শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট না থাকায় ঋতুকালীন ৩০ শতাংশ ছাত্রী স্কুলে অনুপস্থিত থাকে

আপডেট : ১৩ জুলাই ২০২২, ০৬:০৩

আফসারা নূর সানিয়া (ছদ্ম নাম)। বয়স ১৪ বছর। অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থী সানিয়া লেখাপড়া করে সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে। কোভিট মহামারির পরে সানিয়ার কিছু মানসিক সমস্যা দেখা দিয়েছে বলে জানান সানিয়ার মা। তিনি বলেন, মেয়ে লেখাপড়ায় বেশ ভালোই। কিন্তু প্রতি মাসে ঋতু চলাকালে সে সর্বনিম্ন সাত-আট দিন স্কুলে যেতে পারে না। এ নিয়ে সানিয়া খুবই উদ্বিগ্ন এবং বিষণ্ণ। কারণ স্কুলে তার স্যানিটেশন ব্যবস্থা ভালো না। এ কারণে সানিয়া ঐ সময়ে স্কুলে যেতে পারে না। সানিয়া বলে, ‘স্কুলের টয়লেটের ছিটকিনি নেই, পানি থাকে না এবং ময়লা, দুর্গন্ধ। যাওয়ার মতো না, সেখানে প্যাড বদলানো আরো কঠিন। যে কারণে ঐ সময় স্কুলে যাওয়া হয় না।’

এমন সমস্যায় কেবল সানিয়ার একার নয়; প্রতিটি দেশের অধিকাংশ কিশোরীর। দেশে নিরাপদ পানির প্রাপ্যতা শতকরা ৫৮ দশমিক ৫ ভাগ এবং নিরাপদ স্যানিটেশন ব্যবস্থা শতকরা ৩৮ দশমিক ৭ ভাগ। অথচ ২০৩০ সালের মধ্যে শতভাগ নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশনের আওতায় আসার অঙ্গীকার করেছে বাংলাদেশ। আগামী আট বছরে সবাইকে এ ব্যাপারে গুরুত্ব দিতে হবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন অব দ্য রুরাল পোওর-ডিওআপপি) ‘ডরপ্’-এর উপ-নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ যোবায়ের হাসান ইত্তেফাককে বলেন, ‘স্কুলগুলোতে বিভিন্ন কাজের জন্যে বাজেট বরাদ্দ থাকলেও, স্যানিটেশন হাইজিনের জন্যে কোনো বরাদ্দ রাখা হয় না। তিনি বাংলাদেশ ন্যাশনাল হাইজেন সার্ভের তথ্য উল্লেখ করে বলেন, ‘স্কুল পড়ুয়া মেয়েদের স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারের হার ৬২ ভাগ এবং বাকি ৩৮ শতাংশ এখনো স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করে না। কিন্তু দেশের বেশির ভাগ স্কুলে মেয়েদের জন্য পৃথক এবং ব্যবহার উপযোগী টয়লেট না থাকায় ঋতুকালীন সময়ে প্রতি ৩০ শতাংশ ছাত্রীকে প্রতি মাসে স্কুলে অনুপস্থিত থাকতে হয়। ফলে তারা একদিকে ক্লাসে পিছিয়ে পড়ে, অন্যদিকে পরীক্ষার ফলাফলও খারাপ হয়।’

ইউনিসেফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ৬১ শতাংশ জনগণ নিরাপদ স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশনের বাইরে। দেশের ২ কোটি ৩৪ লাখ মানুষ এখনো অনুন্নত শৌচাগার ব্যবহার করছে। জনসংখ্যার একটি বিরাট অংশ উন্নত শৌচাগার ব্যবহার করলেও তা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) মানদণ্ডের অনেক নিচে। ইউনিসেফের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর ৫২ শতাংশেই এসব পরিষেবার কোনো না কোনোটির অনুপস্থিতি রয়েছে। ইউনিসেফের পর্যবেক্ষণে তা উঠে এসেছে। মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রে এ হার ৪২ শতাংশ। এছাড়া মৌলিক পরিচ্ছন্নতা বা বেসিক হাইজিন ব্যবস্থা নেই ৫১ শতাংশ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। ‘স্টেট অব দ্য ওয়ার্ল্ডস চিলড্রেন ২০২১: অন মাই মাইন্ড; প্রমোটিং, প্রটেকটিং অ্যান্ড কেয়ারিং ফর চিলড্রেনস মেন্টাল হেলথ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে ইউনিসেফের এ পর্যবেক্ষণ উঠে আসে।

ডব্লিউএইচওর সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য পর্যাপ্তসংখ্যক শৌচাগার থাকতে হবে। স্যানিটেশনের সমস্যা থাকলে তাতে সংক্রামক রোগগুলো বেশি বিস্তার লাভ করে। স্কুলগামী শিশুদের এ রোগগুলো বেশি হয়। একই সঙ্গে শিশুরা রোগের কষ্ট পেলেও অভিভাবকের কাছে সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারে না। ফলে রোগগুলো বড় আকার ধারণ করে। এসব কারণে শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকে না। আর তাতে বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ার হারও বাড়তে থাকে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী ইত্তেফাককে বলেন, ‘আমাদের দেশের মানুষের জন্য বাসার বাইরে শৌচাগারের কোনো সুব্যবস্থা নেই। ফলে অধিকাংশ মানুষকে বিশেষ করে নারীদের তাদের টয়লেট চেপে রাখতে হয় এবং এর ফলে নারী-পুরুষ উভয়ের মূত্র সংবহনতন্ত্রে আক্রান্ত হন। বিশেষ করে মেয়েরা বেশি আক্রান্ত হন। মূত্রসংবহনতন্ত্র বার বার আক্রান্ত হওয়ার ফলে কিডনির সমস্যা তৈরি হয় এবং ধীরে ধীরে কিডনির কার্যক্ষমতা কমে যায়; যা নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

ইত্তেফাক/ইআ