কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন একাধারে তৌহিদপম্হি এবং অদ্বৈতবাদী। তিনি খোদার ভাবমূর্তি এবং ঈশ্বরের মূর্তিতে বিশ্বাস করতেন। আমাদের মনে রাখা দরকার এই যে, যে মানুষ মূর্তি বিশ্বাস করে না, সে ভাবমূর্তিতে বিশ্বাস করে। বিষয়টিকে আমরা কাজী আবদুল ওদুদের মনীষার আলোকে বিচার করে দেখব। তিনি তাঁর সংস্কৃতির কথা সন্দর্ভটি শুরুই করেছেন এই বলে যে, ‘মনে হয় মানুষ স্বভাবত পৌত্তলিক : কোনো বিশেষ প্রতিমা বিশেষ তত্ত্ব, বিশেষ আচার বা বিশেষ ধরন-ধারণ—এ না হলে যেন তার চলতে চায় না। আর এরই সঙ্গে সঙ্গে সে পরিবর্তন প্রিয়—তার প্রতিমা তত্ত্ব আচার বা ধরন-ধারণ ক্রমাগত বদলায়।’
এবার দেখা যাক, নজরুল নিজেকে কীভাবে ধর্ম-অনুষঙ্গে ব্যক্ত করছেন। ১৯৪০ সালে বঙ্গীয় মুসলিম সভায় তিনি একটি লিখিত ভাষণ পড়ে শোনান। নজরুলের কথা থেকেই জানতে পারি, তা ছিল বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য পরিষদের বার্ষিক অধিবেশন, নজরুল এক্ষেত্রে ‘উত্সব’ কথাটি ব্যবহার করেছেন। কথাটি তিনি সচেতনভাবে ব্যবহার করেছেন। উল্লেখ করেছেন ইস্টারের ছুটিতে এই উত্সব হচ্ছে। এ কথাগুলি আমন্ত্রণপত্রের প্রতি-উত্তরে লিখিত পত্রে উল্লেখ করেছেন।
অভিভাষণে বা লিখিত ভাষণে তিনি মুসলিম ছাত্রদের সামনে এই অনুষ্ঠানকে ‘প্রাণের নওরোজ’ বলে চিহ্নিত করেছেন। ইরান বা পারস্যের নববর্ষের উত্সব হলো নওরোজ। দেখা যাচ্ছে, পুরো বিষয়টি অত্যন্ত সচেতনভাবে পেশ করছেন কবি। মুসলিম ছাত্রদের কী বার্তা (পয়গম) তিনি দিলেন? তিনি জানালেন, ‘আমার মন্ত্র—ইয়াকা না-বুদু ওয়া ইয়াকা নাস্তাইন’। কেবল এক আল্লাহর আমি দাস, অন্য কারোর দাসত্ব স্বীকার করি না। পাঠক, মনে করুন, “আমি আপনার ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ”...।’
কবি লিখেছেন, ‘অন্য কারুর দাসত্ব স্বীকার করি না, একমাত্র তাঁরই কাছে শক্তি ভিক্ষা করি।’
অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের মতো নজরুল ছিলেন শক্তি-উপাসক। যা করলে দেশের স্বাধীনতা আসবে, তিনি তা-ই করেছেন, ফলে তিনি ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ লিখে ব্রিটিশের জেল খেটেছেন।
ফের নজরুলের লিখিত ভাষণে চোখ রাখা যাক। ‘শক্তি ভিক্ষা করি’ বলার পর নজরুল একটি ড্রাশ দিয়ে লিখেছেন, ‘আমি ফকির, আল্লাহর দরবারে আজ আমি পরম ভিক্ষু, যদি তাঁর কাছে রহমত ও শক্তি ভিক্ষা পাই—ইনশা-আল্লাহ্ শুধু ভারত কেন—সারা দুনিয়ায় সত্যের ডঙ্কা বেড়ে উঠবে— তৌহিদের—পরম অদ্বৈতবাদের অমৃত বন্যা বয়ে যাবে। এই অদ্বৈতবাদেই সারা বিশ্বের মানব এসে মিলিত হবে।’
এক্ষণে মনে রাখতে হবে, এটি নজরুলের অলিখিত বক্তৃতা নয়, বস্ত্তত লিখিত ভাষণ। সুতরাং এর প্রতিটি শব্দ মেপে বসানো, অত্যন্ত সজাগ প্রয়োগ। উদ্ধৃত অংশে দু-দুবার নজরুল ‘পরম’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। ঈশ্বরের মূল সত্তাই হলো পরম। খোদার একত্বই পরম। প্রসঙ্গত বলি, ‘খোদা’ শব্দটি ফারসি এবং যার অর্থ স্বয়ম্ভু। আমরা জানি, খোদা নিজেই নিজেকে সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু ‘আল্লাহ’ শব্দটি নিয়ে মহাবিতর্ক রয়েছে। শব্দটি বিশেষ্য না বিশেষণ, তা নিয়েও তর্ক আছে। তবে সে তর্ক অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক। তা নিয়ে অন্যত্র আলোচনা হবে। আপাতত আমরা খোদা শব্দটিই ব্যবহার করব। দেখতে হবে, নজরুল নিজেকে পরম ভিক্ষু (বৌদ্ধবাচক শব্দ) এবং পরম অদ্বৈতবাদী বললেন কেন। অবশ্যই নিজেকে তিনি ‘ফকির’ বলেছেন। ফকির শব্দটি আরবি—যার দুটি অর্থ : (১) ভিক্ষুক, (২) দরবেশ। বোঝাই যাচ্ছে, নিজেকে তিনি আউলিয়া-দরবেশ বা সুফি-সন্ন্যাসী বলেছেন। শেষের দিকে, পুরো নির্বাক হয়ে যাওয়ার কিছু আগে, নজরুল নিজেকে হিন্দু সন্ন্যাসী বলে ভাবতেন, এ কথা বুদ্ধদেব বসুর একটি লেখায় পাওয়া যায়—তখন নজরুল খুবই অসুস্হ। কী চাইছিলেন এই মহান কবি? বাঙালির জন্য ও ভারতবর্ষের জন্য কোন মিলনের স্বপ্ন দেখেছিলেন? নজরুলের মতো সমন্বয়বাদী কবি পৃথিবীর আর কোথাও জন্মেছেন কি না, ঠিক তারই মতো করে—এ ব্যাপারে আমরা খুব নিশ্চিত নই। মনে হয়, পৃথিবী নামের এই গৃহে তিনি একক এবং একা।
‘পরম’ শব্দটি ঔপনিষদিক। ঐ শব্দটির মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে নজরুলের জীবনদর্শন, রয়েছে উপনিষদের সাকার ও নিরাকার ব্রহ্মবাদ।
মনে রাখতে হবে, নজরুল তাঁর লিখিত ভাষণটি মুসলিম ছাত্রদের সামনে পাঠ করছিলেন, যদি তারা হিন্দু ছাত্র হতো তাহলেও কবির ভাষণে কোনো রদবদল হতো—কারণ ঐ অভিভাষণে তাঁর জীবনমন্ত্র উচ্চারণ করেছিলেন। আমরা দেখেছি, নজরুল উপনিষদ ও পুরাণকে মিলিয়ে, বৌদ্ধতত্ত্ব ও খ্িরষ্টানবাদকে শ্রদ্ধা জানিয়ে বাঙালির জন্য সমন্বয়ের পথ প্রস্ত্তত করেছিলেন। ধর্মের মধ্যেও যে রস ও আনন্দ রয়েছে, তার হদিস পেতে নজরুলের কোনো অসুবিধাই হয়নি। লেটো দলে গান গাইতে গাইতেই তাঁর পুরাণভক্তির উত্পত্তি ঘটে। ফারসির ইরানি কাব্যে তিনি অতীন্দ্রিয়বাদের সন্ধান পান; বৌদ্ধ দর্শন থেকে তিনি জন্মান্তরবাদের পথে জগত্প্রীতি ঘটান—ধর্মের পথেই তিনি বিদ্রোহী কবিতার ‘দ্রোহ’ কায়েম করেন। অবাক হওয়ার কিছু নেই, এ কথা ভেবে যে, রবীন্দ্রনাথকে আর্য ঋষি জ্ঞানে সম্মান করেছেন; এই নজরুলই রোজকিয়ামতে খোদার ‘দিদার’ পাবেন বলে অধীর আগ্রহে গান বেঁধেছেন।
নজরুল দর্শনের এ কোন বিচিত্র গতি!
লেখক: পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক