দেশে ১৫ সপ্তাহ পর নমুনা বিবেচনায় কোভিড শনাক্তের হার ৫ শতাংশে উন্নীত হওয়ার পরদিন গতকাল তা পৌনে ৬ শতাংশ ছাড়িয়ে গেল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গতকাল শনিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় দেশে ১৯ হাজার ২৭৫টি নমুনা পরীক্ষা করে ১ হাজার ১১৬ জনের কোভিড রোগী শনাক্তের কথা জানায়। তাতে নমুনা পরীক্ষার বিবেচনায় শনাক্তের হার দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৭৯ শতাংশ।
করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন দ্রুত সংক্রমিত করে। কেউ আক্রান্ত হলে তার পরিবারের সবাই আক্রান্ত হচ্ছে। ইতোমধ্যে পরিবারসহ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন অনেক চিকিৎসক। এ কারণে আইসিইউতে দায়িত্ব পালনে অনীহা প্রকাশ করছেন চিকিৎসকরা।
করোনা ওয়ার্ডেও দায়িত্ব পালনে অপারগতা প্রকাশ করে তার যুক্তি তুলে ধরে চিকিৎসকরা বলেন, সঠিক ব্যবস্থাপনা না থাকার কারণে চিকিৎসক-নার্সসহ স্বাস্থ্য সেবা কর্মীদের ‘বলির পাঁঠা’ বানানো হচ্ছে। আগে করোনা রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিতে গিয়ে পরিবার থেকে আলাদা থাকতাম। এখন পরিবারের সঙ্গেই থাকতে হবে। এ কারণে চিকিৎসকরা নিজেরা যেমন আক্রান্ত হচ্ছে, তেমনি পরিবারকেও বিপদের মধ্যে পড়তে হচ্ছে। ভাইরাসটি নিয়ন্ত্রণে সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছে ১৬ দফা নির্দেশনা। কিন্তু এই ১৬ দফা নির্দেশনা উপেক্ষিত। অনেকে মাস্ক পরছেন না, স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। তাই সরকারের ১৬ দফা বাস্তবায়নে আগামী দুই একদিনের মধ্যে বিধিনিষেধের প্রজ্ঞাপনে আসছে পারে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
গতকাল সাটুরিয়া উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানের তিনি আরও বলেন, করোনা সংক্রমণ যেভাবে বাড়ছে, স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়ে আমরা কঠোরতা অবলম্বন করবো। মাস্ক ছাড়া বের হলে জেল-জরিমানা করা হবে।
এদিকে গত তিন সপ্তাহ ধরে দেশে করোনা রোগী বৃদ্ধি পাওয়ায় ইতোমধ্যে প্রতিটি হাসপাতালে দ্বিগুণ হারে রোগী বেড়েছে। আইসিইউতেও রোগী বেড়েছে।
দেশে যেকোনো মুহূর্তে করোনা ব্যাপক হারে আঘাত হানতে পারে বলে আশংকা প্রকাশ করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, মহামারি করোনা ভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দ্রুতগতিতে ছড়াচ্ছে। ভ্যারিয়েন্টটি ইতিমধ্যে বাংলাদেশেও শনাক্ত হয়েছে। যেহেতু ওমিক্রনের উপসর্গ মৃদু, এ কারণে অনেকে সঠিক ব্যবস্থাপনায় না থেকে দ্রুত অন্যদের সংক্রমিত করছে। ওমিক্রনে আক্রান্ত রোগীর পরিবারের সবাই দ্রুত সংক্রমিত হচ্ছে। তাই স্বাস্থ্যবিধি না মানলে সামনে ভয়াবহ বিপদ অপেক্ষা করছে। উন্নত স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া দেশগুলোই করোনা সংকট মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছে। সেখানে নাজুক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বাংলাদেশে ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’ এর মত চিকিৎসদের ওপর সব দোষ চাপানো হচ্ছে বলে দাবি সরকারি-বেসরকারি চিকিৎসকদের।
বাংলাদেশ সোসাইটি অব অ্যানেসথেসিওলজিস্টের সভাপতি অধ্যাপক ডা. দেবব্রত বণিক বলেন, হাসপাতালে আইসিইউতে রোগী বাড়ছে প্রতিদিন। সাধারণ ওয়ার্ডেও রোগী বাড়ছে। আগে যেখানে অস্থায়ী আইসিইউ ছিল সেগুলো গুছিয়ে রাখা হয়েছিল, এখন আবার তা চালু করা হচ্ছে। কিন্তু চালু করা যাচ্ছে না। যেভাবে সংক্রমণ বাড়ছে তাতে চিকিৎসকরা ক্লান্ত।
অনেক ডাক্তার বলেছেন, আর কত, পারছি না। আগে আমরা থাকতাম আলাদা। এখন পরিবারের সঙ্গে থাকি। ইতোমধ্যে অনেকেই পরিবারসহ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এ কারণে আইসিইউতে চিকিৎসকরা দায়িত্ব পালনে অনীহা প্রকাশ করেছেন। অনেকে কোভিড ওয়ার্ডেও দায়িত্ব পালনে অনীহা করছেন। এমনিতেই চাহিদার তুলনায় দেশে ডাক্তার-নার্স সংকট। আর করোনা রোগীদের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা যে জটিল তা স্বচক্ষে কেউ না দেখলে বুঝতে পারবে না। মাত্রারিক্তি চাপ কিভাবে সামলাবে চিকিৎসকরা। কর্তব্যরত ডাক্তাররা বিভাগের প্রধানকে দায়িত্ব পালনে অনীহার কথা জানিয়ে দিয়েছেন।
অধ্যাপক ডা. দেবব্রত বণিক বলেন, ওমিক্রনের উপসর্গ হালকা। তাই কেউ গরজ করে না। আর এতে আক্রান্ত ব্যক্তি দ্রুত অন্যকে সংক্রমিত করে।
শুক্রবার ২০ হাজারের বেশি নমুনা পরীক্ষা করে ১ হাজার ১৪৬ জনের কোভিড রোগী শনাক্ত হয়েছিল। তাতে শনাক্তের হার ছিল ৫ দশমিক ৬৭ শতাংশ। দেশে গতকাল পর্যন্ত কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা ১৫ লাখ ৯২ হাজার ২০৯ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় মৃত্যু হয়েছে একজনের। তা নিয়ে মৃতের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২৮ হাজার ৯৯।
সরকারি হিসাবে গত এক দিনে দেশে করোনা থেকে সেরে উঠেছেন ১৫৪ জন। তাদের নিয়ে এ পর্যন্ত ১৫ লাখ ৫০ হাজার ৬৮৮ জন সুস্থ হয়ে উঠলেন। দেশে করোনা ভাইরাসের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের দাপটের সময় গত বছর জুলাই-আগস্ট সময়ে দৈনিক শনাক্তের হার ৩২ শতাংশেও উঠেছিল। এরপর তা নামতে নামতে জুলাই মাসে ২ শতাংশের নিচে চলে আসে।
ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণেই ছিল। কিন্তু এরমধ্যেই বিশ্বে শুরু হয় ওমিক্রনের ত্রাস। ৩ জানুয়ারি দৈনিক শনাক্তের হার ৩ শতাংশ এবং ৫ জানুয়ারি তা ৪ শতাংশ ছাড়ায়। দুই দিনের মাথায় শুক্রবার তা পাঁচ শতাংশের উপরে উঠে যায়। গত এক দিনে শনাক্ত রোগীদের মধ্যে ৯৪৩ জনই ঢাকা বিভাগের বাসিন্দা, যা মোট আক্রান্তের ৮৪ শতাংশের বেশি।
দেশের ৩৯টি জেলায় একদিনে কারও করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়নি। আগের দিন এই সংখ্যা ছিল ২৬। গত একদিনে যে ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে, তার বয়স ছিল ৬১ থেকে ৭০ বছরের মধ্যে, কুমিল্লার একটি সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। দেশে এ পর্যন্ত নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ১ কোটি ১৬ লাখ ৪৯ হাজার ৮১৫টি নমুনা। এ পর্যন্ত নমুনা পরীক্ষা অনুযায়ী শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ। মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ।