বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

সিন্ডিকেট থেকে মুক্ত হয়নি পুলিশের পদোন্নতি

আপডেট : ১১ জুন ২০২২, ০০:২১

পুলিশের পদোন্নতিতে সিন্ডিকেট থেকে মুক্তি মিলছে না। এ কারণে এই বাহিনীতে পদোন্নতি বঞ্চিতরা কাজে কর্মস্পৃহা হারিয়ে ফেলছেন। নিয়ম অনুযায়ী জ্যেষ্ঠতা, অভিজ্ঞতা, যোগ্যতা, সততা, নিষ্ঠা, পেশাদারিত্ব ও এসিআর রিপোর্টের ভিত্তিতে পদোন্নতি হওয়ার কথা। কিন্তু অতি দলবাজদের নিয়ে গঠিত বিশেষ সিন্ডিকেটের কারণে পদোন্নতি বঞ্চিত হচ্ছেন অনেকে। জিয়াউর রহমানের আমলে এই অবস্থা প্রথম শুরু হয়। এরপর এইচ এম এরশাদ, খালেদা জিয়াসহ বর্তমান সরকারের আমলেও সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে পদোন্নতি। কোনো ব্যাচের ১০ নম্বর কর্মকর্তার পদোন্নতি পাওয়ার কথা থাকলেও পাচ্ছেন ৪৯তম কর্মকর্তা। আবার এক নম্বরকে না দিয়ে ১০ নম্বরকে পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে। এভাবে সুপারসিড হওয়া কর্মকর্তারা হতাশায় ভুগছেন। ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়াও প্রকাশ করছেন অনেকে।

বর্তমান আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ পুলিশে ১২৩টি নতুন পদ সৃষ্টি করেছেন। এছাড়া এ বছর ডিআইজি পদে ৩২ জন ও অতিরিক্ত ডিআইজি পদে ১১৯ জন পদোন্নতি পেয়েছেন। অতিরিক্ত এসপি থেকে এসপি পদে পদোন্নতি পান ৩৩ জন। ১৮তম ব্যাচ থেকে ১৬, ২০তম ব্যাচ থেকে ১৬ জন অতিরিক্ত ডিআইজি পদ থেকে ডিআইজি পদে পদোন্নতি পেয়েছেন। এসপি থেকে অতিরিক্ত ডিআইজি হয়েছেন ১৮তম ব্যাচ থেকে তিন জন, ২০তম ব্যাচ থেকে ৪৩ জন, ২১তম ব্যাচ থেকে ৩৭ জন, ২২তম ব্যাচ থেকে ৩০ জন, ২৪তম ব্যাচ থেকে ছয় জন। আরো পদোন্নতি হতে পারে বলে পুলিশের এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান। দীর্ঘদিনের পদোন্নতি জটিলতা কেটে গেছে। পুলিশে এত নতুন পদ সৃষ্টি ও পদোন্নতি অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। তবে হতাশ পদোন্নতি বঞ্চিতরা। অভিজ্ঞ পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, পুলিশ অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আর যখন সেই বাহিনীতে হতাশা বিরাজ করে তখন তাদের কাছ থেকে আশানুরূপ সেবা পাওয়া যায় না।

তাদের মধ্যে অনেকেরই মানসিক অবস্থা এমন—‘পদোন্নতি বঞ্চিত হলাম তাহলে ঘুষ খাই এটাই ভালো। ভালো কাজ করে লাভ কি? পদোন্নতি পাইনি, টাকা কামাই।’

এ ধরনের অবস্থা অতীতেও সব সরকারের আমলেই ছিল। পুলিশ বাহিনীতে রয়েছে কতিপয় বিতর্কিত অফিসার, যারা অতি দলবাজ। অপরদিকে একশ্রেণির অফিসার আছেন যারা বিভিন্ন দুনী‌র্তি ও অনিয়মের সঙ্গে জড়িত। তারা যে সরকার ক্ষমতায় আসে তাদের দলীয় লোক সেজে অপকর্ম থেকে রক্ষা পায় এবং পদোন্নতিসহ সুযোগ-সুবিধা বাগিয়ে নেয়। প্রায় আড়াই লাখ পুলিশ সদস্যের মধ্যে এসব দলবাজ সুবিধাভোগীদের সংখ্যা খুবই সীমিত। কিন্তু এদের অপকর্মের প্রভাব পড়ে পুরো বাহিনীতে। অপরদিকে সরকারের ভাবমূর্তিও তারা ক্ষুণ্ণ করছে। তাদের কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে হতাশা বেড়ে যাচ্ছে।

বিএনপি সরকারের আমলে আলোচিত ‘কোহিনুর মার্কা’ পুলিশ অফিসারদের কর্মকাণ্ডের কারণে তৎকালীন সরকার চরম বিরক্ত ছিল। ঐ সময় পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি তলানিতে চলে যায়। বর্তমান সরকারের আমলেও এই ধরনের কিছু কিছু কর্মকর্তা গজিয়েছে। এদের দাপটে পুলিশ বাহিনীর অনেক শীর্ষ ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তা বিরক্ত। এই সরকারের আমলে পদোন্নতি, আর্থিক সুবিধা, পদমর্যাদা, লজিস্টিক সাপোর্ট দিয়ে পুলিশ বাহিনীর সকল ক্ষেত্রে আধুনিকায়ন করা হয়েছে। তবে এই বাহিনী ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার ক্ষেত্রে যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, সততা, নিষ্ঠা ও সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে সর্বাধিক গুরুত্ব না দিলে এই আধুনিকায়ন ধরে রাখা কঠিন হবে অভিজ্ঞ সিনিয়র কর্মকর্তারা মনে করেন।

তাদের মতে, পুলিশ বাহিনীতে কথিত দলবাজ ও সুবিধাভোগীদের গুরুত্ব দিয়ে লাভ নেই। এদেরকে গুরুত্ব দিলে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হবে, পুলিশও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এরা শুধু নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত থাকে। সিনিয়র কর্মকর্তাদের অনেকেই বলেন, বর্তমান সরকার পুলিশকে যে সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে তাতে সকল পুলিশ সদস্য সরকারের কাছে কৃতজ্ঞ। সেক্ষেত্রে দলবাজদের প্রাধান্য দেওয়া উচিত নয় বলে তারা মনে করেন।

তারা জানান, দলবাজ ও সুবিধাভোগীদের গুরুত্ব দেওয়ায় বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত বিতর্কিতরাও কয়েক জন পদোন্নতি পেয়েছেন। নিয়ম অনুযায়ী পুলিশে পদোন্নতি প্রস্তাব, বাৎসরিক গোপনীয় প্রতিবেদন, যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, নিষ্ঠা, সততা ও মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষসহ সর্বোপরি সবকিছু পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবেচনায় নিয়ে পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে পদোন্নতির প্রস্তাব দেওয়া হয়ে থাকে। কিন্তু সেই প্রস্তাব বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পরিবর্তিত হয়ে যায়। সেখানেই সুযোগ পায় দলবাজ ও সুবিধাভোগীরা। তবে এর পেছনে মোটা অঙ্কের বাণিজ্যও হয়। এরাই পুলিশকে ঘুষখোর বানায়।

পুলিশের সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ বলেন, পুলিশে জ্যেষ্ঠতা, অভিজ্ঞতা, যোগ্যতা, সততা, নিষ্ঠা ও পেশাদারিত্বের ভিত্তিতে পদোন্নতি হওয়া উচিত। কিন্তু যখন কোনো ব্যাচের ১০ নম্বরকে বাদ দিয়ে ৪৯ নম্বরকে পদোন্নতি দেওয়া হয়। তখন মাঝখানে যারা যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও পদোন্নতি বঞ্চিত হন তাদের মাঝে হতাশা ভর করে। তারা কর্মস্পৃহা হারিয়ে ফেলেন। কোনো কারণ ছাড়া পদোন্নতি থেকে বাদ পড়লে তাদের কাছ থেকে কী আশা করা যায়?

সাবেক আইজিপি শহীদুল হক বলেন, পুলিশে পদোন্নতির ক্ষেত্রে সিন্ডিকেটের কারসাজি দীর্ঘদিন ধরে ঘটে আসছে। বিএনপি সরকারের আমলে তিন জনকে চুক্তিভিত্তিক আইজি করা হয়েছিল। ঐ সময় একজন সৎ মুক্তিযোদ্ধা আইজিকে সরিয়ে দলীয় একজনকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি বলেন, পুলিশে পদোন্নতি হতে হবে সততা, নিষ্ঠা, জ্যেষ্ঠতা, পেশাদারিত্ব, অভিজ্ঞতা, যোগ্যতা ও বার্ষিক এসিআর রিপোর্টের ভিত্তিতে। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ কর্মকর্তা, যারা কোনো দল করেন না, তারাও বাদ পড়েন। অথচ তাদের এসিআর রিপোর্ট ভালো। যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও সততা তাদের মধ্যে আছে। দলবাজির কারণে এদেরকে বাদ দেওয়া দুঃখজনক।

ইত্তেফাক/এএইচপি