শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ৮ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

সয়াবিন,পাম অয়েল নিয়ে মহাকারসাজি

আপডেট : ০৬ মে ২০২২, ০৭:৪৫

বাজারে সয়াবিন, পাম অয়েল নিয়ে মহাকারসাজি হচ্ছে। এই কারসাজি চক্রের কাছে রীতিমতো জিম্মি হয়ে পড়েছে ভোক্তারা। ঈদের দুই দিন আগে থেকে রাজধানীতে সয়াবিন, পাম অয়েল অনেকটা উধাও হয়ে গেছে। তেল তো নয় যেন সোনার হরিণ! বাড়তি টাকা দিয়েও অনেকে তেল পাচ্ছেন না। আবার কোনো কোনো দোকানে পাওয়া গেলেও তেলের সঙ্গে অন্য পণ্য কিনতে শর্ত জুড়ে দেওয়া হচ্ছে।

গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর কাওরান বাজার, শান্তিনগর ও তুরাগ এলাকার নতুন বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাজারে বেশির ভাগ দোকানে সয়াবিনের সরবরাহ নেই। একই অবস্থা পাম অয়েলের ক্ষেত্রেও। খুচরা ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, কোম্পানির পরিবেশক ও পাইকারদের কাছে থেকে তারা তেল পাচ্ছেন না। অথচ মিলে যথেষ্ট পরিমাণে তেল মজুত আছে। কাওরান বাজারের জব্বার স্টোরের বিক্রেতা আজিজুল জানান, বারবার তাগাদা দিয়েও তারা কোম্পানির পরিবেশক ও পাইকারদের কাছ থেকে তেলের সরবরাহ পাচ্ছেন না। 

তিনি বলেন, ঈদের দুই দিন আগে কাওরান বাজারে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অভিযানের পর সয়াবিন, পাম অয়েল অনেকটা উধাও হয়ে গেছে। পরিবেশকরা যদি তেল সরবরাহ না করে তাহলে আমরা কীভাবে বিক্রি করব? তুরাগ এলাকার একটি মুদি দোকানের বিক্রেতা সাদ্দাম হোসেন বলেন, ঈদের আগে দুই কাটুন বোতলজাত সয়াবিন তেল পেয়েছিলাম। তা ঈদের আগের রাতেই শেষ। এখন ক্রেতারা এলে ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে। 

এই এলাকার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অন্য এক মুদি দোকানের বিক্রেতা বলেন, কোম্পানির পরিবেশকদের কাছে বারবার চেয়েও সয়াবিন তেল পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি বলেন, ঈদের আগে তিনি পরিবেশককে খুশি করে এক কাটুন তেল নিয়েছিলেন। যা পরিচিত কাস্টমারের কাছে বিক্রি করেছেন। কবে নাগাদ পরিবেশকদের কাছ থেকে তেল পাবেন—তা তিনি জানেন না বলে জানান।

এদিকে সরকারের বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) গতকাল তাদের বাজারদরের প্রতিবেদনে সয়াবিন, পাম অয়েলের চড়া দামের কথা জানিয়েছে। সংস্থাটি জানিয়েছে, প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১৮৫ থেকে ১৯০ টাকায়। পাম অয়েল বিক্রি হচ্ছে ১৭০ টাকায়। তবে বাজারে যে দু-একটি দোকানে তেল পাওয়া যাচ্ছে। সেখানে সয়াবিন প্রতি লিটার ২০০ থেকে ২১০ টাকা ও পাম অয়েল ১৯০ টাকা লিটারে বিক্রি করা হচ্ছে অভিযোগ পাওয়া গেছে। 

অথচ রমজানের শুরুতে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন ১৫২ থেকে ১৫৮ টাকা, পাম অয়েল ১৪০ থেকে ১৪৪ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এছাড়া ৫ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন ৯০০ টাকায় বিক্রির অবিযোগ পাওয়া গেছে। উল্লেখ্য, গত প্রায় দুই বছর ধরেই ভোজ্য তেলের বাজার অস্থির। প্রতিনিয়ত দাম ওঠানামা করছে। কিন্তু গত এক মাসের ব্যবধানে কী এমন হলো যে, বাজার থেকে ভোজ্য তেল উধাও হওয়ার মতো অবস্থা হয়েছে? এ প্রশ্ন ভোক্তাদের। গতকাল তুরাগ এলাকার নতুন বাজারে সয়াবিন তেল কিনতে আসা রেজাউল করিম বলেন, আমরা তো ব্যবসায়ীদের কাছে জিম্মি হয়ে গেছি। এক বছর আগে খোলা সয়াবিন কিনেছি ১১০ টাকায়। এখন তা কিনছি ২০০ টাকায়। তাও পাওয়া যাচ্ছে না।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, দেশের ভোজ্য তেলের বাজার মূলত আমদানিনির্ভর। সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়া পাম অয়েল রপ্তানি বন্ধ ও আর্জেন্টিনা রপ্তানি সীমিত করার ঘোষণা দেওয়ার পর থেকে ভোজ্যতেলের বাজার হু হু করে বাড়ছে। সেই সঙ্গে রয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাবও রয়েছে। তবে বর্তমানে দেশের বাজারে যে সয়াবিন, পাম অয়েল বিক্রি হচ্ছে তা আগের আমদানি করা। এখন এখনই ইন্দোনেশিয়ার পাম অয়েল রপ্তানি বন্ধের প্রভাব বাজারে কেন পড়বে? সংশ্লিষ্টরা বলেছে, এটা কারসাজি ছাড়া আর কিছুই না। এক শ্রেণির অসত্য ব্যবসায়ী কারসাজি করে অধিক মুনাফার লোভে হু হু করে তেলের দাম বাড়াচ্ছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, গত এপ্রিলে বসুন্ধরা, সিটি, মেঘনা, বাংলাদেশ এডিবল অয়েল, টিকে ও সেনা কল্যাণ সংস্থা এই ছয় কোম্পানি ৮ কোটি লিটার সয়াবিন তেল বাজারজাত করেছে। এর মধ্যে বসুন্ধরা গ্রুপ সোয়া ৩ কোটি লিটার, সিটি গ্রুপ ১ কোটি ৪৩ লাখ লিটার, মেঘনা ১ কোটি ৩০ লাখ লিটার, বাংলাদেশ এডিবল অয়েল ৮৮ লাখ লিটার, টিকে গ্রুপ ৮৭ লাখ লিটার ও সেনা কল্যাণ এডিবল অয়েল ৫৪ লাখ লিটার সয়াবিন তেল বাজারজাত করেছে। তাহলে এত তেল যাচ্ছে কোথায়?

এ প্রসঙ্গে সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিত সাহা বলেন, বাজারে প্রতিদিনি যে পরিমাণ তেল সরবরাহ করা হচ্ছে তাতে তো কোনো সংকট হওয়ার কথা নয়। সরবরাহ ব্যবস্হার কোনো স্তরে সমস্যা আছে কি না, তা খুঁজে বের করতে হবে।

উল্লেখ্য, দেশে প্রতি মাসে গড়ে ১ লাখ টন সয়াবিন তেলের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে প্রতি মাসে গড়ে ৬৫ হাজার টন অপরিশোধিত সয়াবিন তেল আমদানি হয়। এ ছাড়া সয়াবিন বীজ মাড়াই করেও প্রতি মাসে ২৮ হাজার টন সয়াবিন তেল উৎপাদন করা হয়। আর প্রতি বছর পাম অয়েলের চাহিদা প্রায় ১৩ লাখ টন। এই চাহিদার ৯০ শতাংশ আসে ইন্দোনেশিয়া থেকে। বাকিটা আসে মালয়েশিয়া থেকে।

চট্টগ্রাম কাস্টমসের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৮ এপ্রিল ইন্দোনেশিয়া পাম অয়েল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা জারির আগে দেশের আমদানিকারকরা এপ্রিল মাসেই প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার টন পাম অয়েল আমদানি করেছে। নিষেধাজ্ঞার কারণে ইন্দোনেশিয়ায় কমপক্ষে ২০ হাজার টন পাম অয়েল আমদানির চালান আটকে গেছে। তবে যেহেতু নিষেধাজ্ঞার আগে এলসি করা হয়েছে তাই এই তেল আসবে। 

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে, বর্তমানে কোম্পানিগুলো ও আমদানিকারকদের কাছে যে পরিমাণ সয়াবিন, পামঅয়েলের মজুত আছে, তাতে দেশের বাজারে ভোজ্য তেলের কোনো সংকট হবে না। কিন্তু একটি চক্র কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে। সরকারকে এখনই এই কারসাজি চক্রতে আইনের আওতায় আনতে হবে। না হলে ভোক্তাদের ভোগান্তি পোহাতে হবে।

ইত্তেফাক/এএইচপি