্নতি পেতে হয়। একজন চিকিৎসক সারাদিন রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেওয়ার পর পড়ালেখা করার সুযোগ খুব কমই পান।

আর সিনিয়র স্কেল পরীক্ষা নিয়ে চিকিৎসকদের মধ্যে দ্বিমত রয়েছে। সব মিলিয়ে চিকিৎসকদের পদোন্নতিতে চরম অবস্থাপনা বিরাজ করছে। একই বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ একই ক্যাডার পদোন্নতি পান একসঙ্গে। অথচ স্বাস্থ্য ক্যাডারের ক্ষেত্রে এটি অনুপস্থিত। এটি আন্তঃক্যাডার বৈষম্য ছাড়া আর কিছুই নয় বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা।

২০১২ সালের দিকে এক শ্রেণীর চিকিৎসকদের পরামর্শে চিকিৎসকদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে সিনিয়র স্কেল পরীক্ষা চালু করা হয়। ওই সময় আরেক শ্রেণীর চিকিৎসক এর বিরোধিতা করে বলেন, চিকিসৎসকরা পড়ালোখার সময় পাবে কখন? সারাদিন তো তাদের মেডিক্যাল শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিতে ও রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিতে সময় চলে যায়।

তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদের সচিবও এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেন। তারপরও এক শ্রেণীর চিকিৎসকদের তদবিরের কারণে সিনিয়র স্কেল পরীক্ষা অনুমোদন দেওয়া হয়। তখন থেকেই ডিপিসি বন্ধ রয়েছে। এর মাধ্যমে চিকিৎসকদের চিকিৎসা সেবা ও শিক্ষা প্রদানে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। এতে ভাল চিকিৎসকও তৈরি হচ্ছে না।

এদিকে চিকিৎসকদের মধ্যে যারা শিক্ষক আছেন, তারাও এখন প্রশাসনে যাচ্ছেন। তদ্বির কিংবা বিভিন্নভাবে তারা এসব পদে যাচ্ছেন। এতে দুই জায়গায়ই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, যতদিন ক্যাডার বৈষম্য থাকবে, এ সমস্যার সমাধান হবে না। এক গ্রুপ হালুয়া-রুটি খাচ্ছে, অন্য গ্রুপ চেয়ে চেয়ে দেখছে। অপরদিকে উপযুক্ত জায়গায় উপযুক্ত চিকিৎসক পদায়ন না করার কারণে রোগীরা সুচিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। একইভাবে ছাত্র-ছাত্রীরা পাচ্ছেন না সুশিক্ষা।

প্রতি বছর দেশে প্রায় ১০ লাখ মানুষ বিভিন্নভাবে অগ্নিদগ্ধ হন। চিকিৎসার সুযোগের তুলনায় এ সংখ্যা অনেক বেশি। সক্ষমতার তুলনায় বেশি রোগী থাকায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ৩০০ শঘ্যার বার্ন ইউনিটে সারাবছরই লেগে থাকতো উপচেপড়া ভিড়।

এতে করে চিকিৎসকরা হিমশিম খেতেন, রোগীরাও পেতেন না উপযুক্ত সেবা, ইউনিটের মেঝেতে আর বারান্দায় গাদাগাদি করে রোগীদের থাকতে হতো। ফলে ছড়িয়ে পড়তো সংক্রমণ। এসব কারণে ঢামেক হাসপাতালের পাশেই নির্মিত হয় ৫০০ বেডের শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট।

কিন্তু এখানেও জনবলের অভাব রয়েছে। সারাদেশে যত বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জন আছেন, তাদের সবাইকে এখানে আনলেও জনবলের ঘাটতি মিটবে না। সারাদেশে ১৫০ জন প্লাস্টিক সার্জন আছেন। এরমধ্যে ৮৭ জন এমএস (প্লাস্টিক সার্জন) ও এফপিএস (প্লাস্টিক সার্জন) অধ্যায়নরত।

শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও সহকারী অধ্যাপক আছেন ৪০ জন। মেডিক্যার অফিসার আছেন ৪৫ জন। ১৫০ প্লাস্টিক সার্জনের মধ্যে ৪০ জনই শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে আছেন। এটি বিশ্বমানের ইনস্টিটিউট। এখানকার চিকিৎসক, শিক্ষক ও নার্স বিশ্বমানের। প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্হা আছে। ৮৭টি প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলমান। রিসার্চ উইংও আছে। বাকি প্লাস্টিক সার্জনরা অন্যান্য সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত।

সম্প্রতি একনেক মিটিংয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকার বাইরে ৫টি বার্ণ ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট স্থাপনের অনুমোদন দিয়েছেন। প্রতিটি ইউনিট হবে ১০০ বেডের। ফরিদপুর, রাজশাহী, সিলেট, বরিশাল ও রংপুরে এই ইউনিট হবে। অত্যাধুনিক ব্যবস্থাপনায় প্রতিটি ইউনিটে ১০ বেডের আইসিইউ থাকবে।

একনেক বৈঠকে এটি অনুমোদনের সময় উপস্থিত ছিলেন শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের প্রধান সমন্বয়কারী ডা. সামান্ত লাল সেন। প্রধানমন্ত্রী ৪৫৬ কোটি ৯৯ লাখ টাকার এই প্রকল্প অনুমোদন দেন।

এরমধ্যে ২১৬ কোটি টাকা সরকার খাত থেকে এবং বাকিটা সৌদি সরকার দেবে। দেশে পোড়া রোগীদের মধ্যে ৯৫ ভাগেরই প্লাস্টিক সার্জারির প্রয়োজন হয়। প্লাস্টিক সার্জনরা সম্প্রতি একটি জরিপ চালিয়ে তথ্য পেয়েছেন যে, দেশে পোড়া রোগীদের মধ্যে ৭৯ ভাগ ঢাকার বাইরে থাকেন। যারা সুচিকিৎসার বাইরেই থাকেন। আর ২১ ভাগ পোড়া রোগী থাকেন ঢাকার আশেপাশে। প্রতি বছর প্রায় ১০ লাখ পোড়া মানুষের মধ্যে বিনা চিকিৎসায় মারা যান ৮ হাজার। শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম বলেন, উপযুক্ত জায়গায় উপযুক্ত মানুষকে রাখতে হবে।

আমাদের ইনস্টিটিউটে পোড়া রোগীরা সুচিকিৎসা পাচ্ছেন। অনেক পোড়া রোগী বেঁচে যাচ্ছেন। প্লাস্টিক সার্জারি অত্যন্ত ব্যয়বহুল। বিদেশে একটি প্লাস্টিক সার্জারি করতে ৩৫ লাখ থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত লাগে। অথচ এই দেশে সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে প্লাস্টিক সার্জারি করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ মেডিক্যাল এসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী দুলাল বলেন, চিকিৎসকদের পদোন্নতির জন্য সিনিয়র স্কেল পরীক্ষা চালু হয়েছে। শিক্ষকরা প্রশাসনের চলে যান। এ কারণে এটা চালু করা হয়েছে। আর যেহেতু ডিপিসি বন্ধ রয়েছে তাই চিকিৎসকদের পদোন্নতিও বন্ধ রয়েছে। পদ খালি আছে। চিকিৎসকদের মধ্যে চরম হতাশা বিরাজ করছে।

এতে সকল মেডিক্যাল কলেজে ছাত্র-ছাত্রীরা সুশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। রোগীরাও সুচিকিৎসার অভাবে মারা যাচ্ছেন। স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এমএ আজিজ বলেন, যতদিন আন্তঃক্যাডার বৈষম্য দূর না হবে ততোদিন চিকিৎসকদের পদোন্নতির অব্যবস্থাপনা থাকবে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশও অনেক সময় বাস্তবায়ন হয় না। সিনিয়র স্কেল পরীক্ষার দরকার ছিল না। এটি চালু করায় দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসকদের পদোন্নতি বন্ধ রয়েছে।

ডিপিসি চালু করতে এখন নীতি-নির্ধারক মহল চাচ্ছে, কিন্তু প্রশাসন চাচ্ছে না। ১০ বছর ধরে পদ শূন্য। এটা যেন দেখার কেউ নেই। ৪ থেকে ৫ বছর আগে ডিপিসিতে পদোন্নতি হয়েছিল। এরপর আর হয়নি। এতে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েও অনেকে মেডিক্যাল অফিসার পদে চাকরি করছেন। চলতি দায়িত্ব দিয়েও শূন্য পদ পূরণ করা গেলেও তা করা হচ্ছে না।

ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, উপযুক্ত জায়গায় উপযুক্ত লোক পদায়ন না করলে চিকিৎসা শিক্ষায় সমস্যা বাড়তেই থাকবে। 

ইত্তেফাক/এএএম