যেসব ভোজনরসিকরা মাছ খেতে পছন্দ করেন তাদের কাছে দারকিনা খুবই পরিচিত মাছ। ছোট আকারের এই মাছটি খেতে শুধু সুস্বাদুই নয়, পুষ্টিকরও বটে। কিন্তু বর্তমানে জলাশয় সংকোচন, পানি দূষণ এবং অতি আহরণের ফলে মাছটির বিচরণ ও প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস হওয়ায় দেশে বিপন্নের তালিকায় উঠে আসে দারকিনা।
তবে সুখবর হলো, সম্প্রতি মাছটির কৃত্রিম প্রজনন কৌশল উদ্ভাবন করা সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) বিজ্ঞানীরা এ সাফল্য অর্জন করেছেন। গবেষক দলে ছিলেন মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. শাহা আলী, মো. আশিকুর রহমান ও মো. রবিউল আউয়াল।
বিএফআরআই সূত্র জানিয়েছে, একসময় দেশের যে কোনো জলাশয় বিশেষ করে খাল-বিলের পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে দারকিনা মাছটি চোখে পড়ত। দলবেঁধে চলাচল করত তারা। মাছটিকে স্থানীয়ভাবে ডাইরকা, ডানখিনা, দাড়কিনা, ডানকানা, দারকি, দারকা, চুক্কনি, দাইড়কা ইত্যাদি নানা নামে ডাকা হয়।
এ মাছের পুষ্টিগুণ অন্যান্য ছোট মাছের তুলনায় অনেক বেশি। প্রতি ১০০ গ্রাম ভক্ষণযোগ্য মাছে ভিটামিন-এ ৬৬০ মাইক্রোগ্রাম আরএই, ক্যালসিয়াম ৮৯১ মি.গ্রাম, আয়রন ১২.০ মি.গ্রাম এবং জিংক ৪.০ মি.গ্রাম পাওয়া যায়। মাছটি বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারত (গাঙ্গেয় প্রদেশ এবং আসাম), মায়ানমার, পাকিস্তান, নেপাল ও থাইল্যান্ডে পাওয়া যায়। বহুল পরিচিত ও সুস্বাদু এ মাছটি এখন বিলুপ্তির পথে। তাই মাছটির জিনপুল সংরক্ষণের মাধ্যমে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করতে এবং চাষের জন্য পোনার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে এর কৃত্রিম প্রজননের উদ্যোগ নেয় বিএফআরআই।
বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, কৃত্রিম প্রজননের উদ্দেশ্য নেত্রকোনা জেলার হাওর অঞ্চল থেকে দারকিনা সংগ্রহ করে ময়মনসিংহের গবেষণা কেন্দ্রের পুকুরে শতাংশে ৪০০-৫০০টি হারে মজুত করা হয়। মজুতকৃত মাছকে দৈহিক ওজনের ৫ থেকে ৮ শতাংশ হারে সম্পূরক খাবার (৩০-৩৫ শতাংশ প্রোটিন) দেওয়া হয়। মজুদের পর থেকে প্রতি ১৫ দিন পর পর জাল টেনে মাছের দেহের বৃদ্ধি, স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও ব্রুডের পরিপক্বতা পর্যবেক্ষণ করা হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, মাছটির প্রজননকাল মার্চ থেকে শুরু হয়ে জুলাই মাস পর্যন্ত হলেও মে-জুলাই এদের সবোর্চ্চ প্রজনন মৌসুম। মাছের ডিম্বাশয় মার্চ মাস থেকে পরিপক্ব হতে শুরু করে। গত মার্চের শেষ দিকে কৃত্রিম প্রজননের জন্য পরিপক্ব স্ত্রী ও পুরুষ মাছ নির্বাচন করে পুকুর থেকে তা সংগ্রহ করা হয়। পরিপক্ব স্ত্রী মাছের জননেন্দ্রীয় গোলাকার ও ফোলা হয় কিন্তু পুরুষ মাছের জননেন্দ্রীয় পেটের সঙ্গে মেশানো, লম্বাটে ও ছোট হয়। কৃত্রিম প্রজননের ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা পূর্বে স্ত্রী ও পুরুষ মাছ (১.৫-৩ গ্রাম) পুকুর থেকে সংগ্রহ করে হ্যাচারির সিস্টার্নে রাখা হয়। এরপর কৃত্রিম প্রজননের জন্য স্ত্রী ও পুরুষ দারকিনা মাছকে পিজি হরমোন ইনজেকশনের মাধ্যমে প্রয়োগ করা হয়।
ইনজেকশন দেওয়ার ৬-৭ ঘণ্টা পরে স্ত্রী মাছ ডিম দেয়। ডিম দেওয়ার ১৪-১৬ ঘণ্টার মধ্যে নিষিক্ত ডিম হতে রেণু বের হয়ে আসে। রেণুর ডিম্বথলি ৬০-৭২ ঘণ্টার মধ্যে নিঃশেষিত হওয়ার পর প্রতিদিন তিন-চার বার মুরগির সিদ্ধ ডিমের কুসুম খাবার হিসেবে সরবরাহ করা হয়। দুই-তিন দিন পর রেণু পোনাকে নার্সারি পুকুরে স্থানান্তর করা হয়।
এ প্রসঙ্গে বিএফআরআইর মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ গতকাল ইত্তেফাককে বলেন, বিলুপ্তপ্রায় দেশীয় সব মাছকে ফিরিয়ে আনতে পুনরুদ্ধার কার্যক্রমের আওতায় চলতি বছর প্রথম সুস্বাদু দারকিনা মাছের কৃত্রিম প্রজননে সফলতা অর্জিত হয়েছে। এ বছর আরো আটটি দেশীয় মাছের প্রজনন কৌশল উদ্ভাবনের জন্য গবেষণা হাতে নেওয়া হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাজারে এখন অনেক দেশীয় বিলুপ্তপ্রায় মাছ পাওয়া যাচ্ছে। আর তা দামেও বেশ সস্তা। কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে এসব মাছ আবার ফিরিয়ে আনার ফলেই তা সম্ভব হয়েছে, জানান তিনি।