সোমবার, ২৭ মার্চ ২০২৩, ১৩ চৈত্র ১৪২৯
দৈনিক ইত্তেফাক

বাজেট ২০২২-২৩

কর ছাড়ের সুবিধা পেতে মানতে হবে শর্ত

  • ৩৮ ধরনের সেবায় রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক
  • বিদেশি সব প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট নিবন্ধন নিতে হবে 
আপডেট : ১২ জুন ২০২২, ০৫:০৫

আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়েনি। ফলে আগের মতোই বার্ষিক আয় ৩ লাখ টাকা হলেই তাকে কর দিতে হবে। আবার বছর শেষে রিটার্নও দাখিল করতে হবে। প্রস্তাবিত বাজেটে অন্তত ৩৮ ধরনের সেবায় রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। 

আগে এসব ক্ষেত্রে শুধু কর সনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) দাখিল করলেই হতো। যেমন কেউ যদি ব্যাংকের সুদ আয় তুলতে যান, তাহলে উৎসে কর কেটে রাখা হয়। টিআইএন সনদ দেখালেই সুদ আয়ের ওপর ১০ শতাংশ উৎসে কর কাটা হতো। না হলে তাকে দিতে হতো ১৫ শতাংশ। এখন থেকে এই সুবিধা পেতে হলে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র ব্যাংকে দেখাতে হবে। টিআইএন সনদের পরিবর্তে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র দাখিলে ব্যর্থ হলে ঠিকাদার বা সরবরাহকারীর কাছ থেকে ৫০ শতাংশ বেশি হারে উৎসে কর কেটে রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে। 

তাছাড়া ৫ লাখ টাকার বেশি ঋণের জন্য আবেদন করলে তাকে রিটার্নের কপি দাখিল করত হবে। এ ধরনের আরো পরিবর্তন এসেছে প্রস্তাবিত বাজেটে। যেমন, ৫ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র ক্রয়, ক্রেডিট কার্ড গ্রহণ, কোনো কোম্পানির পরিচালক বা শেয়ারহোল্ডার হওয়া, ব্যাবসায়িক সমিতির সদস্যপদ গ্রহণ, সন্তান বা পোষ্যের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ালেখা করা ও অস্ত্রের লাইসেন্স নেওয়ার জন্য দাখিল করতে হবে রিটার্নের কপি। এ ছাড়া উপজেলা, পৌরসভা, জেলা পরিষদ, সিটি করপোরেশন ও জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থী হলে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র দেখাতে হবে। এত দিন ছোটখাটোসহ সব ধরনের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে টিআইএন সনদ ঝুলিয়ে রাখতে হতো। এখন থেকে টিআইএন সনদ নয়, রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র প্রদর্শন করতে হবে।

করপোরেট কর ছাড় সুবিধা পেতে হলে শর্ত:

প্রস্তাবিত বাজেটে করপোরেট কর কমানো হয়েছে। এ নিয়ে বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো স্বাগত জানিয়েছে সরকারকে। দীর্ঘদিন ধরেই ব্যবসায়ীরা করপোরেট কর কমানোর দাবি করেছেন। তবে হ্রাসকৃত করপোরেট করহারের সুবিধা পেতে শর্ত আরোপ করা হয়েছে। এ শর্ত হলো বার্ষিক সর্বমোট ১২ লাখ টাকার অতিরিক্ত ব্যয় ও বিনিয়োগ এবং সব ধরনের আয় ও প্রাপ্তি ব্যাংক লেনদেনের মাধ্যমে সম্পন্ন করতে হবে। সেটি না হলে আড়াই শতাংশ কর কমানোর সুবিধা পাওয়া যাবে না। আগের মতোই কর দিতে হবে।

প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থমন্ত্রী উল্লেখ করেছেন, পাবলিকলি ট্রেডেড বা শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির করহার বর্তমানে সাড়ে ২২ শতাংশ। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মধ্যে যারা পরিশোধিত মূলধনের ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার আইপিওর মাধ্যমে বাজারে ছেড়েছে, তাদের করপোরেট কর কমিয়ে ২০ শতাংশ করা হয়েছে। অন্যদিকে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির পরিশোধিত মূলধনের ১০ শতাংশ বা ১০ শতাংশের কম শেয়ার আইপিওর মধ্যে হস্তান্তরিত হয়েছে, এমন কোম্পানি শর্ত পালনে ব্যর্থ হলে বিদ্যমান সাড়ে ২২ শতাংশের পরিবর্তে ২৫ শতাংশ কর দিতে হবে। আবার পাবলিকলি ট্রেডেড নয় এমন কোম্পানির করহার বর্তমানে ৩০ শতাংশ। এটি কমিয়ে সাড়ে ২৭ শতাংশ করা হয়েছে। একক ব্যক্তির কোম্পানির করহার ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে সাড়ে ২২ শতাংশ করা হয়েছে। এ ছাড়া ব্যক্তিসংঘ ও কৃত্রিম ব্যক্তিসত্তা ও অন্যান্য করযোগ্য সত্তার করহার আড়াই শতাংশ কমিয়ে সাড়ে ২৭ শতাংশ করা হয়েছে। এসব ক্ষেত্রেও একই শর্ত দেওয়া হয়েছে।

বিদেশি প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট নিবন্ধন বাধ্যতামূলক:

বাংলাদেশে যেসকল বিদেশি কোম্পানির শাখা অফিস, লিয়াজোঁ অফিস বা প্রকল্পের কার্যক্রম চলমান রয়েছে তাদের সকলকে ভ্যাট নিবন্ধন করতে হবে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত অর্থ বিলে ভ্যাট আইনের সংশোধন করে এ বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। টার্নওভার মূল কোম্পানির অ্যাকাউন্টসে যোগ হওয়ায় এত দিন ভ্যাট নিবন্ধন করা বা বাংলাদেশে বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার (বিআইএন) নিতে হয়নি তাদের। তবে এখন থেকে বিদেশি সব কোম্পানির শাখা অফিসকেও ভ্যাট নিবন্ধন করতে হবে। বিদ্যমান ভ্যাট আইনে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের শাখা বা লিয়াজোঁ অফিসের নিবন্ধনের ব্যবস্থা নেই। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠান মূল প্রতিষ্ঠানের পক্ষে মার্কেটিং, প্রচার-প্রচারণা ও বাজার সম্প্রসারণে নানা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তবে নিবন্ধন না থাকায় তাদের ভ্যাট আদায়ের সঠিক হিসাব পাওয়া যাচ্ছিল না। 

এজন্য বিদেশি প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে বলে এনবিআর কর্মকর্তারা জানান। উল্লেখ্য, এর আগে ২০২০ সালে বিদেশি কোম্পানি হিসাবে গুগল, ফেসবুক, ইউটিউব, অ্যামাজনসহ টেক জায়ান্টদের বাংলাদেশে নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করে এনবিআর। ঐ কোম্পানিগুলো এখন দেশে নিয়মিত ভ্যাট রিটার্নও দিচ্ছে।

বিলাস পণ্য আমদানিতে আরো নিয়ন্ত্রণ

নতুন অর্থবছরের প্রথম দিন থেকে বিলাসী পণ্য নিয়ন্ত্রণে আরো পদক্ষেপ আসতে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে অর্থসচিব আব্দুর রউফ তালুকদার বাজেট-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে শুক্রবার এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, বিলাস পণ্য আমদানিতে নিরুৎসাহিত করতে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে যা পহেলা জুলাই থেকে আপনারা দেখতে পারবেন। 

উল্লেখ্য, বাজেটে প্রস্তাবের আগেই চার ধরনের পণ্যের এসডি বা নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক বাড়ানোর ঘোষণা এসেছে। আমদানিকৃত ফল, ফুল, আসবাব এবং প্রসাধনসামগ্রীর ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ডলার সাশ্রয় ও বিলাসী পণ্য আমদানিতে শুল্ক ও ভ্যাটের হার বাড়ানো হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের গাড়ি, ল্যাপটপ, প্রিন্টার, বিদেশি পাখি, গ্যাস লাইটার ইত্যাদি। 

এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংক অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসী পণ্য আমদানিতে দুই দফায় এলসি মার্জিন আরোপ করেছে। প্রথমে এসব পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ মার্জিন আরোপ করে। পরে এলসি খোলার হার না কমায় মার্জিন বাড়িয়ে ৫০ থেকে ৭৫ শতাংশ করা হয়। নতুন অর্থবছর শুরুর দিন থেকে আরো নতুন নতুন পণ্যে শুল্ক আরোপ হতে যাচ্ছে বলে সূত্রগুলো জানায়।

ইত্তেফাক/এএএম