চার বছরের শিশু বন্ধন লোহার। এখনো ঠিকভাবে কথা বলতে পারে না সে। ওজন সাধারণ শিশু বাচ্চাদের তুলনায় অনেকাংশে কম তার। ঠিক তেমনি আট বছরের সূতি লোহার আর ১০ বছরের মুন্না লোহারের একই দশা। ওদেরও বয়সের তুলনায় ওজন হাল্কা। আর্থিক সংকটে ভেঙে পড়েছে চলমান জীবন যাত্রা। পরিমিত খাবারের অভাবে পুষ্টিহীনতায় ধুঁকছে বৃহত্তর সিলেটের চা জনগোষ্ঠী। এর মধ্যে ঝুঁকিতে অধিকাংশ মা ও শিশু।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সিলেটে চা-বাগান বেষ্টিত অঞ্চলে প্রত্যেক চা-বাগানে নিম্নে সাড়ে ৩০০ পরিবার থেকে ঊর্ধ্বে ১ হাজার ৫০০ পরিবার বসবাস করছে। প্রতিটি পরিবারে কমপক্ষে চার থেকে ১২ জন সদস্য। অথচ এই বসবাসরত মানুষগুলোর জন্য নেই উন্নত মানের চিকিৎসার ব্যবস্থা। প্রত্যেক চা-বাগানে স্থানীয় হাসপাতালে আছে নিম্নমানের একজন কম্পাউন্ডার ও একজন মিডওয়াইফ। ছোটখাটো জ্বর, কাশি কিংবা ডায়রিয়া হলে স্থানীয় হাসপাতালের কম্পাউন্ডারের শরণাপন্ন হতে হয়। এ থেকে বড় ধরনের অসুখ দেখা দিলে চা-বাগানের বাইরে গিয়ে চিকিৎসা নিতে হয় নিজ খরচে। অথচ সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত তীব্র রোদে গা পুড়ে ২৩ কেজি চা পাতা চয়ন করে দৈনিক মজুরি পায় একজন চা শ্রমিক মাত্র ১২০ টাকা। যেখানে সামান্য মজুরি দিয়ে একজন মানুষের আহার জোগানে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়। সেই জায়গাই চা-বাগানে এক একটি পরিবারে আছে চার থেকে ১০/১২ জন সদস্য। জীবন জীবিকার জন্য প্রয়োজন খাবার, পোশাক, পড়াশোনা ও নিত্যদিনের আনুষঙ্গিক। এর মধ্যে অসুখ-বিসুখ দেখা দিলে ধার-দেনা করে চলতে হয় ওদের। চা-বাগানের শ্রমিকদের সপ্তাহে নেই কোনো ছুটির ব্যবস্থা। এমনকি গর্ভবতী অবস্থায় এক দিন অনুপস্থিত হলে মজুরিও কম পায় এমনি অভিযোগ করেছেন। যুগ যুগ ধরে ন্যাঘ্য শ্রমের আন্দোলনসহ নানা প্রতিকূলতা তুলে ধরে আওয়াজ তুলেছে ঊর্ধ্ব দ্রব্যমূল্যের ক্লান্তিলগ্নেও। কিন্তু আজও বাস্তবায়ন হচ্ছে না কপাল পুড়া কৃষ্ণ বর্ণের মানুষগুলোর।
পরিদর্শনকালে সিলেটের লাক্কাতুরা চা-বাগানের বাসিন্দা গৃহিণী মালতি লোহার (২০) বলেন, আমি চা-বাগানের শ্রমিক নই। তবে আমার শাশুড়ি চ-বাগানে কাজ করে, তারপরেও আমি গর্ভবতী অবস্থায় চা-বাগানের হাসপাতাল থেকে কোনো প্রকার সুযোগ সুবিধা পাইনি। যখন গর্ভবতী অবস্থায় শরীরের মধ্যে পানি জমে গিয়েছিল, তখন চা-বাগানের হাসপাতালে খবর পাঠালে ঐ হাসপাতালের ধাত্রী আমাকে অন্য নিরাময় কেন্দ্রে যেতে বলেছে। তাই বাধ্য হয়ে সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে সিজারের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দেই। লাখ টাকা ধার দেনা করে শহরের ওসমানী হাসপাতালে ডাক্তার দেখিয়ে সন্তান জন্ম দিয়েছিলাম। তাই বেঁচে গেছি। এখনো ঐ টাকা অল্প অল্প করে পরিশোধ করছি। আমার দুই পুত্র সন্তান। ওরা ভবিষ্যতে পড়াশোনা করতে পারবে কিনা তা নিয়ে চিন্তায় আছি। পাশের বাড়ি মধু লোহার (৪০) বলেন, স্ত্রীসহ তিন সন্তান নিয়ে পাঁচ জনের পরিবার। বড় ছেলেকে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ১ হাজার ৫০০ টাকা দিয়ে ভর্তি করিয়েছি। আর প্রত্যেক মাসে বেতন তো আছেই। একজন ছাত্রের পড়াশোনার জন্য যা যা প্রয়োজন সবই দিতে হয় সন্তানকে মানুষ করতে। এদিকে আয়-রোজগার না থাকায় ওদেরকে ঠিকভাবে খাবার জোগান দিতে পারছি না। কখনো একবেলা খেয়ে অন্য বেলায় উপস থাকতে হয়। স্ত্রী বাগানের চা-শ্রমিক। ২৩ কেজি চা-পাতা উত্তোলন করে দিনে আয় করে মাত্র ১২০ টাকা। আর বাইরে কাজ করে কখনো ২০০ টাকা তো কখনো এর চেয়ে অধিক আবার কখনো শূন্য হাতে ঘরে ফিরতে হয় আমাকে।
৬৫ বছরের বিধবা শুকন্তলা লোহার বলেন, এই বয়সে এসেও অভাব আমাদের ছাড়ে না। একটু কিছু হলে নিজ খরচে ব্যয় করতে হয়। এখানে যে হাসপাতাল আছে সেখানে পর্যাপ্ত পরিমাণের সেবা নেই। সামান্য জ্বর হলে কম্পাউন্ডারের কাছে যেতে হয়। সেখান থেকে সাময়িক ভালো হওয়ার জন্য ওষুধ দেয়। এছাড়া কোনো প্রকারের সেবা দেওয়া হয় না। এ প্রসঙ্গে লাক্কাতুরা চা-বাগানের স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মিডওয়াইফ শয়ন মনি গোয়ালা প্রতিবেদককে বলেন, চা-বাগানে একজন কম্পাউন্ডার দিয়ে সবাইকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়।