বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এবারের শীতকালীন বহিরাঙ্গন প্রশিক্ষণে শত শত স্থানীয় অসহায় ও দুস্থ মানুষের মধ্যে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হয়েছে। ওষুধও দেওয়া হয়েছে বিনামূল্যে।
এবার সেনাবাহিনীর শীতকালীন প্রশিক্ষণে ছিল আসল যুদ্ধের মতো সবকিছু। সব বিভাগীয় পর্যায়েই প্রশিক্ষণ হয়েছে। সেনাবাহিনীর সকল ইনস্টিটিউট প্রশিক্ষণে অংশ নেয়। ফোর্সেস গোল-২০৩০ এর আলোকে সেনাবাহিনীকে বিশ্বমানের ও জনবান্ধব হিসেবে নতুনভাবে প্রস্তুত করা হচ্ছে। এবারের প্রশিক্ষণে সেটাই ফুটে উঠেছে।
বাংলাদেশে ৫০ বছরের ইতিহাসে এবার প্রথম বারের মতো শীতকালীন প্রশিক্ষণে আয়োজন করা হয় লজিস্টিকস এফটিএক্স বা ফিল্ড ট্রেনিং এক্সারসাইজ। যুদ্ধক্ষেত্রে আহতদের চিকিৎসা ও অস্ত্রপচার কীভাবে হবে সেটিও ছিল প্রশিক্ষণে। এজন্য প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের অদূরে জামালপুরের হারিণাকান্ডা স্কুল মাঠে স্থাপন করা হয় অস্থায়ী মেডিক্যাল ক্যাম্প। এটি যুদ্ধ ক্ষেত্রের আদলে করা হয়। তবে প্রশিক্ষণের পাশাপাশি এই ক্যাম্প থেকে স্থানীয় শত শত দুস্থ ও অসহায় রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হয়।
প্রেসার মাপা, হৃদরোগ, বাতজ্বর, ছোটখাট অপারেশনসহ প্রাথমিক সব চিকিৎসার ব্যবস্থা সেখানে ছিল। অনেকে সর্দি, জ্বর ও চর্ম রোগের চিকিৎসা নিয়েছেন। অনেকে বিনামূল্যে ওষুধের পাশাপাশি চশমাও পেয়েছেন। রোগীরা বিনামূল্যে চিকিৎসা ও ওষুধ পেয়ে খুশি। এই ক্যাম্পে ছিল অ্যাম্বুলেন্সও। এলাকার সাধারণ মানুষের মধ্যে যারা গুরুতর অসুস্থ হয়েছিল তাদের বিনামূল্যে ওই অ্যাম্বুলেন্সের মাধ্যমে পার্শ্ববর্তী হাসপাতালে নেওয়া হয়।
৩০ জন রোগীর সঙ্গে কথা হয় ইত্তেফাকের এই প্রতিনিধি। রোগীরা অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আমাদের গর্বের। তার চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন অমায়িক ব্যবহারের মাধ্যমে।
রোগীরা অনেক কথা বলেছেন, কিন্তু চিকিৎসকরা ভালো ব্যবহারের মাধ্যমে সব শুনে চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন। আমরা অনেক খুশি। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সম্পর্কে আহত নারী-পুরুষরা বলেন, তারা যেভাবে চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন, এ যেন তারা আমাদের আপনজন। আমাদের কোন বিরূপ কোন মনোভাব নেই। সেনাবাহিনীর শীতকালীন প্রশিক্ষণে জনসাধারণের কোন ক্ষতি হয়নি। যেসব মানুষের জমি তারা ব্যবহার করেছিল, তাদের ক্ষতিপূরণ দিয়েছে সেনাবাহিনী। এতে এলাকার মানুষ অনেক খুশি।
বৃহস্পতিবার সেনাবাহিনী শীতকালীন বহিরাঙ্গন প্রশিক্ষণ শেষে বাংলাদেশ সেনবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ বলেন, যুদ্ধে আধুনিক সমরাস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে। সমরবিদ্যা পরিবর্তন মোকাবিলার প্রতি অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে নতুন নতুন উপায় উদ্ভাবন করে সক্ষমতা অর্জন করতে চাই। মূল উদ্দেশ্য হলো, ফোর্সেস গোল-২০৩০-এর আলোকে বিশ্বমানের ও জনবান্ধব সেনাবাহিনী গড়ে তোলা। সেনাপ্রধান অস্থায়ী চিকিৎসা ক্যাম্পে আগত রোগীদের খোঁজ-খবর নেন।
বৃহস্পতিবার ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার চেচুয়া বাজার এলাকায় চূড়ান্ত আক্রমণ অনুশীলনের মধ্যদিয়ে শেষ হলো বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৪ সপ্তাহব্যাপী পরিচালিত শীতকালীন প্রশিক্ষণ ২০২১-২০২২ অনুশীলন নবদিগন্ত। সেনাবাহিনীর লজিস্টিক্স স্থাপনাগুলো প্রথমবারের মতো বহিরাঙ্গনে মোতায়েন হয়।
কাজটা চ্যালেঞ্জিং সেনাপ্রধান নিজেই তা স্বীকার করে বলেন, চ্যালেঞ্জটা কী সেটা মাঠে না এলে বুঝতে পারতাম না। লজিস্টিক মুভ করাতে গিয়ে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছি। এতদিন নতুন নতুন সমরাস্ত্রের প্রশিক্ষণ ছিল কাগজে-কলমে। এখন নতুন নতুন অস্ত্র মাঠে নিয়ে পরীক্ষা করা হচ্ছে। এতে করে আমাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। নবম পদাতিক ডিভিশন সফলভাবে এ অনুশীলন পরিচালনা করে।
মিডিয়ার সঙ্গে আরও নিবিড় ও বিস্তৃতভাবে কাজ করার লক্ষ্যে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরকে (আইএসপিআর) শক্তিশালী করার চিন্তা আছে কিনা জানতে চাইলে সেনাবাহিনী প্রধান এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ফোর্সেস গোলে আইএসপিআরকে আরও শক্তিশালী করার কথা উল্লেখ আছে। ফলে এমন পরিকল্পনা অবশ্যই আছে।
অপর এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একই সঙ্গে প্রতিরক্ষামন্ত্রীও। তিনি সশস্ত্র বাহিনীকে বিশ্বমানের করতে চেয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যাশা মোতাবেক সেনাবাহিনীর সক্ষমতা বাড়াব। এজন্য নতুন নতুন অস্ত্র মাঠে পরীক্ষা করা হচ্ছে।’ এ সময় তিনি উল্লেখ করেন- যুদ্ধের সময় গণমাধ্যম আমাদের সঙ্গে থাকবে।
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীতে সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণের সক্ষমতা বাড়ানো সংক্রান্ত এক প্রশ্নের উত্তরে সেনাপ্রধান বলেন, বিশ্বে শান্তিরক্ষা বাহিনীতে বাংলাদেশ এক নম্বর অবস্থানে রয়েছে। এ এক নম্বর অবস্থান অটোমেটিক আসেনি। বহু ত্যাগ-তিতিক্ষা এবং কঠোর অনুশীলন করতে হয়েছে। এ অনুশীলনও শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের সহায়ক। কারণ যুদ্ধে যে অস্ত্র ব্যবহার হয় শান্তিরক্ষাতেও একই অস্ত্র ব্যবহার করতে হয়। ফলে দক্ষতা অর্জনে এ অনুশীলনের সরাসরি প্রভাব থাকে। সক্ষমতা ও প্রশিক্ষণের গুরুত্বের কারণে বিদেশে মিশনে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে শান্তিরক্ষায় সমর্থ হচ্ছি। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিশেষ দিক হলো-মানবিক দিক খোলা রেখে আমাদের সৈন্যরা কাজ করেন। নিজে গুলি খান কিন্তু সহজে কাউকে গুলি করেন না। অনেক দেশের সৈন্যদের দেখা যায়-গুলি করতে দ্বিধা করেন না। ট্রিগার হ্যাপি। বাংলাদেশের সৈন্যরা সতর্ক। একজনের প্রাণও যাতে না যায় সেই চেষ্টা আমাদের সব সময় থাকে। এটাই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মূল্যবোধ।
মহড়ায় যুদ্ধকালে বাংকারে স্থাপিত মিডিয়া সেন্টারে রবিবার সামরিক গোয়েন্দা পরিদপ্তরের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মামুন উর রশিদ সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। তিনি বলেন, প্রতি বছর শীতকালীন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বর্ষব্যাপী প্রশিক্ষণের চূড়ান্ত অনুশীলন করা হয়। সেনাবাহিনীর ৫০ বছরপূর্তি উপলক্ষে এবার প্রথমবারের মতো লজিস্টিকস এফটিএক্স বা ফিল্ড ট্রেনিং এক্সারসাইজের আয়োজন করা হয়। এ বছর সেনাবাহিনীর সদর দফতর কমান্ড গ্রুপ এবং সাপোর্ট গ্রুপ এ দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পূর্ণাঙ্গরূপে অনুশীলনে অংশগ্রহণ করেছে।
তিনি আরও বলেন, এ বছর ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্যদিয়ে দেশব্যাপী অনুশীলন হয়েছে। প্রশিক্ষণের পাশাপাশি সম্ভাব্য সব ক্ষেত্রে আমরা জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছি। এ বহিরাঙ্গন প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণের মাধ্যমে সেনাবাহিনীর সক্ষমতা ও পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে বলে আমরা আশাবাদী।