বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

রবীন্দ্রনাথ ও যাযাবর

আপডেট : ২৭ মে ২০২২, ০৯:৫৪

কখনো কখনো লেখকের নাম উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর উল্লেখযোগ্য সৃষ্টিকর্মটিও এর সঙ্গে উচ্চারিত হয়। যাযাবর তেমনই একজন লেখক। যাযাবর বললেই উচ্চারিত হয় ‘দৃষ্টিপাত’-এর নাম। একজন লেখকের জন্যে এটি পরম প্রাপ্তি। লেখক ও সৃষ্টিকর্ম একইসঙ্গে উচ্চারণের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। সৃষ্টি যখন কাল-উত্তীর্ণ এবং ঘনিষ্টভাবে জনমানুষকে স্পর্শ করে তখনই এই যৌথ উচ্চারণ ঘটে।

বই আকারে প্রকাশের আগে ১৯৪৫ সাল থেকে ‘দৃষ্টিপাত’ মাসিক বসুমতীতে ধারাবাহিক প্রকাশিত হয়। বই হয়ে প্রকাশিত হয় ১৯৪৬ সালের ডিসেম্বরে। প্রকাশক নিউ এজ পাবলিশার্স লি.। ‘দৃষ্টিপাত’ গ্রন্থে সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতা, তৎকালীন উত্তাল সময়কে চমত্কার ঢংয়ে চিত্রায়িত করা হয়েছে। যাযাবরের রসবোধ ছিল অসাধারণ। সবমিলিয়ে ‘দৃষ্টিপাত’ শুরু থেকেই পাঠকপ্রিয় ও নন্দিত ছিল।

যাযাবর মূলত ছদ্মনাম। লেখকের প্রকৃত নাম বিনয় মুখোপাধ্যায়। দীর্ঘ ৩৮ বছর সাহিত্যচর্চায় তিনি বই লিখেছেন মাত্র আটটি। ‘দৃষ্টিপাত’ ছাড়া যাযাবর নামে অন্য পাঁচটি গ্রন্থ হলো: জনান্তিক (১৯৫২), ঝিলম নদীর তীর (১৯৫৪), লঘুকরণ (১৯৬৪), হ্রস্ব ও দীর্ঘ (১৯৭৩) এবং যখন বৃষ্টি নামল (১৯৮৩)। বিনয় মুখোপাধ্যায় নামে তাঁর দুটি গ্রন্থ রয়েছে— খেলার রাজা ক্রিকেট (১৯৫৩) ও মজার খেলা ক্রিকেট (১৯৫৩)। বাংলাদেশ ও ভারতে প্রথমবারের মতো ক্রিকেট নিয়ে এ দুটি গ্রন্থই প্রকাশিত হয়। সে কারণে যাযাবরকে ক্রিকেট-সাহিত্যের জনক বলা হয়ে থাকে।

ব্যক্তিজীবনে যাযাবর পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে জ্যেষ্ঠ ছিলেন। তাঁর জন্মস্থান ও সাল নিয়ে একাধিক তথ্য পাওয়া যায়। ১৯৮২ সালে প্রকাশিত ‘নিজস্ব নির্জন’ গ্রন্থে কল্যাণকুমার দাশগুপ্ত জানান, ‘যাযাবর’ (১৯০৯)। পূর্ববঙ্গে জন্ম। শিক্ষাজীবন প্রধানত কুমিল্লার চাঁদপুরে কেটেছে।’ ১৯৭৯ সালে প্রকাশিত হয় ‘রাজধানীর গল্প’ সংকলন। এ গ্রন্থসূত্রে জানা যায়, ‘যাযাবরের জন্ম ১৯১২ সালে। বাংলাদেশের চাঁদপুরে।’ অন্যদিকে ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস প্রসঙ্গ’ গ্রন্থে আজহার ইসলাম লিখেছেন, ‘যাযাবর (বিনয় মুখোপাধ্যায়, জন্ম ১৯১২)। জন্মস্থান ঢাকা জেলার অন্তর্গত বিক্রমপুর।’ যাযাবরের জন্ম সম্পর্কে তাঁর ভাতিজি সুস্মিতা রায়ের ভাষ্যে, যাযাবরের জন্ম ১৯০৯ সালের ১ জানুয়ারি। অন্যদিকে যাযাবর গবেষক অমলেশ পাত্র লিখেছেন, ‘যাযাবরের জন্ম তারিখটি ছিল ১১ই জানুয়ারি ১৯০৯।’

তবে এটা নিশ্চিত যাযাবরের শৈশব ও কৈশোর কেটেছে চাঁদপুরে। তাঁর বাবা ফণিভূষণ মুখোপাধ্যায় চাঁদপুরের একটি জুটমিলের ‘বড়বাবু’ ছিলেন। যাযাবর গবেষক অমলেশ পাত্র জানান, যাযাবর ১৬-১৭ বছর বয়স পর্যন্ত চাঁদপুরের আলো-ছায়ায় বেড়ে ওঠেন। তাঁর শৈশবের নদী ছিল পদ্মা-মেঘনা-ডাকাতিয়া। তিনি হাসান আলী জুবলী স্কুলে পড়াশোনা করেন। সার্বিক তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে ধারণা করা যায়, যাযাবরের জন্ম ১৯০৯ সালে, চাঁদপুরে হয়েছিল। তাই শৈশব থেকেই তিনি এখানে বেড়ে উঠেছিলেন। তাঁর পৈত্রিক নিবাস অন্যত্র হতে পারে। যাযাবর চাঁদপুরের সন্তান— এ কথা বহু বছর ধরে চাঁদপুরবাসীর মুখে মুখে ছড়িয়ে আছে। শহরের পুরাণবাজার ডিগ্রি কলেজে ‘যাযাবর ভবন’ রয়েছে। জানা যায়, এ স্থানে যাযাবর কয়েকবছর বাস করেছেন।

রবীন্দ্রনাথের রচনার সঙ্গে যাযাবরের পরিচয় তাঁর শৈশবকাল থেকেই। এ কারণ তিনি বেড়ে উঠেছিলেন রাবীন্দ্রিক পরিমণ্ডলে। যাযাবরের বাবা ফণিভূষণ মুখোপাধ্যায় নিজেও লেখালেখি করতেন। বিবেকরঞ্জন ভট্টাচার্য তাঁর ‘দেহলি প্রান্তে (১৯৬৬) গ্রন্থে জানান, ‘যাযাবর সাহেবের সাহিত্যপ্রীতি এসেছে বংশগতভাবে। তাঁর পিতৃদেব স্বর্গত ফণিভূষণ মুখোপাধ্যায় তদানীন্তন কালের সমগ্র পত্র-পত্রিকাতেই রীতিমতভাবে প্রকাশিত করতেন আপন রচনা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তাঁর উদ্দেশ্যে কোনো বিখ্যাত কবিতা রচনা করেন।’ যাযাবর এ সম্পর্কে লিখেছেন, তাঁর পরিবারের সঙ্গে রবীন্দ্রানুরাগ ছিল অঙ্গীভূত। তাঁর বাবা নোবেল পাওয়ার পূর্ব থেকে রবীন্দ্রনাথের ভক্ত ছিলেন। মা মনোরমা দেবীর কাছে যাযাবর শুনতেন রবীন্দ্র-সাহিত্যের গল্পকাহিনি। শৈশবেই বাড়ির আলমারিতে দেখেছেন ‘নৌকাডুবি’, ‘বউঠাকুরাণীর হাট’, হিতবাদী প্রকাশিত ‘রবীন্দ্রগ্রন্থাবলী’। যাযাবরের স্ত্রী দুর্গা মুখোপাধ্যায়ও রবীন্দ্র-অনুরাগী ছিলেন।

সাহিত্যিক চারুচন্দ্র বন্দ্যােপাধ্যায়ের সান্নিধ্য পেয়েছেন যাযাবর। রবীন্দ্র-জন্মোত্সবের সভাপতি হিসেবে তিনি চাঁদপুরে এসেছিলেন। যাযাবর সে সময় কিশোর। তিনি আলাপ করলেন চারুচন্দ্রের সঙ্গে। আলাপের বিষয়— রবীন্দ্রনাথ। চারু বন্দ্যােপাধ্যায় সেই আলাপে যাযাবরকে ‘কিছু চিত্তাকর্ষক কাহিনি’ শোনান।

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে যাযাবরের প্রথম পরিচয় গ্রন্থসূত্রে হলেও তাঁকে প্রথম দেখেছেন ১৯৩০ সালে। রবীন্দ্রনাথ ট্রেনে করে কলকাতা থেকে মাদ্রাজ যাবেন। এ তথ্য জেনে কলেজ ফাঁকি দিয়ে উপস্থিত হলেন হাওড়া স্টেশনে। ভাগ্য সুপ্রসন্ন যেন। এই প্রথমবারের মতো সরাসরি দেখতে পেলেন কবি রবীন্দ্রনাথকে।

পরবর্তীকালে যাযাবর রবীন্দ্রনাথকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন, কথা বলেছেন তাঁর সঙ্গে। সাংবাদিক হিসেবে তাঁর সাক্ষাত্কারও নিয়েছেন। সাক্ষাৎকার নেয়ার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে যাযাবর লিখেছেন: ‘যথার্থ কবিসন্দর্শন ঘটে সাংবাদিক জীবনে। কলকাতায় তখন এআইসিসি-র মিটিং। সেখানে মুসলমানদের আপত্তি মেটাতে বন্দেমাতরম গানের বারো আনা ছেটে ফেলার সিদ্ধান্ত হয়। প্রকাশ যে, রবীন্দ্রনাথ এই খণ্ডিত জাতীয় সংগীত অনুমোদন করেছেন। বেশির ভাগ খবরের কাগজে সমালোচনার ঝড় উঠল। হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ সম্পাদিত দৈনিক বসুমতীর আক্রমণ ছিল সবচেয়ে উগ্র ও অশালীন। বঙ্কিমের প্রতি বিদ্বেষ, নিজের গান চালাবার চেষ্টা এমনি আরো অনেক দুরভিসন্ধি আরোপ করে কবির নিন্দা, কুৎসার আর সীমা-পরিসীমা রইল না। রবীন্দ্রনাথ ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোডে মহলানবিশ দম্পতির অতিথি। সাংবাদিকতার তাগিদে সেখানে উপস্থিত হলাম। সঙ্গে সম্পাদক বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায় ও সাহিত্যিক প্রবোধ স্যানাল। বন্দেমাতরমের সুরটি যে রবীন্দ্রনাথকৃত, সেকথা সেদিন কবির কাছ থেকেই জেনেছিলাম। অনেকক্ষণ ধরে অনেক কথা হয়েছিল। জীবনের নানা পর্বে দেশবাসীর ঔদাসীন্যের কথা বিরূপতার কথা। বক্তা কবি প্রায় একক। শ্রোতা শ্রদ্ধাবনত চিত্তে তিনটি তথ্যান্বেষী তরুণ। নানা দিক থেকে অকারণ অভদ্র আক্রমণে কবিগুরু অত্যন্ত বিচলিত হয়েছিলেন। একদিন হূদয়ের গভীর আবেগে লিখেছিলেন, সার্থক জনম মাগো জন্মেছি এ দেশে। তিক্তকণ্ঠে বললেন, যাবার আগে ঐ লাইনটি কেটে দিয়ে যাবেন।’

যাযাবর একসময় কিছু গান লিখেছেন। তাঁর একাধিক গান কিংবদন্তি গায়ক শচীন দেববর্মণ গেয়েছেন। গান লেখার পেছনে তাঁকে উদ্দীপনা জুগিয়েছে রবীন্দ্রনাথ ও অতুলপ্রসাদের গান।

যাযাবর সাংবাদিকতার সঙ্গে আজীবন যুক্ত ছিলেন। শুরুর দিকে ‘আর্থিক জগৎ’ পত্রিকায়, পরবর্তীকালে ‘অমৃতবাজার’ ও ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় কাজ করেছেন। পরবর্তীকালে ১৯৪২ সাল থেকে ৫ বছর ব্রিটিশ প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরোর প্রিন্সিপাল সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেন। যাযাবর কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের ডিরেক্টরেট অব অ্যাডভারটাইজিং অ্যান্ড ভিসুয়াল পাবলিসিটি এবং রেজিস্ট্রার অব নিউজ পেপারস— সংস্থা দুটির প্রধান ছিলেন। ইন্ডিয়ান ইনফরমেশন সার্ভিসের ডেপুটি অফিসার হিসেবে তিনি অবসর নেন। সাংবাদিক হিসেবে কাজ করতে গিয়ে যাযাবর রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও মহাত্মা গান্ধী, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল, জওহরলাল নেহেরু, ইন্দিরা গান্ধী প্রমুখকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পান।

যাযাবর উপন্যাস, ছোটগল্প, সংগীত, নাটকের মতো বৈচিত্র্যপূর্ণ শাখায় লিখেছেন। তবে তাঁর লেখা ও জীবনে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব ছিল দৃশ্যমান। গবেষক অমলেশ পাত্র লিখেছেন, ‘যাযাবরের চিন্তা-চেতনা-অনুভবে, জীবন ও মননে যে সাহিত্যিকের প্রভাব সবচেয়ে বেশি তিনি রবীন্দ্রনাথ। পরোক্ষ হলেও রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের মহত্ অনুপ্রেরণা। যাযাবরের সাহিত্যেও বারবার দেখা গেছে রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রসাহিত্য-সংগীতের নানা অনুষঙ্গ। রবীন্দ্রনানুরাগ তাঁর জীবনের গভীরতর দিক।’ যাযাবর তাঁর সাধনার স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন নরসিংহ দাস স্মৃতি পুরস্কার (১৯৫০) ও বিদ্যাসাগর স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯৮)। বরেণ্য এ সাহিত্যিক ২০০২ সালে মৃতু্যবরণ করেন।

ইত্তেফাক/এসজেড

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন