বাবা সুরেশ চন্দ্র শীলের মৃত্যুর ১০ দিনের মাথায় শোকাবহ পরিবেশে তার পাঁচ ছেলের শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়েছে। শুক্রবার (১২ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী মৃত্যুর চার দিন পর তাদের শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়।
১০ দিনের ব্যবধানে স্বামী ও পাঁচ ছেলে হারিয়ে নির্বাক সুরেশের স্ত্রী মানু রানী শীল (৫০)। শোকের বোঝা বুকে নিয়ে শুক্রবার পাঁচ ছেলের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান সম্পন্ন করেন তিনি। চট্টগ্রামের হাসপাতালের আইসিইউতে সংকটাপন্ন আরেক ছেলে রক্তিম সুশীলের সুস্থতা কামনা করে প্রার্থনা করেন মানু রানী।
গত ৩০ জানুয়ারি বার্ধক্য জনিত রোগে কক্সবাজারের চকরিয়ার হাসিনাপাড়া এলাকার সুরেশ চন্দ্র শীল (৬০) মারা যান। গত ৮ ফেব্রুয়ারি ভোরে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের জন্য সুরেশের সাত ছেলে ও দুই মেয়ে স্থানীয় তিনমাথা এলাকার মন্দিরে যান। সেখান থেকে ৯ ভাইবোন একসঙ্গে বাড়ি ফিরছিলেন। পথে পিকআপের ধাক্কায় ঘটনাস্থলে চার ভাই অনুপম শীল (৪৬), নিরুপম শীল (৪০), দীপক শীল (৩৫), চম্পক শীল (৩০) মারা যান। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মারা যান আরেক ভাই স্মরণ শীল (২৯)।
এ ঘটনায় গুরুতর আহত আরেক ভাই চট্টগ্রাম মহানগরের একটি বেসরকারি হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) আছেন। আরেকজন চিকিৎসাধীন চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। আর তাদের বোন হিরা শীল (৪৫) চকরিয়ার মালুমঘাট খ্রিষ্টান মেমোরিয়াল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
ডুলাহাজার ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হাসানুল ইসলাম আদর বলেন, সকাল থেকে ধর্মীয় রীতিতে আচার অনুষ্ঠান শুরু হয়। শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ হতে এক লাখ টাকা সহযোগিতা দেওয়া হয়েছে। দেওয়া হয়েছে শীতবস্ত্র ও ভোগ্যপণ্যও।
শুক্রবার (১১ ফেব্রুয়ারি) জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদের পক্ষ থেকে নিহত পাঁচ ভাইয়ের পরিবারকে দেখতে যান অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. আমিন আল পারভেজ। এ সময় তিনি শোক সন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের জরুরি ব্যয় নির্বাহের জন্য এক লাখ টাকা, খাদ্য ও শীতবস্ত্র সহায়তা প্রদান করেন। এ সময় চকরিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফজলুল করিম সাঈদী, উপজেলা নির্বাহী অফিসার জেপি দেওয়ান, সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. রাহাতুজ্জামান এবং ডুলাহাজরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাসানুল ইসলাম আদসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন। দুর্ঘটনার পরেরদিন উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ হতে নিহতদের পরিবারকে এক লাখ ২৫ হাজার টাকা সহায়তা দেওয়া হয়েছিল।
চকরিয়ার ডুলাহাজার ইউনিয়নের মালুমঘাট মেমোরিয়াল খ্রিষ্টান হাসপাতালের পাশের গ্রাম হাসিনাপাড়া। বন বিভাগের পরিত্যক্ত ভূমিতে ৩৪টি সনাতন ধর্মাবলম্বী হিন্দু পরিবার এ পাড়ায় বাস করেন। অবসরপ্রাপ্ত স্বাস্থ্য পরিদর্শক সুরেশ চন্দ্রের টিনের আধা পাকা বাড়ি পাড়ার মাঝখানে।
শুক্রবার হাসিনাপাড়া গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, উঠানে টানানো শামিয়ানার নিচে পূজামণ্ডপ। সেখানে চেয়ারে রাখা পাঁচ ভাইয়ের ছবির ওপর ফুলের মালা। পুরোহিত পাশে বসে ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা চালাচ্ছেন। মানু রানী নিহত পাঁচ সন্তানের স্ত্রীদের পূজারস্থলে নিয়ে আসেন। সবার পরনে সাদা শাড়ি।
মণ্ডপের পাশে দাঁড়িয়ে কান্নাকাটি করছিলেন অনুপম শীলের স্ত্রী পপি শীল (৩৫)। পাশে মেয়ে দেবত্রী শীল (১৫)। পপি বলেন, ‘স্বামীর অবর্তমানে দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে কী করবেন, ভেবে পাচ্ছি না। মেয়ে পড়ছে দশম শ্রেণিতে, ছেলে পঞ্চম শ্রেণিতে। তার স্বামী ছিলেন পল্লি চিকিৎসক। লামার আজিজনগর বাজারে তিনি রোগী দেখে সংসার চালাতেন, সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ জোগাতেন। এখন তিনি নেই, ছেলে-মেয়ের লেখাপড়ার খরচ, সংসার চালানোর মতো কোনো সম্বলও তার নেই।’
একই কথা বলেন, নিহত দীপক শীলের স্ত্রী পূজা শীল (২৬) । একমাত্র ছেলে আয়ূশ শীল (৬)। পূজা বলেন, তার স্বামী দীপক সুশীল কাতারপ্রবাসী ছিলেন। সেখানে তার (দীপক) একাধিক দোকান ছিল। বাবার শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে এসে পিকআপের চাপায় মারা গেলেন তিনি। এখন কাতারের দোকানের খবর নেওয়ার লোকও নেই। তার হাতে স্বামীর রেখে যাওয়া কিছুই নেই।’
পূজারস্থলের আরেক পাশে রান্না-বান্নার কাজ শেষে দুপুর থেকে খাওয়ানো হয় লোকজনকে। সবকিছু দিক নির্দেশনা দিচ্ছিলেন মা মানু রানী শীল।
শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে চট্টগ্রামের হাসপাতালের আইসিইউতে সংকটাপন্ন সন্তান রক্তিম সুশীলের সুস্থতা কামনা করে প্রার্থনা করেন মা মানু রানী। ক্ষণে ক্ষণে বলছিলেন, ‘ভগবান, রক্তিমকে ফিরিয়ে দাও। মায়ের কাছে পাঠিয়ে দাও। এ জীবনে আর কত পরীক্ষা নিবা ভগবান। ভগবান পাঁচ ছেলের পরিবর্তে আমাকে উঠিয়ে নিলেই বেশি খুশি হতাম। এত কষ্ট হতো না; আর সহ্য করতে পারছি না। এসব কথার পর কান্নায় ভেঙে পড়েন এ বৃদ্ধা।’
স্বজনরা জানান, হিন্দুধর্মীয় রীতি অনুযায়ী স্বাভাবিক কারও মৃত্যু হলে ১০ দিন পর আর অস্বাভাবিক মৃত্যু হলে ৪ দিনের মাথায় শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান করা হয়। এ কারণে শুক্রবার নিহত পাঁচ ভাইয়ের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান সম্পন্ন করা হয়েছে।
চকরিয়ার মালুমঘাট হাইওয়ে থানার ইনচার্জ পুলিশ পরিদর্শক শেফায়েত হোসেন বলেন, ঘটনার দিন রাতেই নিহতদের ভাই বাদী হয়ে অজ্ঞাত চালককে আসামি করে মামলা করেছেন। পিকআপ ভ্যান জব্দ করা হয়েছে। ভ্যানের চালক ও মালিককে ধরার চেষ্টা চলছে। ঘটনাটি পরিকল্পিত কিনা তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।