শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

পুরস্কার ও তিরস্কারময় জীবন

আপডেট : ০১ জুলাই ২০২২, ১৩:২১

পুরস্কার বা প্রশংসা কে না পছন্দ করে? শিবরামের গল্পে হর্ষবর্ধন হঠাৎ একদিন দেখলেন একজন স্কাউটবয় অন্যদের উপকার করছে এবং সবার প্রশংসা পাচ্ছে। হর্ষবর্ধনের ইচ্ছে হলো তিনিও এমনিভাবে মানুষের উপকার করবেন। হর্ষবর্ধন বাড়িতে এসে তার ছোটভাইকে বললেন, এখন থেকে তোকে আমি কোলে নিয়ে ঘুরব। তোকে আর কষ্ট করে হাঁটতে হবে না। গোবর্ধন আপত্তি তুলে বললেন যে, তিনি কি বাচ্চা যে দাদার কোলে-কোলে ঘুরবেন? তাছাড়া তার পা তো খোঁড়া নয়। হর্ষবর্ধন বললেন যে, খোঁড়া নয়, তাতে কী? দরকার হয় চ্যালাকাঠ দিয়ে ছোটভাইয়ের ঠ্যাং খোঁড়া করে তারপর তাকে কোলে নিয়ে ঘুরবেন। ছোটভাইয়ের উপকার করবেন। মানুষ তাকে ধন্য ধন্য করবে।

পুরস্কারের লোভ ছোটবেলা থেকেই আমাদের মনে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। হয় তুমি পুরস্কৃত হবে, অথবা তিরস্কৃত হবে। হয় স্বর্গ পাবে, নইলে নরক। আর পুরস্কারের লোভ একবার হূদয়ে গেঁথে গেলে তখন পুরস্কার হয়ে যায় নেশার মতো। একটি বিদেশি কৌতুকে দেখেছিলাম, একবার একটা ফোন এলো ৭৭৭৭৭৭৭৭ নম্বরে। যিনি ফোন করেছেন তিনি বলছেন— ‘হ্যালো, এটা কি ৭৭৭৭৭৭৭৭? প্লিজ, আমাকে একটা ডাক্তার ডেকে দিন। আমার আঙুল ফোনের ডায়ালে আটকে গেছে।’ আমাদের মনটাও পুরস্কারের ডায়ালে আটকে থাকে। রাসেল নামের আমার এক সহজ-সরল বন্ধু মনে করে— কেউ তার প্রশংসা করে না, কেউ তাকে পাত্তা দেয় না। একদিন চার-পাঁচ জনের আড্ডায় সে দারুণ একটা কথা বলে ফেলে। সেটা শুধু আমি শুনি। আমি তখন অন্যদের বলি, আরে কী দারুণ একটা কথা বলেছে রাসেল! কিন্তু সে কথা অন্যরা ঠিকমতো শুনতে পায় না। রাসেল তখন জোরে জোরে অন্যদের শুনিয়ে বলে, উৎপলের কাছে শোনো আমি দারুণ একটা কথা বলেছি!

সুতরাং পুরস্কার বা প্রশংসার জোয়ারে কে না ভাসতে চায়? কিন্তু পুরস্কারের অতি লোভ এক রকমের মানসিক রোগ বলে মনে করেন অনেকে। হুমায়ুন আজাদ যেমন তার একটি প্রবচনে বলেছেন— পুরস্কার অনেকটা প্রেমের মতো; দু-একবার পাওয়া খুবই দরকার, এর বেশি পাওয়া লাম্পট্য।’ একবার একদল স্বেচ্ছাসেবী বন্যার ত্রাণ বিতরণ করে বাইরে অনেক প্রশংসা পায়। কিছু উপঢৌকনও পায়। পরের বার তারা অপেক্ষায় থাকে কখন বন্যা হবে। বন্যা আর আসে না। তারা কেঁদেকেটে অস্হির। তাদের চোখের জলে বন্যা। বন্যা কেন আসে না— মানুষের উপকার করতে হবে তো!

পুরস্কার মানুষের হূদয়ে অক্সিটোসিন হরমোনের নিঃসরণ ঘটায়। দেড় যুগ আগের কথা। আমার এক বন্ধু একদিন নীলক্ষেতের সাইবার ক্যাফেতে প্রচণ্ড উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটতে থাকে। কী ব্যাপার! সে ইয়াহু ইমেইলে ১০ লক্ষ ডলার লটারিতে পুরস্কার পেয়েছে! এখন পুরস্কারের টাকা তার ব্যাংকে আনতে তাকে পুরস্কারদাতাদের কাছে ১০০ ডলার পাঠাতে হবে। আমাকে গোপনে বলল, কী করে ১০০ ডলার পাঠাই, বল তো! আমি বললাম, ওদের বল, তোর ১০ লক্ষ ডলার পুরস্কার থেকে ১০০ ডলার কেটে নিয়ে বাকিটা পাঠাতে। ও মন খারাপ করে বলল, ‘সে কথা আমারও মাথায় এসেছিল। ওদের বলেছি। ওরা বলেছে, সিস্টেমে সেটা নাই।’ তারপর অনেক কষ্ট করে সে ১০০ ডলার পাঠাল এবং প্রবল উত্তেজনায় তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষায় থাকল ১০ লক্ষ ডলারের। তারপর যে সে বড় একটা অশ্বডিম্ব পেল, সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

আমি একবার রচনা প্রতিযোগিতায় তৃতীয় হয়েছিলাম। বলা বাহুল্য, প্রতিযোগী তিনজন ছিল। কিন্তু পুরস্কার তো পেয়েছি। পুরস্কার হাতে পাওয়ার পর আমাকে কিছু বলার জন্য অনুরোধ করা হলো। মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলতে শুরু করলাম— ‘প্রথমেই আমি এই প্রতিযোগিতায় প্রথম হওয়া বন্ধুকে ধন্যবাদ দিতে চাই যে, সে আমার চেয়ে ভালো ইন্টারনেট বোঝে এবং সে গুগল, উইকিপিডিয়া, মাইক্রোসফট অফিস এবং কপি-পেস্ট খুব গুছিয়ে করতে পারে।’

তবে অনেকেই টাকা খরচ করে হলেও পুরস্কার পেতে চান। এক্ষেত্রে পুরস্কার দাতা এবং গ্রহীতা উভয়েই লাভবান হন। যেমন, দুজন কমপিউটার প্রোগ্রামার একসঙ্গে বড়লোক হতে পারবে খুব সহজ উপায়ে। একজন ভাইরাস প্রোগ্রাম তৈরি করবে, অন্যজন অ্যান্টিভাইরাস তৈরি করবে। একইভাবে কিছু কিছু সংগঠন আছে যাদের কাজ হলো বিভিন্ন পুরস্কার ও সংবর্ধনা দিয়ে বেড়ানো। তাদের শিকারে সানন্দে ধরা দেয় কোনো কোনো পুরস্কারলোভী সাহিত্যিক। আমার পরিচিত এক সাহিত্যিকের বাসায় গিয়ে দেখলাম, তাঁর বাড়িতে থরে থরে নানান পুরস্কারের ক্রেস্ট, মানপত্র! এ নিয়ে তাঁর আত্মতৃপ্তির শেষ নেই।

পুরস্কার নিয়ে আমাদের উত্তেজনা এত বেশি যে, ধরুন, কোনো ব্যক্তি দুর্ঘটনায় তার শরীরের বাঁ-পাশ পুরোটাই হারিয়েছেন। এখন তার কী হবে? তিনি এখন ‘অল রাইট’। পুরস্কারের জন্য সব হারিয়েও আমরা ‘অলরাইট’ থাকতে পারি।

ইত্তেফাক/এসজেড

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন