লোকসাহিত্যের বিভিন্ন উপাদান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় সেখানে একটা বড় অংশ জুড়ে আছে নারী। যুগ যুগ ধরে সমাজে নারীর যে অবস্থান তা কখনোই সমাধিকারের ভিত্তিতে মর্যাদার আসনে নয়। নারী সব সময় তার অধিকার থেকে বঞ্চিত। নারীর ব্যক্তিত্ব মেধা ও মানসিক সৌন্দর্যের কখনো প্রকৃত মূল্যায়ন হয়নি। সংসারে নারী একজন সন্তান উত্পাদনের মেশিন, সারা জীবনের বেগারখাটা শ্রমিক আর সবার অবহেলা নিপীড়ন নির্যাতনের শিকার। সংসারে পদে পদে মেয়েদের জন্য আছে বাধা প্রতিবন্ধকতা। সৃষ্টি হয়েছে নানারকম বিধি আর সামাজিক অনুশাসন। অন্যদিকে সংসারের সমস্যা, ক্ষতি, আকস্মিক বিপদাপদ বা দৈব-দুর্বিপাক ইত্যাদির জন্যও দায়ী করা হয় নারীকেই। নারীকে ভাবা হয় সমস্ত অমঙ্গল আর অকল্যাণের হোতা। একটি মেয়ের বিয়ের পরে সংসারের উন্নতি না হয়ে অধোগতি হলে, শ্বশুরবাড়িতে কোনো বিপদ ঘটলে, স্বামী সন্তানের মৃতু্য বা কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে, সব কিছুর জন্য দায়ী করা হয় মেয়েটিকে। অপয়া বলে তাকে অপবাদ দেওয়া হয়। এই মানসিকতার পেছনে অশিক্ষা অজ্ঞতা অন্যতম কারণ হলেও পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গিই মূলত দায়ী। তাই নারীর জন্য বরাদ্দ থাকে যত রকম অত্যাচার-অবিচার, বঞ্চনা-লাঞ্ছনা, অবজ্ঞা আর অবমাননা। তাদের জন্য তৈরি হয় অজস্র বিধিনিষেধ। সুকৌশলে নানারকম অনুশাসনের মধ্য দিয়ে নারীর জন্য কম খাওয়া, কম পরা, সংসারের সেবায় নিজেকে উজাড় করে দেওয়া, নিজের সাধ আহ্লাদ বিসর্জন দেওয়া—ইত্যাদিকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। যুগ যুগ ধরে এসব বিধিনিষেধের বেড়াজালে আবদ্ধ নারীর গণ্ডিবদ্ধ পৃথিবী আর বঞ্চিত জীবনের পরিচয় পাওয়া যায় লোকসাহিত্যের প্রবাদ প্রবচন ছড়া লোকবিশ্বাস ইত্যাদির মধ্যে। এগুলোর মধ্যে অনেকই আছে আপাতদৃষ্টিতে বিনোদনমূলক, কৌতুককর, হাস্যকর, কিন্তু তার অন্তরালে আছে মেয়েদের অবজ্ঞেয় অবহেলিত জীবনের মর্মস্পর্শী ছবি। এসব প্রবাদ হয়তো পুরাকালে বিদুষী খনা-র মতো আরো কোনো মেধাবী নারীর দ্বারাই রচিত হয়েছে। তাই এসব রচনায় নারীজীবনের বঞ্চনা হতাশা অন্তঃসারশূন্যতাকে প্রকট হয়ে উঠতে দেখা যায়। এমন কিছু প্রবাদপ্রবচনের অন্তর্গত চিত্রের দিকে চোখ ফেরানো যাক। শুধু চোখ নয়, নয়ন-মন-দর্শন এই তিনকে একত্র করেই দেখতে হবে এসব আপাত সরল কৌতুকময় প্রবাদ বচনকে।
বুলবুলি লো খালা
একটা বড়ই হালা
তর ঘরে মাইয়া অইলে
দিমু দুগ্যা মালা।
বৈষম্যমূলক সমাজে মেয়েদের মূল্য নেই, তা-ই পরিবারে মেয়ে সন্তান অনাকাঙ্ক্ষিত। কন্যাসন্তান জন্ম দেওয়া নারীর জন্য কোনো আদর ভালোবাসা থাকে না। এই বেদনার দিকটিই ওপরের ছড়ার মধ্যে আছে। গ্রামের বালক-বালিকারা যখন বড়ই তলায় দাঁড়িয়ে গাছের ওপর পাকা বড়ই ঠুকরে খাওয়া বুলবুলির দিকে তাকিয়ে মজা করে এ ছড়াটি বলে, তখন হয়তো ছোট বলে তারা ব্যাপারটা বোঝে না, তবে এর মধ্যে কন্যা সন্তানের প্রতি অবহেলার যে চিত্র আছে তা কিন্তু স্পষ্টই বোঝা যায়। হয়তো কোনো সুদূর অতীতে কোনো মেয়েই এ ছড়ার রচয়িতা। কন্যাসন্তান জন্ম দেওয়া জননীকে অনেক সময় সংসার থেকে বিতাড়িত হতে হয়, এ ব্যাপারটি তাকে দুঃখিত করেছিল, তাই হয়তো সদ্যপ্রসূত কন্যার জননীকে অভিনন্দন জানাতে মালা দিয়ে বরণ করে নেওয়ার সুপ্ত বাসনা থেকে এ ছড়া মুখে মুখে বেঁধেছিল।
হোনছনি গো কন্যার মা
কইলে বিশ্বাস যাইবা না
আষ্ট পয়সায় দুই আনা!
আঁতুড় ঘর আর রান্নাঘরই নারীর পৃথিবী। বাইরের জগতের কোনো খবরই তার কাছে আসে না। বহিরাঙ্গনের সঙ্গে নারীর কোনো যোগ নেই। রাজনীতি অর্থনীতি শিক্ষাদীক্ষা ব্যবসাবাণিজ্য যুদ্ধবিগ্রহ উত্সব বিনোদন কোনো কিছুর সঙ্গেই গ্রামীণ নারীর কোনো সম্পর্ক নেই। কোথায় কী ঘটছে কিছুই সে জানে না। তাই পয়সা থেকে আনার হিসেব তার কাছে অচেনা, আট পয়সায় দুআনার হিসেবও তার কাছে অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়। আর এই অবিশ্বাস্য সংবাদটি সে আর এক নারীকে শোনাচ্ছে। কারণ ঐ নারীও তারই মতন, গণ্ডিবদ্ধ জীবনের দোসর!
বাপ গড়িল ঝি
স্যায় (সে) হয় ভাইগন্িত।
এ প্রবাদটির অর্থ, মেয়ের চেহারা বাবার মতো হলে ভাগ্যবতী হয়। প্রকৃতপক্ষে পিতৃতান্ত্রিক সমাজের নিগূঢ় মনস্তত্ত্ব এখানে কাজ করে। নিজের চেহারার সঙ্গে মিল আছে বলে বাবাও সে মেয়েটির প্রতি যত্নবান হন। তার মেধা প্রতিভার বিকাশ ঘটে, ভবিষ্যত্ জীবন সুন্দর করার প্রচেষ্টা থাকে। মেয়েদের সৌভাগ্যের কারণ হিসেবে মেয়েদের যোগ্যতা স্বীকৃতি পায় না। বাবার মতো চেহারাটিই স্বীকৃতি পায়।
খা লো মাগি খা
পোলাপাইন অওনের আগে খা
ফিন লো মাগি ফিন
পোলাপাইন অওনের আগে ফিন।
এটি একটি প্রবচন, যার অর্থ : মেয়েদের খাওয়া পরার সময় সন্তান জন্মের আগ পর্যন্তই থাকে, এর পরে আর থাকে না। কী গ্রাম, কী শহর, কী অতীত, কী বর্তমান সব ক্ষেত্রেই নারীজীবনে মায়ের ভূমিকা প্রচণ্ড কষ্টের। একজন মেয়ে বিয়ের পরে সন্তানের জননী হবে, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু এ দেশে সন্তান লালনপালনের কষ্টকর দায়িত্বগুলো মাকেই পালন করতে হয়। বাচ্চার জন্মের পরে একজন নারীর মা ছাড়া আর কোনো পরিচয় থাকে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারীকে নিজের খাওয়া-পরা-সাধ-আহ্লাদ বিসর্জন দিতে হয়। তাকে সারাক্ষণই সন্তানের দেখাশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়। তাই ছদ্ম তিরস্কারের ভঙ্গিতে বলা হয়েছে, যা কিছু খাওয়া-পরার সাধ তা ছেলেপুলে হবার আগেই পূরণ করে নাও গো মেয়ে!
শ্বশুর বাড়িতে বধূর প্রতি অত্যাচার নির্যাতন বহু প্রাচীনকাল থেকেই চলে এসেছে। আর এই নির্যাতনকারিণী হিসেবেও শাশুড়ি ননদীকেই দেখা যায়। কারণ শাশুড়ি যখন বধূ ছিলেন তিনিও নির্যাতিত হয়েছেন, তাঁর জীবনের গল্প জেনে যায় মেয়ে। ফলে নিজের পরিবারের পুত্রবধূ বা ভ্রাতৃবধূর প্রতি এক ধরনের অমীমাংসিত ঈর্ষা তৈরি হয়। এভাবে নারী মানসে সংকীর্ণতার বীজ উপ্ত হয়ে যায়। শ্বশুর বাড়িতে বধূ অত্যাচারিত হবে কিংবা শ্বশুর বাড়ি মেয়েদের জন্য একটি ভীতিকর জায়গা এমন ধারণা ও সংস্কৃতি তৈরি হয়ে যায়। লোকজ প্রবাদে তার ছায়াপাত ঘটে। এমন কয়েকটি প্রবাদ-প্রবচন :
ইচা, কোটলে হয় মিছা
রানলে দেয় ঠৌরা
খাইয়ালায় বৌরা।
এ প্রবচন অর্থ : চিংড়ি মাছের কোনো আয়বরকত নেই। এ মাছ দেখতে যতটুকু লাগে, কোটাবাছা করলে তা অনেক কমে আসে। কিন্তু প্রাবচনিক অর্থের আড়ালে আছে ক্ষুধার্ত বধূর করুণ গল্প। শ্বশুর বাড়িতে বধূরা সারা দিন গাধার খাটুনি খাটে কিন্তু তারা প্রয়োজনীয় খাবার পায় না। ক্ষুধার্তই থেকে যায়। তাড়াতাড়ি সেদ্ধ হয় বলে ক্ষুধার্ত বধূরা হেঁশেলে বসেই গোপনে আধ সেদ্ধ চিংড়ি খেয়ে নেয়।
হরি এমুন ধুতের ধুত
কাডি মাইপ্যা থোয় দুদ
বউ এমুন ধুতের ধুত
পানি মিশায়া খায় দুদ।
এ প্রবাদটিও ক্ষুধার্ত বধূদের নিয়ে। প্রবাদ অর্থ : শঠে শ্যাঠ্যাং। কিন্তু তার পেছনের গল্প করুণ রসের। কৃপণ শাশুড়ি বউকে দুধ খেতে দেয় না। সে হাঁড়িতে কাঠি ডুবিয়ে দুধ মেপে রাখে। যাতে বধূ যদি লুকিয়ে দুধ খায় তো ধরা পড়ে যাবে। তবে ধূর্ত শাশুড়ির চেয়ে বধূও কম চালাক না, সে চুরি করে দুধ খেয়ে পানি মিশিয়ে পরিমাণ ঠিক রাখে। পরিস্হিতি মানুষকে কৌশলী করে তোলে। শ্বশুরবাড়িতে ক্ষুধার্ত বধূর চিত্র আছে আরো প্রবাদে। যেমন :
এক বউ আনলাম চাউল চাবায়
আর এক বউ আনলাম তো ধানে চাউলেই খায়।
আপাতদৃষ্টিতে এ প্রবাদে বধূদের ছোঁচা স্বভাবের ইঙ্গিত করে তাদের নিন্দামন্দ করা হয়েছে। কিন্তু এর অন্তরালেও আছে শ্বশুরবাড়িতে ক্ষুধার্ত বধূদের দিনযাপনের ট্র্যাজেডি। বউরা দিনমান খাটুনি খাটবে, কিন্তু তাদের খাওয়ার কথা কেউ ভাববে না, তাদের জন্য সময়মতো খাওয়া তো থাকবেই না আবার বউদের জন্য খাওয়ার পরিমাণও থাকবে কম, মানও থাকবে খারাপ। যত হাঁড়িচাছা, পচা-পানতা, পোড়া, ফ্যালনা জিনিস তাদের খেতে হবে। ফলে বউরা বেশির ভাগই ক্ষুধার্ত থাকে। পরিশ্রমের ফলে ক্ষুধাও লাগে। তখন খাবার না জুটলে হয়তো লুকিয়ে কেউ কাঁচা চালই চিবিয়ে খায়, চাল না পেলে ক্ষুধায় কাতর হয়ে ধান চিবিয়েও চাল বের করে খায়। আর সেটা যদি শ্বশুর-শাশুড়ি বা এ স্হানীয় কারো চোখে পড়ে যায় তখন তাদেরকে ছোঁচা, আখাউক্কা ইত্যাদি নিন্দামন্দ শুনতে হয়।
জিঙ্গইলে আনে চুলার মোখ
হরি আনে বউয়ের মোখ।
এ প্রবাদটি যেন আগের প্রবাদটির ধারাবাহিক রূপ। প্রবাদ অর্থ : ক্রমাগত নির্যাতনে মানুষ এক সময় প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। বিষয়টি চমত্কার তুলনার মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। গ্রামীণ নারীরা রান্না করার সময়ে জ্বালানি হিসেবে ‘জিঙ্গইল’ ব্যবহার করেন। জিঙ্গইল হলো বাঁশের শাখাপ্রশাখা। এগুলো অনেক গিঁট ও শক্ত ডালপালাযুক্ত ঝাঁকড়া ধরনের হয়। ভাঙা কঠিন। রান্না করার সময় চুলোর মুখে সহজে ঢুকতে চায় না, জোর করে ঢুকিয়ে দিতে হয়, ফলে কিছু দিন পরে চুলার মুখটি ভেঙেচুরে বড় হয়ে যায়। তেমনি শাশুড়ি যদি ক্রমাগত বধূর সমালোচনা বা নিন্দা করে কথা শোনাতে থাকে এক সময় বধূরও সাহস বেড়ে যায়, সেও শাশুড়িকে কথা শোনাতে ছাড়ে না।
মেয়েদের জন্য আছে সহস্র ‘নেই’ বা ‘না’। লোকবিশ্বাস বা সংস্কারগুলোর মধ্যে এই ‘নেই’ বা ‘না’গুলো দেখতে পাই। মেয়েদের স্বামীর আগে খেতে নেই, দুপদাপ শব্দ করে জোরে হাঁটতে নেই, গলা তুলে কথা বলতে নেই, ঢক ঢক করে পানি খেতে নেই, ঋতুমতী অবস্হায় আচার, পিঠা ইত্যাদি বানাতে নেই, লাল টিপ দিতে নেই, স্বামী ভাসুর শ্বশুরের নাম মুখে নিতে নেই, বিধবা হলে তার কোনো স্ত্রী-আচারে অংশগ্রহণ করতে নেই, বন্ধ্যা হলে তার কোনো কল্যাণকর কাজে অংশগ্রহণ করতে নেই—এ রকম হাজারো নিষেধ। এসব নিষেধাজ্ঞা গ্রামবাংলার লোকমানসে গভীরভাবে শেকড় বিস্তার করে আছে। শুধু প্রবাদ-প্রবচন বা লোকবিশ্বাসই নয় অজস্র লোকগল্প, ছড়া, উপকথা, গীত, পাঁচালির মধ্যে ছড়িয়ে রয়েছে নারী জীবনের এই দুঃখগাথা। বলা যায়, লোকসাহিত্যের নকশিকাঁথায় নারীজীবনের দুঃখের সঁুইসুতোর ফোঁড়ে ফোঁড়ে বুনন করা হয়েছে অজস্র ছবি।
প্রবাদ-প্রবচনগুলো বিক্রমপুর অঞ্চলের।
মুন্সীগঞ্জ জেলার কেওয়ারে পিতৃভূমি হলেও ঝর্না রহমান জন্মগ্রহণ করেন ১৯৬৯ সালের ২৮ জুন ঢাকায়। দেশের এই গুণী লেখক অধ্যাপনা পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন। তার রচিত উপন্যাস পিতলের চাঁদ, ভাঙতে থাকা ভূগোল পাঠকসমাদৃত। তার রচিত বেশ কয়েকটি গল্পগ্রম্হ, নাটক, কিশোর উপন্যাস এবং অনুবাদ রয়েছে। তিনি অনন্যা সাহিত্য পুরস্কারসহ বেশ কয়েকটি পুরস্কার লাভ করেছেন।