মঙ্গলবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৩, ১৭ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

আমেরিকাকে বদলে দেওয়া এক মানবাধিকার নেতা

আপডেট : ১৭ জানুয়ারি ২০২২, ০১:০৩

যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর জানুয়ারি মাসের তৃতীয় সোমবার মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র দিবস পালন করা হয়। এর ধারাবাহিকতায় ১৭ জানুয়ারি, সোমবার পালিত হবে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র দিবস। বিখ্যাত মানবাধিকার নেতা মার্টিন লুথার কিং সারা জীবন বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে ও কৃষ্ণাঙ্গদের সম-অধিকার আদায়ে লড়াই করে গেছেন। তার নেতৃত্বে আমেরিকায় কালো মানুষ পেয়েছে সাদা মানুষের সমান অধিকার।

কিংবদন্তি নেতা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র ১৯২৯ সালের ১৫ জানুয়ারি আমেরিকার জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের আটলান্টা শহরে এক কৃষ্ণাঙ্গ যাজক পরিবারে জন্ম নেন। মাইকেল কিং সিনিয়র ও আলবার্টা উইলিয়ামস কিংয়ের তিন সন্তানের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়।

প্রথমে তার নাম রাখা হয় মাইকেল কিং জুনিয়র। ১৯৩৪ সালে ছেলের ৬ বছর বয়সে বাবা মাইকেল বিখ্যাত জার্মান সংস্কারক মার্টিন লুথারের নামানুসারে ছেলের নাম রাখেন মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে ১৯৫৫ সালে কিং ডেক্সর্টা অ্যাভিনিউয়ের ব্যাপটিস্ট চার্চের যাজক হিসেবে যোগদান করেন।

এরপর তিনি সরাসরি কৃষ্ণাঙ্গদের আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৫৫ সালে মন্টগোমারিতে শুরু হয় ঐতিহাসিক বাস ধর্মঘট। ঘটনার সূত্রপাত হয় ১৯৫৫ সালের পহেলা ডিসেম্বর, বাসের আসনকে কেন্দ্র করে। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণের অধিকাংশ রাজ্যেই বাসের সামনের দিকে বসার অধিকার ছিল না কালোদের। শ্বেতাঙ্গ উঠলে সংরক্ষিত আসন ছেড়ে দিতে হবে এই নিয়ম মানলেন না কৃষ্ণাঙ্গ নারী রোজা পার্কস। তিনি প্রতিবাদ করলেন। এটা ছিল সরকারি আইনের লঙ্ঘন। রোজাকে থানায় নিয়ে ১০ ডলার জরিমানা করা হয়।

এই ঘটনার প্রতিবাদে লুথার কিং ও অন্য কৃষ্ণাঙ্গ খ্রিস্টান ধর্ম যাজকরা বাস সার্ভিস বর্জনের সিদ্ধান্ত নেন। টানা ৩৮১ দিন নানা প্রতিকূলতার পরেও কৃষ্ণাঙ্গদের সরকারি বাস বয়কট চলতে থাকলে সুপ্রিম কোর্ট বাসের এই বর্ণবিদ্বেষী ব্যবহারকে সংবিধান বিরোধী বলে ঘোষণা করেন। অবশেষে বাসে তাদের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। এ আন্দোলনে জয়ের পর কিংয়ের নাম ছড়িয়ে পরে গোটা আমেরিকায়। তার এই অহিংস আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানাতে এগিয়ে আসেন বহু কৃষ্ণাঙ্গ নেতা।

গোটা আমেরিকা জুড়েই বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জেগে উঠতে থাকে। এর ধারাবাহিকতায় কিং ১৯৬৩ সালে সরকারের নেওয়া বৈষম্যমূলক আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন ঘোষণা করেন। কিং তার অনুসারীদের নিয়ে দুই মাস ধরে আন্দোলন চালিয়ে যান। এর মূল লক্ষ্য ছিল কৃষ্ণাঙ্গদের শ্বেতাঙ্গদের সমান অর্থনৈতিক সুবিধা দিতে হবে, কালোদের সর্বত্র প্রবেশাধিকার থাকতে হবে এবং শিশুশ্রম বন্ধ করতে হবে।

এমনি এক শন্তিপূর্ণ প্রতিবাদ সমাবেশে অ্যালাবামার পুলিশ সমবেত জনতার ওপর দমনমূলক নিপীড়ন চালায়। মার্টিন লুথার কিংসহ আরও অনেকেই সে সময় গ্রেফতার হন। এই ঘটনা ব্যাপক সাড়া জাগায় বিশ্বব্যাপী। এরপর তিনি স্হির করেন দেশ জুড়ে শুরু করবেন ফ্রিডম মার্চ। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শুরু হয় ওয়াশিংটন অভিমুখে পদযাত্রা।

১৯৬৩ সালে ২৭ আগস্ট ওয়াশিংটনের লিঙ্কন মেমোরিয়ালে সমাবেত হয় প্রায় আড়াই লাখের বেশি মানুষ। তাদের সামনে ঐতিহাসিক ভাষণ দিলেন কিং, ‘আমার একটি স্বপ্ন আছে’ (আই হ্যাভ আ ড্রিম)। ভাষণে তিনি বলেন, কীভাবে বর্ণবৈষম্য গোটা জাতিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। তিনি তুলে ধরেন ভবিষ্যতের আমেরিকা নিয়ে তার আশাবাদ। যেখানে সব আমেরিকান হবে সমান। এটাই হবে সত্যিকারের স্বপ্নের আমেরিকা। তার এই বিখ্যাত ভাষণের প্রভাবেই ১৯৬৪ সালে আমেরিকায় নাগরিক অধিকার আইন ও ১৯৬৫ সালে ভোটাধিকার আইন প্রণয়ন করা হয়।

সেই বছর টাইমস পত্রিকা কিংকে বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ হিসেবে ‘ম্যান অব দ্য ইয়ার’ পুরস্কার দেয়। ১৯৬৪ সালে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অবিস্মরণীয় অবদানের জন্য মাত্র ৩৫ বছর বয়সেই শান্তিতে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি। মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র ১৯৬৮ সালের ৪ এপ্রিল টেনেসির মেমফিস শহরে তার হোটেল কক্ষের ব্যালকনিতে দাঁড়ানো অবস্হায় আততায়ীর গুলিতে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে নিহত হন।

যুক্তরাষ্ট্রে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র দিবস পালন করার অনুমোদন পেতেও লেগেছে ১৫ বছর। আমেরিকার রক্ষণশীল ও বর্ণবাদ মনোভাবের শাসকগোষ্ঠী তাকে উগ্রবাদী ও কমিউনিস্ট হিসেবেই অভিহিত করে গেছে বহুকাল। তাই কিংয়ের জন্মদিনকে সরকারি ছুটি হিসেবে পালনের প্রস্তাব নাকচ হয়। অবশেষে ১৯৭৯ সালে লাখ লাখ নাগরিকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দিনটি পালনের আইন পাশ করা হয়।

ইত্তেফাক/টিআর