শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

সংক্রমণ বাড়ছে ব্যাপক হারে

আপডেট : ২৯ জানুয়ারি ২০২২, ০০:৫৯

অধিকাংশ মানুষ স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা না করায় দেশে করোনা সংক্রমণ ব্যাপক হারে বাড়ছে। ওমিক্রনের বিস্তারের মধ্যে একদিনে নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হারে মহামারীকালের সর্বোচ্চ রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। শুক্রবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ৪৬ হাজারের বেশি নমুনা পরীক্ষা করে ১৫ হাজার ৪৪০ জনের মধ্যে সংক্রমণ ধরা পড়েছে। নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার ৩৩ দশমিক ৩৭ শতাংশ। 

শুক্রবার রাজশাহীতে আক্রান্তের হার ছিল ৭৫ শতাংশ। করোনা আক্রান্তের উর্ধ্বমুখী প্রবণতার মধ্যেও মানা হচ্ছে না বিধিনিষেধ। সব জায়গায় বিপুল জনসমাগম যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে শারীরিক দূরত্ব না মানার প্রবণতা। মাস্ক ব্যবহার করছেন না অনেকেই। ওমিক্রনের বিস্তার ঠেকাতে সরকারের ১১ দফা নির্দেশনা কেবল কাগজে-কলমেই। স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে মানুষের মধ্যে যেমন নেই সচেতনতা, তেমনি স্বাস্থ্যবিধি মানাতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসন তেমন ভূমিকা রাখছে না। রাজধানী, শহর কিংবা গ্রাম-সর্বত্রই স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষিত।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, স্বাস্থ্যবিধি না মানলে তার খেসারত দেওয়া লাগবে- এটা আমরা আগেই সতর্ক করেছিলাম। স্বাস্থ্য বিভাগ শুধুমাত্র নির্দেশনা দিতে পারে। আর তা বাস্তবায়ন যারা করছেন না, তাদের কারণে দেশে করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। করোনা নিয়ন্ত্রণ করতে সামনে লকডাউন দেওয়া লাগলে দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে। আর এর দায়ভার যারা সরকারি নির্দেশনা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করেনি তাদের নিতে হবে। বাস্তবায়নে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রশাসনের কর্মকর্তারা আর্থিক সুবিধা নিচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু দায়িত্ব পালন করছেন না। অনেকটা গা-ছাড়া ভাব তাদের। শুধুমাত্র মিডিয়ায় বক্তব্যের মধ্যেই তাদের দায়িত্ব সীমাবদ্ধ। 

নিরাপদ থাকতে টিকা গ্রহণ ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলেন, শুধু মাস্ক ব্যবহার করেই ৯০ ভাগ নিরাপদ থাকা যায়। কিন্তু অনেকেই মাস্ক পরছেন না, স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। অফিস-আদালত, বাজার-ঘাট, যানবাহনে চলাচল, রেস্টুরেন্ট, দোকানপাট, বাস, ট্রেন, মসজিদ- সব জায়গাতেই মাস্ক পরার নির্দেশনা আছে। কিন্তু বাস্তবে তা মানছেন খুব কম লোকই। স্বাস্থ্যবিধির বালাই নেই হোটেল-রেস্তোরাঁগুলোয়। সংক্রমণ যেমন ঊর্ধ্বমুখী, জন সচেতনতা ততোটাই নিম্নমুখী। তাই জনগণকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে বাধ্য করতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মানলে করোনা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। আর স্বাস্থ্যবিধি না মানলে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর বড় প্রভাব পড়বে। ডাক্তার-নার্সদের আক্রান্তের হার দ্বিগুণ হারে বাড়বে। এ কারণে অনেকে চিকিৎসা সেবা পাবে না। বিধিনিষেধ বাস্তবায়নের দায়িত্ব যাদের তাদের অধিকাংশই যথাযথভাবে সেই দায়িত্ব পালন করছেন না। অথচ তারাও কোভিড থেকে নিরাপদ থাকতে পারবেন না। এমন পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, করোনা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে সর্বত্রই গা-ছাড়া ভাব মহাবিপদ ডেকে আনবে। দেশের জন্য এটা হুমকি হবে। তাই জনগণকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। নইলে তারাও নিরাপদ থাকতে পারবে না। মহামারী কাউকেই ছাড়ে না।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বেনজীর আহমেদ বলেন, ওমিক্রনের কারণে বর্তমানে পরিচিত এমন কোন লোক নেই, যার ঘরে করোনা আক্রান্ত রোগী নেই। অর্থাৎ ঘরে ঘরে করোনা রোগী। অতীতে করোনার অন্য কোন ভ্যারিয়েন্টে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়নি। তারপরও জনগণকে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে পারছে না প্রশাসন। এক্ষেত্রে গা-ছাড়া ভাব, মিডিয়াতে বক্তব্য প্রদানের মধ্যেই যেন প্রশাসনের দায়িত্ব সীমাবদ্ধ। অথচ তারা করোনা নিয়ন্ত্রণে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য সরকারের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিচ্ছেন। মনে রাখতে হবে, স্বাস্থ্যবিধি না মানার প্রেক্ষিতে করোনা ব্যাপক হারে বাড়লে দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। যেহেতু মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মানছে না, তাই এখন সরকারের উচিত করোনা টেস্ট বাড়ানো এবং রোগীর সংখ্যার প্রকৃত চিত্র প্রকাশ করা, যাতে জনগণ ভয় পেয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. নাজমুল হক বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মানানোর ব্যাপারটি এককভাবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাজ নয়। সবাইকে সমন্বিতভাবে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে, মানাতে হবে। এক্ষেত্রে সময়মতো ব্যবস্থা নিতে হবে। আগামী মার্চ মাস পর্যন্ত জনগণের মাস্ক পরা শতভাগ নিশ্চিত করা গেলে করোনা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। সবাইকে করোনার পরীক্ষা করাতে এবং টিকা নিতে হবে।

আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এএসএম আলমগীর বলেন, মহামারী নিয়ন্ত্রণ করা একক কোন মন্ত্রণালয়ের কাজ নয়। সকলকে এক সঙ্গে কাজ করতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। এক্ষেত্রে সমাজের সহযোগিতা করতে হবে। ব্যক্তির সহযোগিতা করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলিকেও সঠিক ভূমিকা পালন করতে হবে। অর্থাৎ সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। টিকা নিলে কিংবা না নিলেও স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। এটা হলো সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায়।

গতকাল শুক্রবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ৪৬ হাজারের বেশি নমুনা পরীক্ষা করে ১৫ হাজার ৪৪০ জনের মধ্যে সংক্রমণ ধরা পড়েছে, মৃত্যু হয়েছে ২০ জনের। নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার ৩৩ দশমিক ৩৭ শতাংশ। এর আগে ২০২১ সালের ২৪ জুলাই শনাক্তের হার ছিল ৩২ দশমিক ৫৫ শতাংশ, যা এতদিন সর্বোচ্চ ছিল। তার আগে মহামারীর শুরুতে ২০২০ সালের ৮ মার্চ যখন প্রথম দেশে কোভিড রোগী ধরা পড়ল, সেদিন ৭ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ৩ জনের কোভিড শনাক্তের কথা জানিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। শনাক্তের হার ছিল ৪২ দশমিক ৮৬ শতাংশ। তবে নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা কম হওয়ায় সেটি রেকর্ডে ধরা হয়নি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, গতকালসহ টানা চারদিন দৈনিক ১৫ হাজারের বেশি রোগী শনাক্ত হল। মঙ্গলবার ১৬ হাজার ৬৬ জন রোগী শনাক্তের খবর এসেছিল, যা মহামারীর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। বুধবার ১৫ হাজার ৫২৭ জন এবং বৃহস্পতিবার ১৫ হাজার ৮০৭ জনের শনাক্তের খবর দিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের দাপটের সময়, গত বছরের ২৮ জুলাই ১৬ হাজার ২৩০ জনের সংক্রমণ ধরা পড়েছিল, মহামারীর মধ্যে সেটাই সর্বোচ্চ। নতুন রোগীদের নিয়ে দেশে মোট শনাক্ত কোভিড রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ৬২ হাজার ৭৭১ জনে। এরমধ্যে ২৮ হাজার ৩০৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। 

গত এক দিনে ২০ জনের মৃত্যুর এই সংখ্যা সাড়ে তিন মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। এক দিনে এর চেয়ে বেশি মৃত্যুর খবর এসেছিল সর্বশেষ ৯ অক্টোবর, সেদিন ২১ জনের মৃত্যুর কথা জানিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সরকারি হিসাবে গত এক দিনে দেশে করোনা থেকে সেরে উঠেছেন এক হাজার ৩২৬ জন। তাদের নিয়ে এ পর্যন্ত ১৫ লাখ ৬২ হাজার ৩৬০ জন সুস্থ হয়ে উঠলেন। এই হিসাবে দেশে এখন সক্রিয় কোভিড রোগীর সংখ্যা এক লাখ ৭২ হাজার ১০৩ জন।

ইত্তেফাক/এএইচপি