সিলেট-জকিগঞ্জ ৯০ কিলোমিটার সড়কের দুই পাশের হাওরে পানি থইথই করছে। গ্রামের কিষান-কিষানিরা গরুবাছুর, কাটা ধান ও খড়কুটা নিয়ে বিপাকে। কোথাও শুকানোর জায়গা নেই। মসজিদও ডুবে গেছে। সড়কগুলোর কিছু কিছু অংশ দৃশ্যমান। আবার অনেক স্হানে প্রবল বেগে স্রোত বইছে।
এদিকে, সিলেট ও সুনামগঞ্জের সার্বিক বন্যা পরিস্হিতি অবনতি ঘটেছে। পানিবন্দি মানুষের দুর্ভোগের শেষ নেই। সিলেটের ১২ উপজেলার ১০ লাখ ও সুনামগঞ্জের চার উপজেলার ২ লাখসহ মোট ১২ লাখ লোক পানিবন্দি রয়েছেন গত চার দিন ধরে। দুই জেলার অন্তত ১ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পানি উঠেছে। জেলা ও বিভাগীয় শহরে বিদ্যুৎ সংযোগের অভাবে গ্রাহকরা মারাত্মক দুর্ভোগে পড়েছেন। দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানির অভাব।
বিভাগীয় শহর সিলেটের অবস্হার আরো অবনতি ঘটেছে। সুরমার পানি আরো বৃদ্ধি পেয়ে দুপুরে বিপত্সীমার ৪৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। কানাইঘাটে সুরমা, অমলসিদে কুশিয়ারা, সুনামগঞ্জে সুরমা পয়েন্টে পানি বিপত্সীমার ওপরে প্রবাহিত হচ্ছে। গত এপ্রিলে প্রথম দফা ঢলে সুনামগঞ্জে ফসলের বিপর্যয় ঘটে। এখন দ্বিতীয় দফা পাহাড়ি ঢলে গ্রাম, জনপদ, রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অফিস ডুবে একাকার। সিলেট বিভাগীয় শহরের যেসব জায়গা, বাসাবাড়ি ও অফিসে পানি উঠেছে তা অনেককেই অবাক করেছে। এ অবস্হায় সিলেটের সর্বত্র নদী খননের দাবি উঠেছে।
তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা বলেছেন জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এখন প্রতি বছর এ রকম বন্যা হতে পারে। তাই প্রস্ত্ততি নিতে হবে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী শহীদুল ইসলাম বৃহস্পতিবার বন্যাকবলিত গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, জকিগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেছেন। তিনি ইত্তেফাককে বলেন, সিলেটে নদনদীর পানি অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। ২০০৪ সালের পরে সিলেটে এটা বড় বন্যা। নদনদীর নাব্য বৃদ্ধি করা ছাড়া সিলেট বন্যা মুক্ত হবে না।
বরাকের মোহনা অমলসিদ থেকে সিলেটের প্রধান নদী সুরমা-খালিয়াজুরি পর্যন্ত ২৯৮ কিলোমিটার ও কুশিয়ারা ১৬১ কিলোমিটার বিভিন্ন স্হানে ভরাট হওয়ায় দিনে দিনে সমস্যা বাড়ছে। অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী বলেন, সিলেট ও সুনামগঞ্জে সুরমা, কুশিয়ারাসহ বিভিন্ন নদী খননের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হবে। এদিকে বুধবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিলেট বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শনকালে বলেন, আগামী বর্ষার আগে সুরমা, কুশিয়ারা খনন করা হবে।
সিলেট আবহাওয়া অফিসের সিনিয়র আবহাওয়াবিদ সাঈদ চৌধুরী বলেন, প্রকৃতি খুবই বিরূপ আচরণ করছে। একদিকে অবিরাম বর্ষণ, আরেকদিকে পাহাড়ি ঢল—এই দুইয়ে মিলে সিলেট অঞ্চলের অবস্হা খুব খারাপ। সহসাই পরিস্হিতির উন্নতি হবে না।
সিলেটে ঢলের পানিতে তলিয়ে গেছে বোরো ধান। সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে আউশ ধান চাষে মনোযোগী হয়েছিলেন সিলেটের গোয়াইনঘাটের পূর্ব জাফলং এলাকার কৃষক নিজাম উদ্দিন। দুই একর জমিতে আউশের বীজ রোপণ করেছিলেন। বীজ থেকে চারাও গজিয়ে ছিল। কিছুদিনের মধ্যে এই চারা রোপণের পরিকল্পনা করছিলেন নিজাম। কিন্তু সেই পরিকল্পনায় গুড়েবালি। বন্যায় তলিয়ে গেছে নিজামের বীজতলা।
নিজাম বলেন, চার দিন ধরে বীজতলা পানিতে ডুবে আছে। সব চারা পচে যাবে। গত মাসে বন্যায় বোরো ধান গেছে। এবার আউশও চলে গেলে আমাদের বছর চলবে কী করে? খাবো কী? এই আক্ষেপ এখন সিলেটের বেশির ভাগ কৃষকের।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিসের হিসেবে, চলমান বন্যায় বুধবার পর্যন্ত আউশ ধানের বীজতলা ১ হাজার ৩০১ হেক্টর, বোরো ধান ১ হাজার ৭০৪ হেক্টর এবং গ্রীষ্মকালীন সবজি ১ হাজার ৪ হেক্টর পানিতে তলিয়ে গেছে। বন্যায় সিলেট সদর, দক্ষিণ সুরমা, কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, জকিগঞ্জ, কানাইঘাট, ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার পর এবার বিয়ানীবাজার এবং গোলাপগঞ্জ উপজেলারও বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। পানি উঠেছে কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট ও কানাইঘাট উপজেলা কমপ্লেক্সে। এসব উপজেলার অনেক বন্যা আশ্রয়কেন্দ্রেও পানি উঠে গেছে। এতে আশ্রিতরা পড়েছেন বিপাকে।
সিলেট জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, জেলার বিভিন্ন উপজেলার ৫৫টি ইউনিয়ন সম্পূর্ণভাবে এবং ১৫টি ইউনিয়ন আংশিকভাবে প্লাবিত হয়েছে। বন্যার পানিতে সিলেট সদর ও জৈন্তাপুর উপজেলায় নৌকাডুবিতে তিন জন মারা গেছেন। গোলাপগঞ্জে পাহাড় ধসে এক জন মারা গেছেন।
সিলেটের জেলা প্রশাসক মজিবর রহমান বলেন, জেলায় ২৭৪টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। বর্তমানে ৭৮টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৬ হাজার ৪৭৫ জন আশ্রয় নিয়েছেন। গবাদিপশুর জন্য ২২০টি আশ্রয় কেন্দ্রে রয়েছে। তিনি বলেন, বন্যার্তদের মধ্যে এরই মধ্যে ৫ লাখ ৩৪ হাজার টাকা, ১৪৯ টন চাল, ১ হাজার ৭৫০ প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে স্বাস্হ্যসেবা ও বিশুদ্ধ পানি দেওয়া হচ্ছে। ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে আরো ২৫ লাখ টাকা, ২০০ টন চাল ও ৪ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার পাওয়া গেছে।
বৃহস্পতিবার সকাল থেকে সিলেট নগরী ও বিভিন্ন উপজেলায় থেমে থেমে বৃষ্টি হয়েছে। দুর্ভোগ বেড়েছে বন্যাকবলিত এলাকার বাসিন্দাদের। বিশুদ্ধ পানির তীব্র অভাব। জনস্বাস্হ্য প্রকৌশল বিভাগ জানায়, তারা ৫ লাখ পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণ করেছে। আরো ৫ লাখ ট্যাবলেট প্রয়োজন।
এদিকে সিলেট-বিয়ানীবাজার সড়কের রানদা বাজার নামক সড়কের কয়েক স্হানে দুই ফুট পানির তীব্র স্রোত বইছে। বিয়ানীবাজারের চারখাই সড়কের অবস্হা ভয়াবহ। এসব সড়কে যানবাহন চলছে বিপজ্জনকভাবে। যে কোনো সময় দুর্ঘটনার আশাঙ্কা রয়েছে। সিলেটের আলমপুরে বিভাগীয় অফিস, ডিআইজি অফিসের আঙিনায় দুই ফুট পানি।
এদিকে গত রাতে সিলেটে প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেছে। সঙ্গে বজ্রপাতও ছিল। সীমান্তের ওপারে ভারতের মেঘালয়ে বৃষ্টিপাত বেড়ে যাওয়ায় ঢলের প্রভাবও বেড়েছে। নিচু এলাকা হিসেবে পরিচিত শাহজালাল উপশহর, ঘাসিটুলা, মাছিমপুর, ছড়ারপার, তালতলা, কুয়ারপার, মেন্দিবাগ, কামালগড়, চালিবন্দর, যতরপুর, সোবহানিঘাট, কালীঘাট, শেখঘাট, তালতলা, জামতলা, মাছুদীঘিরপার, রামের দীঘিরপার, মোগলটুলা, খুলিয়াটুলা, পাঠানটুলা, সাগরদীঘিরপার, সুবিদবাজার, শিবগঞ্জ, মেজরটিলা, মদিনা মার্কেট, দক্ষিণ সুরমার বঙ্গবীর রোড, ভার্থখলা, মোমিনখলা, পিরোজপুর, আলমপুর ও ঝালোপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় বাসাবাড়িতে পানি উঠেছে। এসব এলাকায় বাসাবাড়িতে কোমরপানি। বাসাবাড়িতে পানি ওঠায় মানুষ বড় কষ্টে আছে।
সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, সুনামগঞ্জ সদর, বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর, ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলায় বন্যা পরিস্হিতি অপরিবর্তিত। বৃহস্পতিবার সকালে সুনামগঞ্জের নদ-নদীর পানি বিপত্সীমার ১৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে জানিয়েছে সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড।
এদিকে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জে ২১৬টি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্লাবিত হয়েছে এবং ২৮টি সাময়িক বন্ধ রাখা হয়েছে। পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জ সদর, তাহিরপুর, শান্িতগঞ্জ উপজেলাসহ জেলার পাঁচটি উপজেলার ২১৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্লাবিত হয়েছে। ছাতকে ১৭২, দোয়ারাবাজারে ২৩, সদর উপজেলার ২০ এবং শান্িতগঞ্জের একটি স্কুলসহ ২১৬টি স্কুলে পানি প্রবেশ করেছে।
সুনামগঞ্জের জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা (ডিপিইও) এস এম আব্দুর রহমান বলেন, বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে অস্বাভাবিক পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে স্কুলের অবকাঠামোর ক্ষয়ক্ষতিসহ পাঠদানও বিঘ্নিত হচ্ছে। সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, পানির কারণে স্কুল বন্ধ রয়েছে।