ঢাকা থেকে দক্ষিণাঞ্চলের নৌপথে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কতৃর্পক্ষের (বিআইডব্লিউটিসি)র প্যাডেল স্টিমার সার্ভিস বন্ধ থাকায় দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে যাত্রীদের। বরিশাল-ঢাকা নৌ-রুট লাভজনক হওয়ায় বেসরকারি লঞ্চ কোম্পানিগুলো একের পর এক বিলাসবহুল লঞ্চ বহরে যুক্ত করলেও লোকসানের অজুহাতে বন্ধই করে দেওয়া হয়েছে স্টিমার সার্ভিস।
মেরামতের নামে ঐতিহ্যবাহী প্যাডেল স্টিমার পিএস অস্ট্রিচ, পিএস মাহসুদ, টার্ন ও লেপচাকে দীর্ঘদিন বসিয়ে রাখা হলেও ঈদ মৌসুমে সেগুলোকে সার্ভিসে যুক্ত করতে পারেনি কতৃর্পক্ষ। বরং সংস্থার পরিচালক (বাণিজ্য) এস এম আশিকুজ্জামান ইত্তেফাককে জানিয়েছেন যাত্রী সেবায় আর যুক্ত হচ্ছে না এসব প্যাডেল স্টিমার। এগুলোকে ক্রুজ জাহাজ হিসেবে পরিচালনা করা হবে এবং ঢাকা থেকে দক্ষিণাঞ্চলের রুটে বর্তমানে চলাচলরত এমভি মধুমতি ও বাঙালি ব্যতীত আর কোনো জাহাজ যুক্তও হবে না। অথচ বিআইডব্লিউটিসি ঢাকা থেকে দক্ষিণাঞ্চলে যাত্রী পরিবহনের জন্য ছয়টি জাহাজের মধ্যে এমভি বাঙালি ও মধুমতি ব্যতীত বাকি পিএস অস্ট্রিচ, পিএস মাহসুদ, টার্ন ও লেপচা প্যাডেল স্টিমার। বরিশাল থেকে খুলনা পর্যন্ত ছয়টি বন্দরের যাত্রীদের সহজ ও নিরাপদ যাত্রার জন্য এ জাহাজগুলো চলাচল করে আসছিল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিআইডব্লিউটিসির একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ইত্তেফাককে জানিয়েছেন সরকারি জাহাজের অব্যবস্থাপনা, সময়সূচিতে যাত্রীদের বিড়ম্বনা, ঘাটগুলোর বেহালদশা, তিন শ্রেণির কেবিনের দুরবস্থার কারণে যাত্রী আকর্ষণ করতে না পারায় লোকসান হচ্ছিল। তবে ঈদ মৌসুমে যাত্রীদের ভোগান্তি লাঘবে ও এ সময়ে লাভজনক থাকায় প্যাডেল স্টিমারগুলো সার্ভিসে রাখা প্রয়োজন ছিল বলে তারা মনে করেন। যাত্রীরা জানান, সরকারি সার্ভিস না থাকায় ঈদ কোরবানিসহ বিভিন্ন উত্সবে তাদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সড়ক কিংবা নৌপথে চলাচল করতে হচ্ছে।
বিআইডব্লিউটিসির বরিশালের এ জি এম কে এম ইমরান জানান, সপ্তাহে সোম ও বৃহস্পতিবার ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা জাহাজ এমভি বাঙালি ও মধুমতি চাঁদপুর, বরিশাল, ঝালকাঠি, কাউখালী, হুলারহাট, চরখালী, বড় মাছুয়া, সন্যাসী ও মোরেলগঞ্জে যাত্রী পরিবহন করে। তিনি জানান, নিয়মিত সার্ভিসের পাশাপাশি ঈদেও এ দুটি জাহাজ স্পেশাল সার্ভিস দিয়েছে। সর্বশেষ শনিবার (৭ মে) স্পেশাল সার্ভিসের যাত্রী নিয়ে এমভি মধুমতি মোরেলগঞ্জ থেকে ছেড়ে বরিশাল হয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে।
এ রুটের নিয়মিত যাত্রীদের অনেকেই জানিয়েছেন সপ্তাহে মাত্র দুই দিন সরকারি সার্ভিস থাকায় মোরেলগঞ্জ থেকে যাতায়াতকারী যাত্রীদের বাকি দিনগুলোতে এ জাহাজে যাতায়াতের সুযোগ থাকছে না। যাত্রীরা জানান, বৈরী আবহাওয়ায় উত্তাল নদীতে যাতায়াতে তাদের বেসরকারি লঞ্চের চেয়ে সরকারি নৌযানের ওপর ভরসা বেশি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে আড়াই বছর আগে ঐতিহ্যবাহী প্যাডেল স্টিমার পিএস অস্ট্রিচ এবং ২০১৬ সাল থেকে এমভি সোনারগাঁও রাজধানীর সন্নিকটে পানশালায় পরিণত হওয়ায় মুখ থুবড়ে পড়ে যাত্রী সেবা। সরকারি সার্ভিস ক্রমেই কমতে থাকায় বেসরকারি নৌযানের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েন দক্ষিণাঞ্চলের যাত্রীরা। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী পিএস অস্ট্রিচ, লেপচা, টার্ন ও পিএস মাহসুদ স্টিমার ডক ইয়ার্ডে পড়ে রয়েছে।
বিআইডব্লিউটিসির একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, ১৯৩৫ থেকে ১৯৪৮ সালের মধ্যে নির্মিত প্যাডেল স্টিমারগুলোকে ১৯৯৫ সালে পুনরায় সংস্কার করা হয়। কিন্তু এরপর আর তেমন সংস্কার হয়নি। গত কয়েক বছর ধরে প্যাডেল স্টিমারগুলো নিয়মিত মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ হচ্ছে শুধু কাগজে কলমে। সংস্থার একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, রহস্যজনক কারণে এসব প্যাডেল স্টিমারে নতুন ইঞ্জিন সংযোজন করা হচ্ছে না। নতুন ইঞ্জিন সংযোজন করে সফলভাবে বাণিজ্যিক পরিচালন সম্ভব হলেও তা করা হচ্ছে না। অথচ বিকল দেখিয়ে ভূয়া বিল-ভাউচার দাখিল করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) বরিশাল জেলার সভাপতি প্রফেসর শাহ্ সাজেদা বলেন, ‘ব্রিটিশ আমলে তৈরি ঐতিহ্যবাহী প্যাডেল স্টিমার সার্ভিস বন্ধ হলে পর্যটকদের পাশাপাশি নিয়মিত যাত্রীদের দুর্ভোগের সীমা থাকবে না। বেসরকারি কোম্পানিগুলো একের পর এক বিলাসবহুল লঞ্চ সার্ভিসে যুক্ত করছে। দক্ষিণাঞ্চল থেকে প্রতিদিন প্রায় ২০টি লঞ্চ যাত্রী পরিবহন করে। অথচ নদীবেষ্টিত বরিশালে সরকারি সার্ভিস সপ্তাহে মাত্র দুই দিন। বেসরকারি খাত একদিকে লাভজনক হয়ে উঠছে অন্যদিকে সরকারি খাত ধ্বংস হচ্ছে। তিনি বলেন, এর সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া উচিত এবং দোষীদের শাস্তির আওতায় আনা উচিত।’