শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

শেষকৃত্য নিয়ে কেন এত ভয়

আপডেট : ৩০ মে ২০২২, ০৯:৫৫

কয়েক দিন আগের কথা। সদ্য নিহত আলজাজিরার সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহের জানাজা পূর্ব জেরুজালেমে অনুষ্ঠিত হয়। ফিলিস্তিনি আমেরিকান এই সাংবাদিক পশ্চিম তীরের জেনিন শহরে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে ১১ মে ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে নিহত হন। তাকে উদ্দেশ্য করে ইসরায়েলি পুলিশ গুলি ছোড়ে বলে ফিলিস্তিনিদের তদন্তে দেখা গেছে।

তার জানাজায় হাজার হাজার লোক অংশ নেয়। সমাবেশটি যাতে ঠিকমতো হতে না পারে সেজন্য ইসরায়েলি কতৃ‌র্পক্ষ যথাসাধ্য চেষ্টা চালায়। কফিন বহনকারী ব্যক্তিদের ওপর তারা চড়াও হয়। নিহত সাংবাদিকের ভাই আন্তন আবু আকলেহকে দেখা গেছে, জানাজার আয়োজনকারীদের যেন প্রহার করা না হয়, সেজন্য ইসরায়েলি পুলিশকে তিনি বিনীত অনুরোধ করছেন। কিন্তু তার অনুরোধে সাড়া দেয়নি পুলিশ।

শিরিন আকলেহ নিহত হওয়ার ঘটনা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সাড়া ফেলেছে। গুলিবিদ্ধ অবস্হায় মাটিতে পড়ে থাকা তার মৃতদেহের ভিডিও বহির্বিশ্বেও ক্ষোভ তৈরি করে। এমনকি ইসরায়েলের সমর্থক অনেকেও এই ঘটনায় শোক প্রকাশ করে। একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, ইসরায়েলি স্নাইপারের গুলিতে তিনি মারা গেছেন। তবে ইসরায়েলের দাবি, ফিলিস্তিনিদের বন্দুকযুদ্ধে তার মৃত্যু হয়ে থাকতে পারে।

দেশটির একটি মানবাধিকার সংস্হা অবশ্য সরকারের এমন দাবি প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, সৈন্যদের গুলিতেই তার মৃত্যু হয়েছে। ইসরায়েল সরকারিভাবে এর কোনো তদন্ত শুরু করেনি। দেশটির কতৃ‌র্পক্ষ আরও দাবি করে নিহতের পরিবারের নিরাপত্তার স্বার্থেই পুলিশকে সমাবেশে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছিল। তবে আন্তন আকলেহ তাদের এই বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বলেছেন, সেখানে এমন কিছু ঘটেনি যে পুলিশকে হস্তক্ষেপ করতে হবে।

সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহের জানাজায় ইসরায়েলি পুলিশের লাঠিচার্জ। ছবি: সংগৃহীত

বিশ্বের বিভিন্ন সংঘাতপ্রবণ এলাকাগুলোতে শেষকৃত্য আয়োজন একটি ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। কতৃ‌র্পক্ষ এ থেকে নতুন করে বিক্ষোভ শুরুর আশঙ্কায় থাকে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্হিতি কোনদিকে গড়ায়, সেটি নিয়ে তাদের উদ্বেগে থাকতে হয়। এসব অনুষ্ঠানে কতৃ‌র্পক্ষের বিরুদ্ধে নতুন আন্দোলনের ডাক দেওয়ার পাশাপাশি বিরোধী গ্রুপগুলো সাধারণ মানুষকে দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করে। এই কারণে কতৃ‌র্পক্ষ চেষ্টা করে সমাবেশগুলোতে যেন কম লোক সমাগম হয়।

শিরিন আকলেহ কোনো জঙ্গি, সন্ত্রাসী অথবা কোনো মিলিশিয়া গ্রুপের সদস্য ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন অভিজ্ঞ সাংবাদিক। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যিনি প্রায় তিন দশক ধরে কভার করেছেন। ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে মৃত্যু তাকে যেন পরিণত করেছে ফিলিস্তিনি মুক্তিসংগ্রামের নতুন আইকনে। সেজন্য ইসরায়েল তার জানাজা অনুষ্ঠানকে তাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি বিবেচনা করে। সমাবেশ থেকে যারা ফিলিস্তিনিদের পক্ষে স্লোগান দেয়, তাদের গ্রেফতার করে। ইসরায়েলের কতৃ‌র্পক্ষ শুরু থেকেই ইচ্ছাকৃতভাবে সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করেছে কি না বিষয়টি পরিষ্কার না হলেও আন্তন বলেছেন, তাকে এক দিন আগেই সতর্ক করে বলা হয়েছিল—ওই সমাবেশে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে স্লোগান অথবা পতাকা প্রদর্শন করা যাবে না। তিনি মনে করেন, সমাবেশে বাধা দেওয়ার সম্ভবত এটিই প্রধান কারণ। পুলিশ ফিলিস্তিনিদের কাছ থেকে পতাকা কেড়ে নিয়ে ছিঁড়ে ফেলে।

ইসরায়েলের সাবেক ডেপুটি জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এরান লেরমান বলেছেন, ফিলিস্তিনিদের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানগুলো থেকে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে শঙ্কা রয়েছে। এর ফলে সন্ত্রাসীদের মৃত্যু শাহাদাত হিসেবে দেখানোর অবকাশ থাকে। তবে শিরিন আকলেহের ঘটনাটি এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক নয় বলে তিনি মন্তব্য করেন। ১৯৯০-এর দশকে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন শান্তি প্রক্রিয়ায় মধ্যস্হতাকারী মার্কিন কূটনীতিক ডেনিস রস বলেন, ‘দ্বিতীয় ইন্তিফাদার সময় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সহিংসতা ছড়ানোর কাজে যে কোনো বড় শেষকৃত্য সমাবেশ ব্যবহারের একটি প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রধান জোসেফ বোরেল শিরিন আকলেহের জানাজার সমাবেশে ইসরায়েলের সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেন, এই ঘটনায় তারা ‘আতঙ্কিত’। অন্যদিকে হোয়াইট হাউজের প্রেস সেক্রেটারি জেন সাকি বলেছেন, এই ঘটনায় তারা স্পষ্টতই অসুখী।

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিক্রিয়া যা-ই হোক, এসব সমাবেশ থেকে ফিলিস্তিনিরা নতুন করে আন্দোলন শুরু করে কি না সেটা নিয়ে ইসরায়েল বেশি উদ্বিগ্ন। শিরিন আকলেহের জানাজার দিন কয়েক পরেই ২১ বছর বয়সী ফিলিস্তিনি ওয়ালিদ আল শরিফের জানাজা হয়। শরিফ গত মাসে আলআকসায় কম্পাউন্ডে ইসরায়েলি বাহিনীর নির্যাতনে গুরুতর আহত হওয়ার পর মারা যান। ইসরায়েলের মানবাধিকার গ্রুপ বিটিসেলেমের মুখপাত্র দ্রর সাদোত বলেন, শিরিন আকলেহের শেষকৃত্যে ইসরায়েল যা করেছে, সেটি দেশটির দীর্ঘদিনের অনুসৃত একটি পদ্ধতি। ওই মানবাধিকার গ্রুপটি গত কয়েক বছরে এরকম বেশ কিছু ঘটনার তথ্য সংগ্রহ করেছে। আলজাজিরার তথ্য মতে, ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে ২০০০ সাল থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ৪৫ জন সাংবাদিক প্রাণ হরিয়েছেন।

ইত্তেফাক/টিএ