শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

দুর্ঘটনা বাড়াচ্ছে মোটরসাইকেল, লাইসেন্স নেই ১৩ লাখ চালকের

আপডেট : ২১ মে ২০২২, ১০:৫১

উলটো দিক দিয়ে চালানো, হুট করেই গাড়ির সামনে চলে আসাসহ নানা কারণে সড়কে এখন যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে মোটরসাইকেল। দুর্ঘটনার কারণও এই বাহনটি। গত ঈদে মোট দুর্ঘটনার ৪৪ শতাংশ ঘটেছে শুধু এই বাহনটির কারণে। এই কারণে বাড়ছে মৃত্যুও। শুধু ঈদের সময় মারা গেছেন ১৯০ জন মোটরসাইকেল আরোহী। পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৮০০ জনেরও বেশি। অন্য হাসপাতালেও অনেকে ভর্তি হয়েছে।

দেশে ৩৬ লাখ ৫০ হাজার মোটরসাইকেল রেজিস্ট্রেশন দিয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। অথচ এর বিপরীতে ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া চালকের সংখ্যা ২৩ লাখ ৫০ হাজার। অর্থাৎ ১৩ লাখ চালকেরই নেই মোটরসাইকেল চালানোর অনুমোদন। এই পরিস্থিতিতে মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণের কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। একই সঙ্গে বিআরটিএ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে মোটরসাইকেল চালাতে নিরুত্সাহিত করছে।

ঈদযাত্রার শুরুর দিন ২৬ এপ্রিল থেকে কর্মস্থলে ফেরার সময় ১০ মে সময় পর্যন্ত ৩৭২টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪১৬ জন নিহত ও ৮৪৪ জন আহত হয়েছেন। গত বছরের ঈদুল ফিতরের সঙ্গে তুলনা করলে দুর্ঘটনার হার ১৪ দশমিক ৫১ শতাংশ, নিহত ২২ দশমিক ৩৫ শতাংশ এবং আহতের সংখ্যা বেড়েছে ২৬ দশমিক ৩০ শতাংশ বেশি। এবারের ঈদযাত্রায় দুর্ঘটনা ও হতাহতের পরিসংখ্যান তুলে ধরেছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রতিবেদনে দেখা যায়, এবারও দুর্ঘটনার শীর্ষে রয়েছে মোটরসাইকেল। ১৬৪টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৫৬ জন নিহত ও ১১০ জন আহত হয়েছেন। যা মোট সড়ক দুর্ঘটনার ৪৪ দশমিক ০৮ শতাংশ, নিহতের হার ৩৪ দশমিক ৮৫ শতাংশ এবং আহত প্রায় ১৩ দশমিক ০৩ শতাংশ। এ বিষয়ে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন,  করোনা না থাকায় এবারের ঈদে বেশি মানুষ যাতায়াত করেছেন। ঈদযাত্রায় ২৫ লাখ মোটরসাইকেল ও ৪০ লাখ ইজিবাইক রাস্তায় নেমেছে।

দেশে কেন মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার সংখ্যা বাড়ছে জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, উন্নত দেশে মোটরসাইকেল চালানোর সময় বিশেষ পোশাক ব্যবহার করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে সেই রীতি নেই। ফলে এখানে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা বেশি। তার মতে, জরুরি ভিত্তিতে মোটরসাইকেল ও ইজিবাইক আমদানি ও নিবন্ধন বন্ধ করা উচিত। মহাসড়কে অবাধ চলাচল নিয়ন্ত্রণ, আলোকসজ্জার ব্যবস্থা, দক্ষ চালক তৈরি, ধীরগতির যান ও দ্রুতগতির যানের জন্য আলাদা লেনের ব্যবস্থা, চালকদের বেতন ও কর্ম-ঘণ্টা নিশ্চিতের পাশাপাশি মানসম্মত সড়ক নির্মাণ ও মেরামত এবং নিয়মিত রোড সেফটির বিষয়টি অডিট করা দরকার।

সেভ দ্য রোড নামের এক প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঈদুল ফিতরের আগে ও পরের ১২ দিনে সড়কে ঝরেছে ৬৮১ প্রাণ। এর মধ্যে ১৯০ জনের মৃত্যুর কারণ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। বিআরটিএ বলছে, ২০১৮ সালে ৩ লাখ ৯৩ হাজার ৫৪৫, ২০১৯ সালে ৪ লাখ ১৪ হাজার ৫২, ২০২০ সালে ৩ লাখ ১১ হাজার ১৬, ২০২১ সালে ৩ লাখ ৭৫ হাজার ২৫২ এবং চলতি বছরের (২০২২ সাল) শুধু জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে ৮৪ হাজার ৫৮৩টি মোটরসাইকেলের। বিআরটিএ কর্মকর্তারা বলছেন, চালকের লাইসেন্স না থাকলে মোটরসাইকেল নিবন্ধনের কোনো বাধ্যবাধকতা আইনে নেই।

এদিকে নিবন্ধন দিলেও মোটরসাইকেল চালাতে নিরুত্সাহিত করছে বিআরটিএ। গত ৯ মে সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা রোধে ‘সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি’ জারি করে। সেখানে বলা হয়, দেশে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণহানির সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। এর মূলে মোটরসাইকেল। মোটরসাইকেল অপেক্ষাকৃত একটি অনিরাপদ বাহন। তাই মোটরসাইকেলের চালকদের ফুল হাতা শার্ট, ফুল প্যান্ট, কেডস বা জুতাসহ মানসম্মত নিরাপত্তা সরঞ্জাম পরে মোটরসাইকেল চালাতে হবে।

এদিকে ঢাকার জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর) গিয়ে দেখা যায়, দুর্ঘটনা আহত হয়ে যারা চিকিত্সা নিতে এসেছেন, তাদের একটি বড় অংশ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার। প্রতিষ্ঠানটির অধ্যাপক ডা. মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, প্রতিদিন গড়ে ২০০ জন রোগী সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে এ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন। এ বছর তা বেড়েছে, ঈদের সময় দুর্ঘটনার প্রবণতা আরো বেশি হয়েছে। যত রোগী আসছেন, তার মধ্যে ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার হয়ে আসছেন।

বাংলাদেশ রোড সেইফটি ফাউন্ডেশনের হিসাবে, ২০২১ সালে সারা দেশে ৫ হাজার ৩৭১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬ হাজার ২৮৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হন ৭ হাজার ৪৬৮ জন। এসব দুর্ঘটনার মধ্যে ২ হাজার ৭৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ২ হাজার ২১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাতে মোট দুর্ঘটনার মধ্যে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ৩৮ দশমিক ৬৮ শতাংশ এবং মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা মোট নিহতের ৩৫ দশমিক ২৩ শতাংশ। 

ইত্তেফাক/এএইচপি