রোববার, ০৪ জুন ২০২৩, ২০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

আঁধারের হাত ধরে

আপডেট : ১৩ মে ২০২২, ১৩:০২

চিরতরে চলে যাবার পর আব্বা আবার ফিরে আসতে থাকলেন নিয়ম করে। ঝড়, জল-জোছনা কিছুই মানছেন না তিনি। রোজ আসছেন। বলছেন, আসলাম তোদের কাছে। তোদের ছাড়া একা একা একদম ভালো লাগে না বুঝলি। ওখানে বড্ড অন্ধকার রে খোকা!

— তাই বলে আপনি এভাবে চলে আসবেন যখন তখন?
— যখন তখন কই এলাম? এক দিনে একবারই তো আসি।
— না মানে, আসবেনই বা কেন? আপনি তো চলেই গিয়েছেন।
— চলে যাওয়া মানেই প্রস্হান নয়, শুনিসনি? বলেই আব্বা শরীর দুলিয়ে হাসেন, কে যেন বলেছিল রে কথাটা?
— জানি না। আমি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে থাকি।
— যেই বলুক, একদম খাঁটি কথা বলেছে ভদ্রলোক।
— আপনি যান আব্বা, প্লিজ।
— চলেই তো গিয়েছি, আবার কীভাবে যাব?
— তাহলে আবার ফিরে আসেন কেন এভাবে?
— আর আসব না বেশিদিন। সারা জীবনই তো সহ্য করেছিস, আর না হয় ক’টা দিন সহ্য কর।

তারপর আর কথা এগোয় না। খোলা জানালার পাশে আমি চুপচাপ বসে থাকি। উঠোনের ধুলামাটিতে সাদা পাঞ্জাবিটা গায়ে আব্বা চিত হয়ে শুয়ে থাকেন। আমাদের লাল রঙের পোষা কুকুরটা আব্বার পায়ের কাছে বসে থাকে সারা রাত। আব্বার মাথার উপর বাতাবি লেবুর গাছটা বাতাস দিয়ে যায় এক নাগাড়ে। আব্বার গা ছুঁয়ে আসা সেই বাতাস আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে যায়।

করোনার শুরুতে এপ্রিলের মাঝামাঝি ঢাকায় করোনার প্রকোপ বাড়ল খুব। সরকারি সাধারণ ছুটিতে আটকে গেল দেশ। দিন এনে দিনে খাওয়া মানুষেরা পড়ে গেল অথই সাগরে। শুধু তাদের কথাই বলছি কেন, গত দু’মাসে বেসরকারি চাকরিজীবীদের একটা বড় অংশ চাকরি হারিয়েছে। যাদের চাকরি এখন পর্যন্ত টিকে আছে তারাও খুব একটা শান্িততে নেই। সকল ধরনের ভাতা তো বন্ধ হয়েছেই, কমেছে বেতনের বড় অংশ। আমার অবশ্য এখনো এই স্রোতে পড়তে হয়নি। আমার প্রতিষ্ঠানে আমি মোটামুটি ভালো অবস্হানে আছি। কোপ পড়লে পড়বে নিচ থেকে। আমার পর্যন্ত আসতে আসতে করোনা বিদায় হবে আশা করি। বিদায় না হলেও খুব একটা ভাবি না আমি। ডাকঘর সঞ্চয়পত্র কেনা আছে লাখ বিশেক টাকার। তিনটা ব্যাংকে ফিক্সড করে রাখা আছে প্রায় আরো ত্রিশ লাখ। সবগুলো থেকেই প্রতি মাসে নিশ্চিত যা কিছু আসে তাতে খেয়ে বসে দিন চলে যাবে। এখন যেমন খাচ্ছি। গত এক সপ্তাহে বাসা থেকেই বের হইনি। বাজারেও যেতে হয়নি কোনো কারণে। এখন অনলাইনেই অর্ডার করা যায় সব। ঘরের দুয়ারে এসে বেল বাজায় মাছ, মাংস, সবজি এমনকি ধনেপাতা!

কিন্তু সমস্যা হলো হাজতবাসের মতো লাগে কেমন জানি। প্রাণ ভরে নিশ্বাস নেওয়া যায় না। ঢাকার বাতাসে যদিও সীসায় ভর্তি, তবু রাস্তায় বের হতে পারলে অন্তত নিজেকে কয়েদী মনে হয় না। ফুটপাতের কোনো দোকানে বসে সস্তায় এক কাপ লেবু চায়ের সঙ্গে সিগারেটে দুটো টান দিলেই মনে হয় জীবন সুন্দর!

যাই হোক, এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে আমরা বাড়ি চলে এলাম। গ্রামের বাড়ি। নাহার—আমার স্ত্রী প্রস্তাবটা দিতেই আমি আর দুবার ভাবিনি। হাতে অনেক ছুটি। অফিস কবে খুলবে কে জানে। প্রাইভেট একটা কার ভাড়া করে চলে এলাম। বহুদিন পর গ্রামে এসে বড় ভালো লাগছিল। এখানে করোনা অতোটা বিস্তার লাভ করেনি এখনো। বিলের তাজা মাছ, খেতের সবুজ শাকসবজি আর বিশুদ্ধ বাতাসে দিন যাচ্ছিল বেশ। সমস্যাটা শুরু হলো হঠাত্। আব্বার জ্বর এলো। শনিবার হাট থেকে নদীর টেংরা গোলসা সদাই করে নিয়ে আসা ভালো মানুষটা জ্বরে পড়ল সন্ধ্যার পর। এশার নামাজের আগেই জ্বর এত বাড়ল যে, রাতে আব্বা ভাতও খেতে পারলেন না। জ্বরের দ্বিতীয় দিনে তাঁর অল্প কাশি আর গলা ব্যাথা শুরু হলো। আমরা যেদিন ভাবলাম কাল পরশু আব্বাকে ডাক্তার দেখাতে পাঠাব—সেদিনই আব্বার তীব্র শ্বাসকষ্ট শুরু হলো। প্রতি প্রশ্বাসেই দম বের হয়ে যায় অবস্হা। মাঝরাত্তিরে আম্মা এসে দরজা ধাক্কাতে লাগলেন। ঘুম ভেঙে আমি আর নাহার দুজনই বিছানায় উঠে বসলাম। আমরা স্পষ্ট আম্মার আহাজারি শুনতে পাচ্ছিলাম। কিন্তু আমরা কোনো সাড়া দিলাম না। আব্বার যা সিম্পটম দেখা যাচ্ছে, তাতে তাঁর করোনা হবার সম্ভাবনা প্রবল। এই সময় তাঁর কাছে যাওয়া মানে নিজের এবং আর সকলের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলে দেওয়া। আব্বার বয়স হয়েছে যথেষ্ট। করোনা একটা উসিলাও হতে পারে তাঁকে নিয়ে যাবার। আমাকে এখন আবেগি হলে হবে? আমাকে কাজ করতে হবে বুদ্ধি খাটিয়ে। আমি তেমনটাই করলাম। গভীর ঘুমে আমরা কেউ আম্মার ডাক শুনতে পাইনি এমন একটা ভাব নিয়ে দাঁতে দাঁত কামড়ে বসে রইলাম। শুধু আমি ভুলে গেলাম, আমাকে হিমালয়ের মতো বড় করার জন্য আমার বাবার বরফের মতো স্বচ্ছ জীবনটাকে, দুঃখ-কষ্টে অবলীলায় পানি করে দেওয়া ত্যাগের কথা। আমি ভুলে গেলাম মৃতু্যর কোনো বয়স বা উসিলা লাগে না।

আম্মা সময় নষ্ট না করে অন্য দুয়ারে গেলেন। বয়সে ছোট চাচাতো ভাই সুজনকে সঙ্গে নিয়ে আম্মা ভ্যানগাড়িতে শুইয়ে আব্বাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলেন রাতদুপুরে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই আমি আর নাহার বাচ্চাদের নিয়ে বসলাম। আমরা যেন ঘোষণাই দিয়ে দিলাম, এখন আব্বার কাছে যাওয়া মানেই মৃতু্য। বাচ্চারা চুপচাপ বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে থেকে শুনল সব।

আব্বা মারা গেলেন আসরের একটু আগে। ভর সন্ধ্যায় তাঁর লাশের ভ্যান এসে থামল বাড়ির উঠোনে। যদিও ব্লাড প্রেসার মাপা ছাড়া আব্বার কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষাই গ্রামের এই হাসপাতালে করানো সম্ভব হয়নি, তবু সারা গ্রাম রটে গেল নিমিষেই—আব্বা করোনা হয়ে মারা গেছেন। অন্যান্য সময় গ্রামে যেমন হয়—কেউ একজন মারা গেলে তার বাড়িতে মানুষের ঢল নামে, এবার তেমন হলো না। খুব হাতেগোনা দু-একজন মানুষ আব্বাকে শেষ দেখা দেখতে এলো। আবার চলেও গেল দ্রুত। মসজিদের ইমাম সাহেব দু-একজনকে সঙ্গে নিয়ে লাশের গোসল দিলেন। আম্মা বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। তাঁর মাথায় পানি ঢালা হচ্ছিল অনবরত। খানিক বাদে আমিও বউ-বাচ্চা নিয়ে ঘরে ঢুকে গেলাম খোঁয়াড়ের হাঁস-মুরগির মতো। কতই আর ঝিম ধরে বসে থাকা যায়? এমনিতেই ক্ষুধা পেটে অবস্হা কাহিল। অগত্যা কাফনে মোড়ানো আব্বার লাশের খাটিয়া সারা রাত ধরে পড়ে রইল উঠোনে, বাতাবি লেবু গাছটার নিচে। নিস্তব্ধ, ভয় জাগানিয়া অন্ধকার রাতে লাশের পায়ের কাছে স্হির হয়ে একা বসে রইল আমাদের লাল রঙের পোষা কুকুর।

আব্বা মারা গেছেন দুই সপ্তাহ হয়ে গেছে। গত সাতদিন ধরে আমার একটানা জ্বর। আমি কাল বিলম্ব না করে ডাক্তার দেখিয়ে টেস্ট করালাম। গ্রামে থেকে টেস্টের স্যাম্পল পাঠানো সহজ ছিল না। তবে টাকা থাকলে কোনো কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। টেস্টে করোনা ধরা পড়ল। তারপর থেকে আমার প্রতি মুহূর্তে অবস্হার অবনতি হচ্ছে। এখানে চিকিত্সা অসম্ভব। ঢাকাতেও যেতে চাচ্ছি না। গিয়েও লাভ কী? বড় বড় মানুষজন মরে যাচ্ছে বিনা চিকিত্সায়।

বই পড়ে, ফেসবুকে স্ক্রল করে কিংবা ঘুমিয়ে দিন কেটে যায়। কিন্তু রাতগুলো আসে ঘড়ির কাঁটা ভেঙে। কিছুতেই কাটতে চায় না রাতগুলো। প্রতি রাতেই আব্বা আসেন এক রাশ ভয় সঙ্গে নিয়ে। গত রাতেও আব্বা এলেন। তার কিছুক্ষণ পরই বৃষ্টি এলো খুব। যথারীতি আব্বা শুয়ে আছেন উঠোনের মাটিতে। খোলা জানালার পাশ থেকে আমি বললাম, আব্বা, আপনি আজো এসেছেন?

— হ্যাঁ, এলাম।
— কেন এমন করেন রোজ বলেন তো? আমার কান্না পায়।
— কী করি বল তো?
— কী করেন মানে? আমার গলা ভেঙে ভেঙে আসে।
— একা একা অন্ধকারে থাকা যায় বল?
— কিন্তু আমার তো ভয় লাগে!
— কী বলিস! এত বড় হয়েছিস তবু ভয় পাস?
— আব্বা বৃষ্টি এলো তো। আপনি ভিজে যাচ্ছেন। কাঁদায় মাখামাখি হয়ে যাচ্ছেন আপনি! আমি হঠাত্ ব্যস্ত হয়ে উঠি।
— মাটিতেই তো থাকি এখন। আব্বা ছোট্ট করে জবাব দেন। তার কণ্ঠে হাজার বছরের শীতলতা।

জানালা দিয়ে বৃষ্টির ছাঁট আসছিল। তবু আমি তাকিয়েছিলাম বাইরে। তুমুল বৃষ্টির মধ্যে আব্বা তখনো চিত হয়ে শুয়ে আছেন। পোষা কুকুরটাও নিশ্চল বসে বসে ভিজছে খুব।

পরের দিন গভীর রাতে আমার প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট শুরু হলো। আমি চিত্কার করে ডাকলাম, নাহার... নাহার...! আম্মা... আম্মা... কেউ সে ডাক শুনল না। আমি খুব কষ্ট করে উঠে গিয়ে দ্রুত জানালা খুলে দিলাম। বাইরে তাকাতেই দেখি আব্বা আজো এসে শুয়ে আছেন উঠোনে।

— খোকা! খোকা রে!
— জি আব্বা!
— কষ্ট হচ্ছে তোর বাপ?
— হ্যাঁ।
— বাইরে আসবি?
— আমার খুব ভয় করে আব্বা!
— কীসের ভয় তোর বোকা ছেলে! আমি আছি না এখানে?
— সত্যি আসব আব্বা?
— আয় না? আয় বাপধন। বাইরে এলে তোর ভালো লাগবে। এখানে এসে দেখ কেমন ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে।

আমি মুহূর্তেই মোহগ্রস্ত হয়ে যাই। দরজার ছিটকিনি খুলে বাইরে চলে আসি। তারপর ধীর পায়ে গিয়ে উঠোনে নামি। আস্তে করে গিয়ে আব্বার পাশে শুই। মাটির শীতলতায় আমার পিঠ জুড়িয়ে আসে। আমি আর আব্বা নিশ্চুপ মাটিতে শুয়ে থাকি পাশাপাশি। লাল কুকুরটাকে দেখি না কোথাও। আমি আকাশের দিকে তাকাই। বাতাবি লেবুর গাছটা চোখে পড়ে। তার পাতায় পাতায় জমাট বাঁধা অন্ধকার।

ইত্তেফাক/জেডএইচডি

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন