শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছেই

আপডেট : ২৮ মে ২০২২, ০৭:০০

নিত্যপণ্য নিয়ে ভোগাস্তি যেন পিছু ছাড়ছে না। চাল, ডাল থেকে শুরু করে তেল, চিনি আটা, ময়দা, দুধ, ডিম, মসলা সবকিছুর দাম বাড়তি। এতে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে স্বল্প আয়ের মানুষ। খরচের বাজেট বারবার কাটছাঁট করেও হিসাব মেলাতে পারছেন না তারা। হিমশিম খাচ্ছেন সংসার চালাতে।

সরকারের বিপণন সংস্হা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, এক বছর আগে প্রতি কেজি খোলা ময়দা ৩৫ টাকায় বিক্রি হলেও এখন তা বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকায়। ৩২ টাকা কেজির প্যাকেট আটা বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকায়। বছরখানেক আগেও বড়দানা মসুর ডালের কেজি ছিল ৭০ টাকার মধ্যে। সেই ডালই এখন ১১০ টাকা ছাড়িয়েছে। আর ছোটদানা মসুর ডালের কেজি ১৪০ টাকা। তেল নিয়ে যা ঘটছে তাতে ভোক্তারা আতঙ্কিত। স্বল্প আয়ের মানুষের আমিষের জোগানের সবচেয়ে বড় উত্স ডিম ও ব্রয়লার মুরগি। সেই ডিমের দাম গত এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ৩০ দশমিক ৬৫ শতাংশ। আর ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়েছে ২২ শতাংশের বেশি। এদিকে এখন বোরো মৌসুম শুরু হলেও বাজারে চালের দাম বাড়ছে। সব মিলিয়ে ভালো নেই স্বল্প আয়ের মানুষ।

ব্যবসায়ীরা বলেছেন, দেশে নিত্যপণ্যের চাহিদার একটি বড় অংশ আমদানি করে মেটাতে হয়। করোনা মহামারি-পরবর্তী অবস্হা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ বিভিন্ন কারণে বিশ্বে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। বেড়েছে পরিবহনসহ অন্যান্য ব্যয়ও। ফলে আমদানিকৃত ভোগ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে।

ছবি: ইত্তেফাক

তারা জানান, গত ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া, ইউক্রেনে হামলার পর দেশ দুটি থেকে আর গম আমদানি করা যায়নি। এরপর দেশের ব্যবসায়ীরা গম আমদানিতে ভারতমুখী হলেও এখন দেশটিও গম আমদানি বন্ধ করেছে। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দেশটি তার উত্পাদিত সূর্যমুখী তেল রপ্তানি করতে পারছে না। এর প্রভাব পড়েছে সয়াবিন, পাম অয়েলের ওপর। তবে ইন্দোনেশিয়া তার অভ্যন্তরীণ বাজারে তেলের সরবরাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় গত সোমবার পাম অয়েল রপ্তানির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে। আশা করা হচ্ছে, দেশের বাজারে এর প্রভাব পড়বে।

গতকাল শুক্রবার রাজধানীর কাওরান বাজার, শান্তিনগর ও তুরাগ এলাকার নতুন বাজারে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, প্রধান প্রধান যে নিত্যপণ্যগুলো রয়েছে, তার প্রায় সবগুলোর দামই চড়া। গতকাল বাজারে প্রতি কেজি খোলা সাদা আটা ৪৩ থেকে ৪৫ টাকা, প্যাকেট আটা ৪৮ থেকে ৫০ টাকা, খোলা ময়দা ৫৮ থেকে ৬০ টাকা, প্যাকেট ময়দা ৬৫ থেকে ৬৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু এক বছর আগে তা যথাক্রমে ৩০ থেকে ৩২ টাকা, ৩২ থেকে ৩৫ টাকা, ৩৫ থেকে ৩৬ টাকা ও ৪০ থেকে ৪৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। টিসিবি তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে আটার দাম ৪৬ দশমিক ২৭ শতাংশ ও ময়দার দাম ৬৬ দশমিক ২০ শতাংশ বেড়েছে। গত এক বছরে ৪০ শতাংশের বেশি দাম বেড়েছে, এমন পণ্যের মধ্যে আরো রয়েছে ভোজ্য তেল ও মসুর ডাল।

এক বছর আগে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেলের দাম ১২৪ থেকে ১২৬ টাকায় বিক্রি হলেও গতকাল তা ১৮২ থেকে ১৯০ টাকায় বিক্রি হয়। আর এক বছর আগে পাম অয়েলের দাম ছিল ১১০ থেকে ১১৪ টাকা লিটার, যা গতকাল রাজধানীর খুচরা বাজারে ১৭০ থেকে ১৭২ টাকায় বিক্রি হয়। এই পণ্যটির দাম বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ৪৮ দশমিক ৮০ শতাংশ থেকে ৫০ দশমিক ৪৫ শতাংশ। বছরের ব্যবধানে মসুর ডালের দামও বেড়েছে ৪০ শতাংশের বেশি।

গতকাল বাজারে বড়দানা মসুর ডাল ১০৫ থেকে ১১০ টাকা ও ছোটদানা মসুর ডাল ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়। যা এক বছর আগে ছিল যথাক্রমে ৭০ থেকে ৮০ টাকা ও ১০০ থেকে ১১০ টাকা। মসুর ডালের পাশাপাশি দাম বেড়েছে অ্যাংকর ডালেরও। বছরের ব্যবধানে ৩৮ দশমিক ৮৯ শতাংশ বেড়ে বর্তমানে খুচরা বাজারে প্রতি কেজি অ্যাংকর ডাল বিক্রি হচ্ছে ৫৫ থেকে ৭০ টাকায়।

স্বল্প আয়ের মানুষের আমিষের চাহিদার মেটানোর বড় উত্স ব্রয়লার মুরগি ও ডিম। এই দুটি পণ্যের দামও বছরের ব্যবধানে যথাক্রমে ২২ দশমিক ৪৫ শতাংশ ও ৩০ দশমিক ৬৫ শতাংশ বেড়েছে। গতকাল বাজারে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি ১৫০ থেকে ১৬০ টাকায় বিক্রি হয়, যা এক বছর আগে ছিল ১২০ থেকে ১২৫ টাকা। একইভাবে ৩০ টাকা হালির ডিম বছরের ব্যবধানে এখন বিক্রি হচ্ছে ৪৩ থেকে ৪৫ টাকা হালিতে।

ছবি: সংগৃহীত

গত এক বছরের ব্যবধানে মসলার দামও বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। ১১ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে—এমন মসলার মধ্যে রয়েছে এলাচ, পিঁয়াজ, রসুন, আদা, জিরা, শুকনা মরিচ, হলুদ, লবঙ্গ ও তেজপাতা। শুধু তা-ই নয়, এই সময়ে সব ধরনের গুঁড়োদুধের দামও ১০ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ১৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। এখন বোরো মৌসুম। এই সময়ে চালের দাম বাড়ায় মানুষের কষ্ট যেন আরো বেড়েছে।

সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি কেজি চালে এক থেকে দুই টাকা বাড়তি। কিন্তু কেন? এখন চালের দাম বাড়ার কারণ কী? পাহাড়ি ঢলে হাওরের ফসল তলিয়ে যাওয়া, সম্প্রতি অতি বৃষ্টিতে জমিতেই ধান পচে যাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী চাল উত্পাদন না হওয়ার আশঙ্কা করছে সংশ্লিষ্ট সূত্র। কৃষি মন্ত্রণালয় বলেছে, অতিবৃষ্টি, ঝড় ও পাহাড়ি ঢলে ৭৮ হাজার ৯৮৭ টন চাল নষ্ট হবে। আর এর সুযোগ নিয়ে একটি অসাধু ব্যবসায়ী চক্র।

গত এক বছরের এভাবে ক্রমাগত খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ায় সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছে স্বল্প আয়ের মানুষ। যেহেতু শ্রমজীবী মানুষের আয়ের বড় অংশই যায় খাদ্য কিনতে। তাই আয় না বাড়ায় সীমিত আয় দিয়ে তারা তাদের প্রয়োজনীয় খাদ্য কিনতে হিমশিম খাচ্ছে।

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা ফারুক হোসেন গতকাল ইত্তেফাককে বলেন, এক বছর আগেও তিনি যে বেতন পেতেন তা দিয়ে সাড়ে ৭ হাজার টাকা ভাড়ায় ছোট্ট দুই রুমে পরিবার নিয়ে থাকতে পারতেন। কিন্তু সব জিনিসের দাম এতটাই বেড়েছে যে, সেই বেতনে সংসারের চাকা আর ঘুরছে না। মাসের ১৫ দিন পর হাতে আর কোনো টাকাই থাকছে না।

খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্র বলেছে, বর্তমানে সরকারের গুদামে ১০ লাখ টন চাল মজুত আছে। এছাড়া বোরোতে অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে চাল সংগ্রহ করা হবে। তবে গমের মজুত কম আছে। সূত্র জানিয়েছে, গমের মজুত কম থাকলেও ভারত থেকে গম আমদানির বিষয়ে আলোচনা চলছে।

এ প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, রাশিয়া, ইউক্রেন ও ভারত গম রপ্তানি বন্ধ করলেও সরকার আরো পাঁচটি দেশ থেকে গম আমদানির পথ খুঁজছে। ইতিমধ্যে কানাডার হাইকমিশনারের সঙ্গে গম আমদানির বিষয়ে কথা হয়েছে। তাই গম নিয়ে কোনো ধরনের সমস্যা হবে না। এছাড়া ইন্দোনেশিয়া পাম অয়েল রপ্তানির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ায় আশা করছি, তেলের দামও কমে আসবে।

ইত্তেফাক/বিএএফ

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন