বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

জাকাত বোর্ড ও দারিদ্র্য দূরীকরণ

আপডেট : ২০ মে ২০২২, ১১:৪৭

জাকাত দারিদ্র্য বিমোচনে বিরাট অবদান রাখতে পারে। ইসলামের ইতিহাসে তার নজির রয়েছে। জাকাতের পাশাপাশি উশর, ওয়াক্ফ, ফিতর, সাদাকা, কর্জে হাসানা ইত্যাদি ব্যবস্থাও ইসলামি সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণে বিশেষ অবদান রাখে। বাংলাদেশ সরকার ১৯৮২ সালে ইসলামি শরিয়া আইনে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে জাকাত বোর্ড গঠন করেছে। বর্তমানে জাকাত বোর্ড যে জাকাত আদায় করছে, তার পরিমাণ কয়েক কোটি টাকা মাত্র। অথচ দেশে ৩০ হাজার কোটি টাকা জাকাত আদায় সম্ভব বলে মনে করছেন গবেষকরা। সুতরাং জাকাতকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার জন্য জাকাত বোর্ডকে কার্যকর করতে হবে। জাকাতের টাকা থেকে যেসব জনকল্যাণমূলক কাজ করা যায়, তার একটি রূপরেখা নিম্নে উপস্থাপন করা হলো—

১. বৃদ্ধদের জন্য মাসিক ভাতা: দেশের প্রতিটি ওয়ার্ড (৪ হাজার ৫৭১টি ইউনিয়নের মধ্যে ওয়ার্ডের সংখ্যা ৪১ হাজার ১৩৯টি) থেকে যদি ৫০ জন বৃদ্ধকে মাসিক ভাতা প্রদান করা হয়, তাহলে উপকারভোগীর সংখ্যা হবে ২০,৫৬, ৯৫০ জন। যদি প্রতি জনকে মাসিক ১ হাজার টাকা হারে ভাতা প্রদান করা হয়, তাহলে মাসে লাগবে ২,০৫,৬৯,৫০,০০০ টাকা এবং বছরে লাগবে ২৪,৬৮,৩৪,০০,০০০ টাকা অর্থাৎ প্রায় ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।

২. মৌলিক পারিবারিক সাহায্য: যদি প্রতি ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড থেকে প্রতি বছর কমপক্ষে ৫০টি দরিদ্র পরিবারকে বেছে নিয়ে তাদের একটা করে বড় মশারি ও একটা বড় লেপ দেওয়া যায়, তাহলে তারা দীর্ঘদিনের জন্য মশার আক্রমণ ও শীতের প্রকোপ থেকে রক্ষা পাবে। যদি মশারির মূল্য ৩০০ টাকা ও লেপের মূল্য ৫০০ টাকা হয়, তাহলে এর জন্য প্রয়োজন হবে প্রায় ১৯,৭৪,৬৭,২০,০০০ টাকা বা প্রায় ২০০০ কোটি টাকা। অথবা চিকিত্সাভাতাও দেওয়া যেতে পারে।

৩. কন্যা দায়গ্রস্তদের সাহায্য: যদি দেশের সব ইউনিয়নে প্রতি বছর ১০ জন গরিব মেয়েকে বিয়ের জন্যে ২০ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়, তাহলে বছরে ব্যয় হবে প্রায় ৯১ কোটি ৪২ লাখ টাকা।

৪. ঋণগ্রস্ত কৃষকদের জমি অবমুক্তকরণ: এনজিও, মহাজন ও বিভিন্ন সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে কিস্তি ঠিকমতো পরিশোধ করতে না পারা ভূমিহীন ও গরিব কৃষকদের সহায়তা করা যায়। যদি প্রতি ইউনিয়নে বছরে ১০ জনকে গড়ে ১০ হাজার টাকা করে সাহায্য করা যায়, তাহলে এতে বার্ষিক ব্যয় হবে ৪৫ কোটি ৭১ লাখ টাকা।

৫. দরিদ্র শিশুদের পুষ্টি সাহায্য: টাকার অভাবে দুধ কিনতে অক্ষম, এমন শিশুদের জন্য যদি প্রাথমিক পর্যায়ে প্রতি ইউনিয়ন ও ওয়ার্ডে দুই থেকে পাঁচ বছর বয়সের ১০০ শিশুকে বাছাই করে মাসিক ৪০০ টাকা হারে দুগ্ধভাতা প্রদান করা হয়, সেক্ষেত্রে খরচ হবে প্রায় ২২০ কোটি টাকার মতো।

৬. প্রসবকালীন সহযোগিতা: গর্ভবতী, প্রসূতি মা ও নবজাতকের কল্যাণে যদি ২০টি দরিদ্র পরিবারকে বেছে নেওয়া হয় এবং ৫ হাজার টাকা করে সহযোগিতা দেওয়া যায়, তাহলে বছরে প্রয়োজন হবে ৪৫ কোটি ৭১ লাখ টাকা।

৭. বিধবা/বিকলাঙ্গের কল্যাণ :বিধবা নারীদের ভিক্ষাবৃত্তি দূর করার জন্য প্রাথমিকভাবে দেশের প্রতিটি ইউনিয়ন থেকে যদি কমপক্ষে ২০ জন করে বিধবা-বিকলাঙ্গ পরিবার বেছে নেওয়া হয়, আর এদের প্রত্যেককে মাসিক ১ হাজার টাকা করে সাহায্য করা যায়, তাহলে বার্ষিক প্রায় ১১০ কোটি টাকা লাগবে।

৮. মুসাফিরদের সাহায্য: নিঃস্ব মুসাফিরের জন্যও আমাদের সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে। কারণ এ হলো খোদায়ি বিধান। দেশের শহরগুলির মসজিদ তো বটেই, থানা পর্যায়ের মসজিদেও প্রায়ই নামাজ শেষে দেখা যায় দু-একজন মুসাফির দাঁড়িয়ে যায়, যার সব সম্বল শেষ। চিকিৎসা করতে এসে বাড়ি ফেরার মতো টাকা নেই, কাজের খোঁজে এসে কাজ না পেয়ে ফিরতে হচ্ছে খালি পকেটে অথবা দুর্বৃত্তের খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব খোয়া গেছে। এদের বাড়িতে ফেরার ব্যবস্থা করা আমাদের শরয়ি দায়িত্ব। বাংলাদেশের প্রতিটি থানা শহরে যদি একটি মুসাফিরখানা খোলা হয় এবং প্রতিটি মুসাফিরখানার জন্য মাসিক বাজেট হয় ২০,০০০ টাকা তাহলে বছরে লাগবে ৬৫২–২০,০০০–১২=১৫,৬৪,৮০,০০০ টাকা।

৯. ইয়াতিমদের প্রতিপালন: বাংলাদেশের মতো একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে অসংখ্য ইয়াতিম রয়েছে। যদি ১ হাজার জন ইয়াতিমের একটি প্রতিষ্ঠানের জন্যে মাসিক জনপ্রতি ৫ হাজার টাকা হারে খরচ ধরা হয়, তাহলে বার্ষিক ৬ কোটি টাকা লাগবে।

১০. নওমুসলিম পুনর্বাসন: তাদের সম্মানজনক পুনর্বাসনের জন্য সহযোগিতার উদ্যোগ নেওয়া আমাদের দিনি দায়িত্ব। যদি সারা দেশে প্রতি বছর ১০০টি নওমুসলিম পরিবারকে এ উদ্দেশ্যে ন্যূনতম মাসিক ৫ হাজার টাকা হারে এক বছর ভাতা প্রদান ও কর্ম সংস্থানের জন্য এককালীন ১ লাখ টাকা সাহায্য করা যায়, তাহলে বছরে ব্যয় হবে ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা। এভাবে জাকাতের অর্থ দিয়ে জনকল্যাণমূলক কার্যক্রমটি পরিচালনার জন্য মোট খরচ হবে প্রায় ৪ হাজার ৯৪৬ কোটি টাকা। অন্যদিকে, জাকাতের অর্থ দিয়ে মানবসম্পদ ও অন্যান্য উন্নয়নের জন্যও কিছু প্রকল্প হাতে নেওয়া যেতে পারে, যেমন—দিনি শিক্ষা কার্যক্রম, কারিগরি শিক্ষা কার্যক্রম, গরিব শিক্ষার্থীদের জন্য মাসিক শিক্ষাবৃত্তি চালু, গৃহায়ণ কর্মসূচি, শিক্ষিত বেকারদের জন্য বৃত্তিমূলক কাজের প্রশিক্ষণ ও স্বাবলম্বীকরণ কর্মসূচি ইত্যাদি। বর্তমানে দেশে বেকারের সংখ্যা ২৭ লাখের মতো, এই ২৭ লাখ বেকারদের মধ্য থেকে যদি বছরে ২ লাখের কর্মসংস্থান করে দেওয়া যায় এবং উক্ত কর্মজীবীরা ন্যূনতম ১ লাখ নতুন বেকারদের কর্মোপযোগী করে কর্মসংস্থান করে দেয়, তাহলে আগামী ৯ বছরে বাংলাদেশে কোনোভাবেই বেকার থাকার কোনো আশঙ্কা নেই। দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে পরিচিত গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রি, প্রবাসী শ্রমিক ও কৃষি খাতে দক্ষ জনবলের যোগান দেওয়ার জন্য বিশেষায়িত ও মডেল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দরকার। বাংলাদেশ সরকারের জাকাত বোর্ডকে কার্যকর করার মাধ্যমে এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে জাকাত আদায় বাধ্যতামূলক করে ৩০ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে জাকাত কর্মসূচিকে বেগবান করতে পারলে বাংলাদেশ থেকে স্থায়ীভাবে বেকারত্ব ও দারিদ্র্য দূর করা সম্ভব।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

ইত্তেফাক/এমএএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন