চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের মাহেন্দ্রক্ষণ পার করছে এখন বিশ্ব। তথ্য প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষের এ সময়ে নতুন নতুন শিল্প কারখানার পাশাপাশি হিড়িক পড়েছে বর্তমান বৃহৎ প্রতিষ্ঠানগুলোর শিল্প কারখানা এক দেশ থেকে অন্য দেশে স্থানান্তরের। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ, সুলভ শ্রমশক্তি এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। এ তিনটি ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ এখন বেশ অনুকূল। ফলে আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতা না থাকলে বাংলাদেশে বিনিয়োগ না আসার কোন কারণ নেই। এদিকে কর্মসংস্থানও বেড়েছে। বাংলাদেশ সরকার হাতে নিয়েছে বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন অথরিটির (বেজা) তত্ত্বাবধানে ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কাজ। সবচেয়ে আকর্ষণের জায়গা চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে ৩০ হাজার একরের বেশি জায়গা জুড়ে গড়ে উঠছে সুপরিকল্পিত 'বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরী'। এর উদ্দেশ্য, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সুযোগ গ্রহণ করা। সবকিছু ঠিকঠাক মতো এগোলে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই শিল্পোন্নত হওয়ার পথে এক অদম্যযাত্রা শুরু করবে বাংলাদেশ।
—ফারহান তুরাব, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)
বর্তমান বিশ্বে প্রযুক্তিগতভাবে যে দেশ যত উন্নত, সার্বিকভাবেই সেই দেশ তত উন্নত। প্রতিবেশী দেশ ভারত এবং চীন তার দুটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তারা শ্রম এবং মেধাকে প্রযুক্তির সাথে সমন্বয় করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে অনন্য মাত্রায়। বাংলাদেশের দিকে তাকালে দেখতে পাই সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র। তাদের থেকে আমরা এখনো বহুগুণে পিছিয়ে। দেখা যায়, আমরা প্রযুক্তিগতভাবে কোনো কিছু বাস্তবায়ন করলেও সময়ের সাথে তা গ্রহণযোগ্যতা হারায়, অথবা সময়োপযোগীতার সঙ্গে একটা ঘাটতি থেকে যায়। ফলে দিন শেষে নির্ভর করতে হয় অন্যদের উপর। আমাদের দেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে বিদেশ নির্ভরতা কমাতে হবে। তাই দরকার দক্ষ জনশক্তির। দরকার শিক্ষা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক পরিবর্তন আনা। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্বমানের পাঠদান, সময়োপযোগী গবেষণা এবং আধুনিক সুবিধা বিশিষ্ট গবেষণাগার তৈরির বিকল্প নেই। শিক্ষাব্যবস্থাকে করতে হবে বাস্তবমুখী এবং প্রায়োগিক। প্রযুক্তিগত উন্নয়ন বাস্তবায়ন করতে হলে আমাদেরকে প্রথাগত নিয়মের বাইরে চিন্তা করতে হবে এবং কর্মমুখী শিক্ষা এবং সময়ের সাথে সমান গতিতে নিজেদেরকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
—শাহরিয়ার রহমান, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধনের জন্য শিল্পায়নের বিকল্প নেই। মাত্র তিন হাজার থেকে শুরু হয়ে এখন প্রায় ৮৮ লাখ শিল্প প্রতিষ্ঠানে উৎপাদন হচ্ছে, প্রায় সাড়ে ৮ কোটি মানুষের কর্মসংস্থান। স্বাধীনতার আগে দেশে কৃষি খাতই ছিল অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি। কৃষিনির্ভর থেকে বেরিয়ে পুরোপুরি শিল্পভিত্তিক দেশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। মূলত, দেশ স্বাধীনের পর শিল্পখাতের বিকাশ হতে শুরু করে। বেড়েছে কৃষি উৎপাদনও। কৃষিভিত্তিক এবং আমদানি নির্ভর দেশ হতে বাংলাদেশ ক্রমে পরিবর্তিত হয়ে একটি উৎপাদন নির্ভর রফতানিমুখী দেশে পরিণত হয়েছে। শিল্প খাতের দ্রুত প্রবৃদ্ধি সাধিত হয়েছে। বাংলাদেশে শিল্পায়নের প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর মধ্যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি অন্যতম। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতকে উৎপাদনের প্রাণশক্তি বলা হয়। তাই এ খাতের উন্নয়ন প্রয়োজন । তাছাড়া কারিগরি জ্ঞানে জনশক্তির জন্য কারিগরি বিদ্যালয়, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও কৃষি কলেজ স্থাপন করা প্রয়োজন। এতে শিল্প কাঠামো স্বয়ংসম্পূর্ণ রূপ লাভ করবে। শিল্পখাতে বিনিয়োগ, উৎপাদন, আয় বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের রয়েছে অফুরন্ত সম্ভাবনা।
—সামিরা খানম ফারিয়া, আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
দেশকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিতে হলে শিল্পায়নের বিকল্প নেই। তবে এই শিল্পায়নে অসামান্য ভুমিকা রাখে দেশের প্রকৌশল সমাজ। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের পড়াশোনার পর পেশাগত জীবনে যাবার আগে কারিগরি দক্ষতা জরুরি। কারিগরি দক্ষতা এবং প্রকৌশল জ্ঞান কে কাজে লাগিয়ে একজন প্রকৌশলী শিল্পায়নে দেশকে অনেক ধাপ এগিয়ে নিতে পারে। উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত করতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি সরকার ও প্রকৌশলীদের নিজেদের এগিয়ে আসতে হবে। এছাড়াও প্রকৌশলীদের যথাযথ সম্মান আর মর্যাদা প্রদান, নিয়মতান্ত্রিক কাজে উৎসাহ দেয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ যা শিল্পায়নকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিবে। দেশের কৃষিখাত থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি কিংবা অর্থনৈতিক সকল খাতে প্রকৌশলীদের অবদান অনস্বীকার্য। আর তাই দেশের মেধাবীদের বাইরের দেশে কর্মসংস্থানে না উৎসাহিত করে নিজ দেশে অবস্থানের বিষয়টি নিশ্চিত করা দরকার। শিল্প খাতকে অগ্রসর করতে এবং দেশের সার্বিক উন্নয়নে দেশকে এগিয়ে নিতে প্রকৌশলীদের পাশাপাশি মফস্বল থেকে শুরু করে সকল স্তরের জনগণকে এগিয়ে আসতে হবে।
—মো. গোলাম রব্বানী, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তোরণ ঘটেছে যার পিছনে শিল্পায়নের একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশের কলকারখানা গুলোতে সংযুক্ত হয়েছে নতুন প্রযুক্তি। বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের দিক দিয়ে পোশাক ও চামড়াজাত পণ্য বাজার দখল করে আছে। তবে দক্ষ জনশক্তির অভাব থেকে গেছে। অটোমেশন সহ চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের নতুন নতুন প্রযুক্তির ব্যাবহার বৃদ্ধি পেলেও দক্ষ জনশক্তির কোনো বিকল্প নেই। পর্যাপ্ত কর্মশালার মাধ্যমে এর উন্নয়ন সাধন হতে পারে। দেশের বিভিন্ন স্থানে রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (ইপিজেড) ও শিল্প অঞ্চল গুলো বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প গুলোকে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে পারলে শিল্পায়নের এই যাত্রা আরোও দ্রুতগতির হবে।
—সাদমান সাদিক শোভন, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়