বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

বিশ্বে সবাই ঝাঁকের কই 

আপডেট : ৩১ ডিসেম্বর ২০২১, ০৯:৫৪

আ হা নতুন বছর! আমাদের তো দুটি নববর্ষ। একটি বঙ্গাব্দ, আরেকটি খ্রিষ্টাব্দ। সারা বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে আমাদের ব্যবহারিক জীবনের সবকিছুতে খ্রিষ্টাব্দই শেষ কথা। আর বাংলা তারিখের কথা যদি কাউকে জিজ্ঞেস করা যায়, তাহলে তাকে সেদিনের পত্রিকার পাতায় চোখ বুলিয়ে কিংবা ইন্টারনেটে সার্চ করে জেনে নিতে হবে বঙ্গাব্দের তারিখটি কত।

এটাই স্বাভাবিক। ঐতিহ্যের অংশ হলেও বাংলা সন আমাদের ব্যবহারিক জীবনে বিশেষ কোনো কাজেই লাগে না। এর চেয়ে বরং বেশি কাজে লাগে হিজরি সন, মুসলিম উৎসব-অনুষ্ঠানের জন্য। বাঙালি হিন্দুদের পূজা-পার্বণের জন্য বঙ্গাব্দ কাজে লাগে বটে, তবে সেটা বাংলাদেশের সংস্কারকৃত বাংলা পঞ্জিকা নয়, পশ্চিমবঙ্গের আবহমান কালের প্রচলিত বাংলা পঞ্জিকা।

হিন্দুদের উৎসব-পার্বণের তিথি-নক্ষত্রের হিসাব অনুযায়ী কোনো কোনো বাংলা মাস ৩২ দিনেও হতে পারে। কোন মাসটি ৩০ হবে বা ৩১ কিংবা ৩২ অথবা ২৯ দিনের হবে, সেটা পুরোটা নির্ভর করে ঐ বৎসরের তিথি-নক্ষত্রের হিসাব অনুযায়ী। কিন্তু বাংলাদেশের আধুনিক বাংলা সনটি এখন প্রথম পাঁচটি মাস ৩১ দিনে এবং লিপইয়ার বা অধিবর্ষে চৈত্র মাস ৩১ দিনের হিসেবে সাজানো হয়েছে। বাকি মাসগুলো ৩০ দিনের। খ্রিষ্টাব্দের মতো বাংলাদেশের বঙ্গাব্দকে হালনাগাদ করা হলেও নববর্ষ বাদে বাংলা সনের বিশেষ কোনো ব্যবহারিক দিন এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের বঙ্গাব্দের নেই।

এদিকে খ্রিষ্টাব্দ, যেটাকে ভুল করে অনেকেই ‘ইংরেজি সন’ বলে উল্লেখ করেন, এর ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে যিশুখ্রিষ্টের জন্ম। যিশুখ্রিষ্ট যদি বেঁচে থাকতেন, তাহলে আজ তাঁর বয়স হতো ২০২২ বছর। এখন প্রশ্ন আসতে পারে, খ্রিষ্টের জন্ম থেকেই যদি খ্রিষ্টাব্দ হয়, তাহলে তো যিশুর জন্মদিন তথা বড়দিন হওয়া উচিত পয়লা জানুয়ারিতে। সেটা তো হয় না, কেন পয়লা জানুয়ারির ছয় দিন আগে, অর্থাৎ ২৫ ডিসেম্বর যিশুর জন্মদিন পালন করা হয়? খ্রিষ্টাব্দের ইতিহাসটি বেশ চমকপ্রদ। খ্রিষ্টাব্দের বারোটি মাসের নামকরণের ছত্রে ছত্রে বিচিত্র কাহিনী আছে। খ্রিষ্টের জন্মের আগে রোমানরা একপ্রকার ক্যালেন্ডার ব্যবহার করত।

মনে করা হয়, রোমান সম্রাট রোমুলাস ৭৩৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে এই ক্যালেন্ডার চালু করেন। এতে থাকত দশটি মাস, যার শুরু মার্চ মাসে আর শেষ ডিসেম্বরে। সেই হিসাবে সাতে সেপ্টেম্বর, আটে অক্টোবর, নয়ে নভেম্বর আর দশে ডিসেম্বর। ছয়ে ছিল সেক্সটিলিস, আর পাঁচে কুইন্টিলিস, যে দুটো মাসকে এখন আমরা অগাস্ট আর জুলাই নামে চিনি। জুন মাসের নামকরণ হয়েছে রোমান দেবতা জুপিটারের স্ত্রী জুনোর নামে, মে হয়েছে ‘মেইয়া’, এপ্রিল ‘আফ্রোদিতি’ আর মার্চ যুদ্ধের দেবতা মার্সের নামে।

রোমানদের দশ মাসের বছরে ছিল মোট তিন শ চার দিন। স্বভাবতই এই ক্যালেন্ডার অনুসরণ করে চাষবাস, পালাপার্বণ কিছুই ঠিকমতো করা যেত না। তার ওপর রাজা-মহারাজারা ইচ্ছাখুশি ক্যালেন্ডারে দিন-টিন বাড়িয়ে কমিয়ে দিতেন। পরবর্তীকালে সম্রাট নুমা রোমানদের দশ মাসের সঙ্গে আরো দুটি মাস জানুয়ারি আর ফেব্রুয়ারি যোগ করেন। বাইশ দিনের একটি তেরোতম মাসও সে সময় ক্যালেন্ডারে এসেছিল, যেটি এক বছর অন্তর অন্তর ক্যালেন্ডারে জায়গা পেত। মাসটির নাম ছিল মার্সিডানাস।

সম্রাট জুলিয়াস সিজার সৌরবর্ষ অনুযায়ী তাঁর রাজ্যে তিন শ সাড়ে পঁয়ষট্টি দিনে সৌরবত্সর ক্যালেন্ডার চালু করে জানুয়ারি আর ফেব্রুয়ারি এই দুটি মাসকে বছরের শুরুতে নিয়ে আসেন। জুলিয়াস সিজারের নামে এই ক্যালেন্ডার ‘জুলিয়ান ক্যালেন্ডার’ নামে পরিচিত হয়। কিন্তু তখন খ্রিষ্টই নেই; তাই খ্রিষ্টাব্দও নেই। সম্রাট জুলিয়াস সিজার তাঁর জন্মমাস কুইন্টিলিসের নাম পরবর্তন করে ‘জুলাই’ করেন।

শুধু তাই নয়, ফেব্র‚য়ারি মাস থেকে এক দিন কেটে জুলাই মাসে এক দিন যোগ করে দেন। একই কাজ করেছেন রোমান সম্রাট অগাস্টাস। তিনি সেক্সটিলিসকে অগাস্ট নামকরণ করেন এবং ফেব্রুয়ারি থেকে একটি দিন কেটে নিয়ে মোট ৩১ দিন করেন। অন্যদিকে ফেব্রুয়ারির দিনসংখ্যা কমে দাঁড়ায় ২৮-এ (লিপইয়ারে কেবল ২৯ দিন হয়)।

২১ মার্চ হলো মহাবিষুব, তার চার দিন পর অর্থাত্ ২৫ শে মার্চ খ্রিস্টানদের একটি অতি পবিত্র দিন। ঐ দিন গ্যাব্রিয়েল মেরিকে দর্শন দিয়ে যিশুর আগমনের সুসমাচার দিয়েছিল। আর ২১ শে মার্চ থেকে নয় মাস পরে অর্থাৎ ২৫ শে ডিসেম্বর দিনটিকে যিশুর জন্মদিন ধরা হয়। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে পোপ গ্রেগরি লক্ষ করলেন, জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে মহাবিষুবের তারিখ হচ্ছে ১০ মার্চ অর্থাৎ জুলিয়ান ক্যালেন্ডার ১১ দিন পিছিয়ে পড়েছে। তিনিই জ্যোতির্বিদের সঙ্গে পরামর্শ করে ক্যালেন্ডারে ১১ দিন যোগ করেন, লিপ ইয়ারের নিয়ম চালু করেন।

১৭৫২ খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যান্ড আইন করে জুলিয়ান ক্যালেন্ডার বাতিল করে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার গ্রহণ করে। পরে পৃথিবীর প্রায় সমস্ত দেশই এই ক্যালেন্ডার মেনে চলতে শুরু করে। এদিকে ইস্টার্ন অর্থোডক্সিয়ানরা গ্রেগরের এই সংস্কার মানেনি। তাই ওরা ২৫ ডিসেম্বরের সঙ্গে ১১ দিন যোগ করে ৬ জানুয়ারি বড়দিন পালন করে। বর্তমানে আর্মেনিয়াতে ও আরো কয়েকটি দেশে ৬ জানুয়ারি বড়দিন।

গত দুই-তিন শতক ধরে এই বিশ্বের বেশির ভাগ অংশ চালিয়েছে ইউরোপীয় প্রতাপশীল দেশগুলো। এর মধ্যে সবচাইতে বেশি প্রভাব ছিল ব্রিটিশ তথা ইংরেজদের। তাদের তৈরি করা বেশির ভাগ নিয়মনীতিই চলছে বিশ্বে। ইংরেজদের ইংরেজি ভাষা, তাদের আইন, তাদের সংস্কারকৃত ক্যালেন্ডার এখন সারা বিশ্ব মেনে নিয়েছে। বিশ্বায়নের যুগে সবাইকে ঝাঁকের কই হতেই হয়। আর আমরা তো এমনিতেই ব্রিটিশদের একটি কলোনি ছিলাম।

যাই হোক, শেষ করি শিবরামের সরস বচন দিয়ে। তিনি বলেছেন—‘নতুন বছর, নতুন বছর বলে হৈচৈ করার কিছু নেই। যখনই কোনো নতুন বছর এসেছে, সেটা এক বছরের বেশি টেকেনি!’ বিদায় ২০২১! শুভ হোক ২০২২। 

ইত্তেফাক/এএএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন