শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

মনের অলিন্দ ও প্রতিবেশী

আপডেট : ২০ মে ২০২২, ০৭:১৫

দরজায় নকের আম্মার সাহাঘ্যকারী মারফতির মা বুয়া হড়বড় করে বলে ওঠে—‘লালবাগের ঐ মুড়ারত্থন পলাশীর এই মুড়া লৌড়াইতে লৌড়াইতে আইছি।’

আমরা বারান্দায় খেলছিলাম। বুয়া বলল, ‘আম্মা, এট্টু পর লেম্বুর মা তোমার লগে দেখা করতে আইবো।’

কথাটা শুনে দুজনেরই সিক্স মিলিয়ন ডলার ম্যানের মতো কানের পাওয়ার বেড়ে গেল। বুয়ার ‘লেম্বুর মা’ হচ্ছেন, আমাদের প্রতিবেশী খালাম্মা—লিবু ভাইয়ের আম্মা। কথান্তরে লিবু—লেবু—লেম্বু অর্ধ-তত্সম ভাষা। আমরা বাসা থেকে বেরোনোর মওকা খুঁজতে লাগলাম, নিশ্চয়ই আমাদের ব্যাপারে কোনো কমপ্লেন নিয়ে আসবেন খালাম্মা! গত পরশুদিন লেবু ভাইদের বাসায় আসন্ন শবেবরাতের হালুয়াসংক্রান্ত খালাম্মাদের মিটিং থেকে আম্মাকে ডেকে আনতে গেলে লেবু ভাই আম্মার কাছে আমাদের দুই ভাইয়ের নামে নালিশ করেছিলেন। তখন খালাম্মার দেওয়া চানাচুর আমরা খুব মজা করে খাচ্ছিলাম। লেবু ভাই বাইরে থেকে এসে আমাদের দুজনকে দেখে চোখ গোল গোল করে আম্মাকে বললেন, ‘খালাম্মা, এই দুইজনের জন্য রাস্তাঘাটে মান-সম্মান নিয়ে চলতে পারি না। দেখলেই বলে, ‘হালি কত? কাগুজি না এলাচি?’

লেবু ভাইকে ছোট্ট একটা শান্টিং দিয়ে আম্মা বললেন, ‘তুমি না বড় ভাই, কান ছিঁড়ে দিতে পার না? আর কখনো বড় ভাইকে নাম ধরে ডাকবি?’ বলে বকা দিলেন। খালাম্মা ও লেবু ভাইয়ের হস্তক্ষেপে ছাড়া পেলাম।

লেবু ভাইয়ের বোন আমাদের সমবয়সি কেকনের কাছে আমাদের প্রেস্টিজ পাংচার হয়ে গেল। গতকাল দুপুরে যথারীতি জানালার রেলিং দিয়ে বাইরে পা বের করে আমরা দুজন কমলা খাচ্ছিলাম আর অপেক্ষা করছি কখন আসরের আজান হবে। আসর থেকে মাগরিবের আজান পর্যন্ত আমাদের মাঠে খেলার সময় বরাদ্দ। নিচ থেকে লেবু ভাইয়ের সহাস্য সম্বোধন, ‘কী রে তোদের খবর-টবর কী? কানে ব্যথা আছে নাকি?’

বেশ কনফিডেন্স নিয়ে তাকিয়ে আছেন। আম্মা কিছু বলতে নিষেধ করেছেন, তাই মনের দুঃখে হাতের কমলার কোয়া মুখে পাঠিয়ে দেওয়ার সময় হঠাৎ মনে হলো বইয়ে তো পড়েছি কমলাকে কমলালেবু বলে। সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে ফ্রিজ থেকে একটি কমলা এবং একটি লেবু নিয়ে দুই ভাই ইশারায় লেবু ভাইকে অফার করতে লাগলাম। লেবু ভাই মান-সম্মান নিয়ে ডানে-বামে অন্য কোনো বন্ধু আছে কি না দেখে দ্রুত কেটে পড়লেন।

আসলে আমাদের দুই ভাইয়ের জন্ম আজিমপুর কলোনিতে। লেবু ভাই বিএ পড়েন; আমরা ক্লাস ফোর-ফাইভে। সবাই খুব আদর করতেন। আজিমপুর কলোনির জীবনটা ছিল অন্যরকম। বিল্ডিংয়ের নম্বর অনুযায়ী মাঠের নামকরণ হতো। যেমন ৪২ নম্বর মাঠ, ২৭ নম্বর মাঠ, ১০ নম্বর, ১২ নম্বর ইত্যাদি মাঠ। মাঠগুলো ছিল বিশাল বড়। সেখানে আশেপাশের পাঁচ-ছয়টি বিল্ডিংয়ের ছেলেরা খেলত। এছাড়া প্রতিটি বিল্ডিংয়ের পাশে ছোট ছোট মাঠ ও বাগান ছিল। নিজেদের বিল্ডিং ও আশেপাশের বিল্ডিংয়ের খালাম্মা-খালু, চাচা-চাচি আমাদের রক্ত সম্পর্কে কেউ নন—এটা জানতে, বুঝতে অনেক দিন সময় লেগেছিল।

আজিমপুরের কোনো টু বি ইয়ং ছেলে আজিমপুর গার্লস স্কুল বা অগ্রণী বালিকা বিদ্যালয়ের আশেপাশে উঁকি দিতে সাহস পেত না। তাকে চেনে এমন কোনো খালাম্মা বা চাচি বা ঐ দুই স্কুলে আমাদের পরিচিত ছাত্রী যদি তাকে ঘুরঘুর করতে দেখেন তাহলে সরাসরি চার্জ। সিগারেট ফুঁকতে অনেকে কলোনির সীমার বাইরে চোরের মতো যেত; যদি কোনো খালু বা চাচা বা বড় ভাই দেখে ফেলেন! উনারা নিজের ছেলেদের যেভাবে কনফিডেন্টলি শাসন করতেন, তেমনি কলোনির অন্য ছেলেদেরও একই নিয়মে শাসন করতেন। ছেলেদের অভিভাবকরা নিশ্চিন্তে থাকতেন তাদের বাচ্চারা চোখে চোখে আছে।

সকালবেলায় দুলাল ভাইয়ের হোন্ডার শব্দ আমরা উত্কর্ণ হয়ে শুনতাম। বিল্ডিংয়ের কোনো ছোটভাইকে বাইকে বসিয়ে পুরো বিল্ডিং একবার চক্কর দিয়ে বউনি করতেন। এরপর উনি বাইরে যেতেন। আমরা বন্ধুরা সুযোগের অপেক্ষায় থাকতাম, দুলাল ভাইয়ের হোন্ডায় ওঠার জন্য।

আব্বা বেশ কিছুদিন অস্ট্রেলিয়ায় সরকারি কাজে গিয়েছিলেন। বাসায় বাজার-সদাই করা নিয়ে আম্মাকে চিন্তিত দেখে লেবু ভাইয়ের আম্মা সান্ত্বনা ও সাহস দিয়ে বলেন, ‘ভাবি, আপনি চিন্তা করবেন না, আমার শিমলা যখন আমাদের বাজার করবে তখন আপনাদের বাজারটাও করে দিবে।’ শিমলা হচ্ছে খালাম্মার ছোট ছেলে শিমুল ভাই। পরে আম্মা শিমুল ভাইয়ের আন্ডারে আমাকে ইন্টার্নি করতে পাঠালেন। লালবাগ বাজারে দুইদিন পরপর শিমুল ভাইয়ের কাছে হাতে-কলমে ট্রেনিং নিলাম। প্রত্যেকটা জিনিস সেটা ধনেপাতাই হোক বা কাঁচামরিচ বা টমেটো সেটা উনি খুব ভালো করে যাচাই করে কিনতেন। আমাকে হাতে ধরে দেখাতেন। লালবাগ কেল্লার মোড় বাজারে ঢাকাইয়া বিক্রেতাদের ‘আমারটা লও, আমারটা লও, দাম কও না ক্যালা, নিবানা ক্যালা’ ইত্যাদি প্রচ্ছন্ন হুমকি দেখে কোনো কোনো সময় সবজিতে হাত দিতে সাহস পেতাম না। শিমুল ভাই কী করে পরিস্হিতি ট্যাকেল করতে হয় সেটা শিখিয়েছেন।

ক্লাস নাইন-টেনে ভূগোল বইয়ের ম্যাপ আঁকা নিয়ে খুব সমস্যায় পড়লাম। মুশকিল আসান হিসেবে মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র লিপু ভাইয়ের শরণাপন্ন হলাম। লিপু ভাই, কাজল ভাই খুব ভালো ছাত্র ছিলেন। এজন্য যে কোনো পড়া খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে দিতেন বিরক্ত না হয়ে। অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশ ইত্যাদি লাইন-টাইন টেনে সুন্দর করে সহজভাবে বাংলাদেশের ম্যাপ আঁকা শিখিয়ে দিলেন।

পহেলা বৈশাখ, ঈদ, একুশে ফেব্রুয়ারি, বার্ষিক পরীক্ষার ছুটি ইত্যাদি বিভিন্ন পরবে প্রতিটি বিল্ডিংয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের ঢল নামত। ছড়া, গল্প বলা, নাচ-গান আর অবশ্যই মূল আকর্ষণ নাটক। এই অঙ্গনের চালিকাশক্তি আমাদের সাকলাইন ভাই। উনি নাটকের রচয়িতা, নির্দেশক, পরিচালক, মেকআপম্যান, ড্রেস ডিরেক্টর এবং একইসঙ্গে প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা। আসলে বিভিন্ন বিল্ডিংয়ের এসব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রবল রেষারেষি থাকত। একটি টিমের সঙ্গে আরেকটি টিমের হাড্ডাহাড্ডি কম্পিটিশন। এক টিম অন্য টিমের প্রশংসা শুনতে পারত না। নিজের নিজের টিমের অনুষ্ঠান সফল করার সঙ্গে সঙ্গে কোনোভাবে অন্য টিমের অনুষ্ঠান ভণ্ডুল করার জন্য চেষ্টা চালাত। ঠিকমতো নজরদারি না করলে প্রতিপক্ষের পচা ডিম, গলা টমেটো অনুষ্ঠানকে বর্ণময়- গন্ধময় করে দিত। নাইন-টেন, কলেজ-ভার্সিটিতে পড়া বড় ভাইরা ও আপারা নাটকের নায়ক-নায়িকা-ভিলেনসহ বড় বড় সব পার্ট নিতেন; সংলাপও তাদের মুখে থাকত। আমাদের জুনিয়র পার্টির কাজ নাই, মাঝে মাঝে লাঠিয়াল বাহিনীর সদস্য ইত্যাদি বোবার পার্ট। সাকলাইন ভাইয়ের কড়া নির্দেশনা, ‘তোরা কোনো সংলাপ পাবি না, অনুষ্ঠান নষ্ট করতে তোদের মতো একজনই যথেষ্ট।’ আমরা অনেক অনুনয় বিনয় করেও সাকলাইন ভাইয়ের মন গলাতে পারলাম না। শেষে খালাম্মাকে ধরে (সাকলাইন ভাইয়ের আম্মা) একটা করে ডায়ালগ বরাদ্দ পাই। কিন্তু ডায়লগ দিতে গেলে পেট ফেটে হাসি বেরোয়। সাকলাইন ভাই রেগেমেগে ফায়ার। অনুষ্ঠানের দিন স্যান্ডো গেঞ্জি পরে লাঠিয়াল হিসেবে নিজেদের খুব একটা ফিট না হওয়াতে যার যার বাসা থেকে জুতোর ব্রাশ, কালো কালি দিয়ে দাড়ি-গোঁফ বানিয়ে নিজেরা নিজেরা মহড়া দেই। মনে হলো চরিত্র অনুযায়ী এবার আমাদের মেকআপ ঠিক হয়েছে।

হঠাৎ করে চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে ফ্লু। একদিন আম্মা রান্নাটাও পুরোপুরি শেষ করতে পারলেন না। আব্বাও জ্বরে ভুগছিলেন। দুজনেই শয্যাশায়ী। আমরা দুই ভাই ও কাজের ছেলে জলপট্টি দিয়েও জ্বর কন্ট্রোলে আনতে পারছিলাম না। বিকেলে মাঠে খেলতে না যাওয়ায় তিনতলার চাচি খোঁজ নিতে আসেন—কেন আমরা দুই ভাই খেলতে গেলাম না। বাসায় আব্বা-আম্মার অবস্হা দেখে দ্রুত উনি উনার বাসায় গিয়ে চাচাকে নিয়ে আসেন এবং আশেপাশের অন্যান্য প্রতিবেশীকে লেবু খবর দেন। আব্বা-আম্মার মাথা ধুয়ে গরম গরম ভাত, মুরগির মাংস জোর করে খাইয়ে দেন; আমাদেরকেও খেতে দেন। ফ্রিজ খুলে বাজারের অবস্হা দেখে বাজার আনতে পাঠান। আজিমপুর কলোনির ছাপড়া মসজিদের বিখ্যাত মুক্তি ফার্মেসিতে ডাক্তার সাহেবকে আনানোর ব্যবস্হা করেন। সকলের ভালোবাসায় আব্বা-আম্মা দ্রুত সুস্হ হয়ে ওঠেন।

হালের বিশাল একটি ফ্ল্যাট কমপ্লেক্সের দুই তলা থেকে নিচে নেমে আসি অফিস যাব বলে। গত রাত থেকে মনটা অনেক খারাপ একটা নিউজ দেখে। ইতালির লম্বার্ডিতে শোবার ঘরের চেয়ার থেকে এক সত্তরোর্ধ্ব মহিলার লাশ দুই বছর পর উদ্ধার করেছে পুলিশ। সম্পূর্ণ একা, নিঃসঙ্গ মৃত্যু—দুই বছরেও কেউ খোঁজ করল না?

লিফটের কাছে লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থমকে দাঁড়াই। বিল্ডিংয়ের কেয়ারটেকারকে জিজ্ঞেস করি, ‘কী ব্যাপার, এই অ্যাম্বুলেন্স কেন?’

সে উত্তর দেয় রাতে পাঁচতলার সাহেবের ভাই মারা গেছেন। নিজেকে ধিক্কার জানাই—কেমন প্রতিবেশী আমি?

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ, গাজীপুর

ইত্তেফাক/জেডএইচডি

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন