বেদে সম্প্রদায় আধুনিক সমাজে একটি পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর নাম। সবচেয়ে প্রান্তিক সম্প্রদায় তারা। স্বাভাবিক জীবনযাপন, আচার-অনুষ্ঠান কিংবা মৌলিক চাহিদা পূরণের অধিকার থেকে তারা বঞ্চিত। পথে পথেই কাটে জীবনের পুরো সময়। এই সম্প্রদায়ের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শিশুদের বেড়ে ওঠাও যেন বিভীষিকাময়। শিক্ষা, চিকিৎসা ও নিরাপদ বাসস্থান তাদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। এই সম্প্রদায়ের অভিযোগ, কেউ তাদের খোঁজ-খবর নেয় না। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীদের জন্য সরকারি বরাদ্দ আসলেও তারা পায় না। তাদের পুনর্বাসন সময়ের দাবি।
বেদে সম্প্রদায়ের বয়ঃজ্যেষ্ঠরা বলেন, আদিকাল থেকে আমাদের এই সম্প্রদায় দেশের বিভিন্ন জায়গায় বসবাস করে আসছে। তাদের সেই সময় যেমন সামাজিক অধিকার ছিল না, আজ আমাদেরও নেই। আমাদের আশঙ্কা দিন দিন বাড়ছে। করোনার সময় শুরু হওয়ার পর আমাদের আগের মতো ব্যবসা হয় না। কারও বাড়িতে সেভাবে ঢুকতে দেয় না। মানুষ এখন আর তাবিজে বিশ্বাস করে না। সরকারের কাছে দাবি, এখন আমাদের পাশে দাঁড়ান। আমরা আর এই পেশায় ভালো নেই, ভাত জোটে না। আমাদের জন্য নতুন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিন। ছেলে-মেয়েদের শিক্ষিত করার সুযোগ দিন। ওরা যেন এই পেশায় আর না আসে, সেটা চাই।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, মাদারীপুরের শিবচর থানার দক্ষিণ চরজানাজাত পুরান ফেরিঘাটে প্রায় আড়াইশ বেদে পরিবার বসবাস করে। তাদের থাকার জায়গা হিসেবে রয়েছে ছোট্ট পলিথিনের খুপরি। একেকটি পরিবারে ৫-৬ জন করে সদস্য রয়েছে। প্রায় সবাই একই খুপরির মধ্যে থাকছেন। রান্না করেন খোলা আকাশের নিচে। স্বাস্থ্যকর বাথরুম নেই। নিরাপদ পানির ব্যবস্থা নেই। পাশের গ্রাম থেকে পানি এনে পান করেন। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকায় বিভিন্ন রোগে ভুগছেন তারাদের অনেকেই। মানবেতর জীবন তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী।
এই পল্লীর বসবাসকারীরা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, কাউকে নেশা করতে দেখি না। তবে, বিড়ি-সিগাটে খায় অনেকে। আমাদের শিশুদের যেহেতু পড়াশোনা নেই, বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে থাকি, এজন্য কেউ কেউ নষ্ট হতে পারে। আমরা থাকার ভালো পরিবেশ পেলে, সরকারি জমি-ঘরবাড়ি পেলে ভালো সমাজ পাবে আমাদের সন্তানেরা। তাহলে আর তারা নষ্ট হবে না। আমাদের কিছু কিছু আদমশুমারীর গণনা থেকে বাদ পড়েছে। তবে, যাদের স্থায়ী ঘরবাড়ি আছে, তারা বাদ পড়েনি।
স্থানীয় যুবক আসাদ মিয়া বলেন, ‘এখানকার বেদেরা কারো সঙ্গে বিবাদে জড়ায় না। তবে, কিছু যুবককে নেশা ও অশ্লীল কাজ করতে দেখা যায় মাঝে মাঝে। তাদের মাঝে সচেতনতার অভাব রয়েছে। পারিবারিক আদর্শ শিক্ষার অভাব আছে। তাদের কর্মসংস্থান থাকলে এই কোনো অপরাধ করার সময়-সুযোগ কোনোটাই পেতো না।’
বেদে পল্লীর বাসিন্দা কনিকা আক্তার। এক সন্তানের মা। গ্রামে গ্রামে দাঁতের পোকা ফেলান, তাবিজ বিক্রি করেন। তিনি বলেন, ‘আগে গ্রামে ঘুরলে অনেক আয় হতো। এখন হয় না। কেউ সিঙ্গা লাগিয়ে ব্যথা সারান না। তাবিজ কেনেন না। আমার স্বামী গ্রামে-হাটে কড়ি-মালা বিক্রি করেন। এখন এগুলো চলে না। আমাদের ভিন্ন কোনো পেশার কাজ দিলে পরিবার নিয়ে ভালো চলতে পারতাম। আমাদের এখানকার বেশির ভাগ পরিবারের সদস্যরা বেকার। তেমন অনুদানও কেউ দেয় না। আমরা খুব অসহায় দাদা। অনেকে আবার আমাদের পেশা ও সম্প্রদায়কে কটাক্ষ করে কথা বলে।’
আরেকজন নারী সদস্য রিনা বলেন, ‘মেয়েরা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়, তাদের গাইনি চিকিৎসা সচেতন করতে হবে। মাসিককালীন অনেকেই সেনিটারি নাপকিন ব্যবহার করেন না। অনেকে জানেন না ব্যবহার, আবার অনেকে টাকার অভাবে কিনতে পারেন না। সহায়তা প্রয়োজন।’
বেদে পরিবারের একজন সদস্য সুমন (৩৫)। গ্রামে ঘুরে ঘুরে সাপের খেলা দেখান। গ্রামেই তার সঙ্গে দেখা হয়। তিনি বলেন, ‘ছোটবেলা মায়ের সঙ্গে গ্রামে ঘুরে খেলা দেখাতাম। তখন অনেক মানুষ হতো, আয়ও বেশি ছিল। মাংস দিয়ে ভাত খেতাম। এখন আয় তেমন হয় না। দুই-তিন দিনের আয় দিয়ে ১ কেজি মাংসও কিনতে পারি না। আমার পরিবারে বৃদ্ধ বাবা-মা, অসুস্থ স্ত্রী ও দুটি সন্তান রয়েছে। তাদের ভরণপোষণই হয় না। কোনো বাড়িতে যদি কোনো বিনামূল্যে খাবারের অনুষ্ঠান হয়, তাহলে ভালো খাওন জোটে, নাহয় জোটে না। এই পেশা ছাড়তে চাই। সরকার আমাগো কোনো কাজের ট্রেনিং দিয়া কাজ দিলেও এই পেশা ছাইড়া দিমু।’
রেশমা বেগম (৭৫)। বয়সের ভারে নুইয়ে পড়েছেন। নদীর দিকে তাকিয়ে আছেন, আর ভাবছেন জীবনের ফেলে আসা দিনগুলোর কথা। জীবনের ৭৫টি বছরেও স্থায়ী হতে পারলেন না। তিন ছেলে-তিন মেয়ে। তাদেরও বয়স হয়েছে। থাকেন নাতি-নাতি বউয়ের সঙ্গে এক ঘরে। ঘর তো নয়, খুপরি। তিনি বলেন, ‘অবহেলার জীবনে শরম-লজ্জাও নেই। নাতি-নাতবউয়ের সঙ্গে এক ঘরে থাকি। আমাদের বেশির ভাগ পরিবারে ছেলে-ছেলে বউ, বাবা-মা একসঙ্গে এক ঘরেই থাকে। নৌকা জীবনে এক ছইয়ের মধ্যেই দাম্পত্য জীবন। এটা আসলে জীবন না, কারাগার।’
বৃদ্ধা বলেন, ‘ভালো খেতে-পরতে পারি না। মনে হয় কোরবানি ছাড়া গরুর মাংস খেতে পাই না। হাছা (সত্যি) বলতে নাতি-নাতনিদের নিয়ে মানুষের চল্লিশা খাওনের অপেক্ষায় থাকি। আর এখন খোলা জায়গায় মানুষের চল্লিশাও হয় না। এ ছাড়া কোনো ফ্রি খাওনও নাই।’
দক্ষিণ চরজানাজাত পুরান ফেরিঘাটের বেদে পল্লীর সরদার সাদ্দাক হোসেন বলেন, ‘আমাদের বাপ-দাদার বাড়ি মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ে। সেখানে আমাদের একটি গ্রাম আছে। প্রায় ৬০০-৭০০ পরিবার সেখানে থাকে। হাতেগোনা কয়েকজনের নিজস্ব বাড়ি-জায়গা আছে। বেশির ভাগ পরিবারের মাথা গোঁজার ঠাঁই নাই। এতগুলো পরিবারের মধ্যে ৮-১০টি পরিবার সরকারি ঘর-খামার পাইছে। বাকিরা পায় নাই। তবে, মাঝেমধ্যে ইউপি সদস্যরা আমাদের এনআইডি কার্ডের ফটোকপি নেন, আশ্বাস দেন, কিন্তু ঘরবাড়ি-জায়গা পাই না। একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের আওতায় আমাদের নাম নেয় তারা, কিন্তু পাই না।’
সরদার সাদ্দাক হোসেন আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমাদের জীবনটা তো এমনেই গেলো, আমাদের সন্তানদের কথা চিন্তা করে হলেও আমাদের পেশা পরিবর্তন করা প্রয়োজন। আমাদের কর্মক্ষমদের, তরুণদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করলে আমাদের ছেলে-মেয়েদের আর যাযাবর জীবনযাপন করতে হবে না। এখন মানুষ সাপের খেলা দেখে না, তাবিজ ব্যবহার করে না। আমাদের আয় নাই। করোনা এসেও আমাদের সব শেষ করে দিছে। ছেলে-মেয়েদের মানুষ করতে হলে এই সম্প্রদায়ের আয়-রোজগার থাকা দরকার। শিশুদের পড়ালেখা করানো দরকার। স্থায়ী জীবন না হলে কোনো কিছুই সম্ভব না।’
শিবচর উপজেলার মাদবরেরচর ইউনিয়ন পরিষদের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার এবং বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মো. জাহাঙ্গীর মোড়ল বলেন, ‘আমাদের এলাকায় বেদে সম্প্রদায়ের লোকজন বেশিদিন যাবত আসেনি। আবার তারা ধীরে ধীরে চলেও যাচ্ছেন। গত ঈদে সরকারি বরাদ্দ না থাকলেও আমি ব্যক্তিগতভাবে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছি। আমার ভাই তাদের একটি আর্সেনিক মুক্ত পানির কল দিয়েছে বিনামূল্যে। আবার আমাদের পুরো ইউনিয়নের জন্য ৭২টি ঘর এসেছে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের। সেখান থেকে এখানকার ভোটার বেদে যারা আছেন, তাদের ২০-২৫টি ঘর দেওয়া হবে বলে আশা করছি।’
জাহাঙ্গীর মোড়ল আরও বলেন, ‘তাদের মধ্যে কেউ যে অনৈতিক কোনো কাজের সঙ্গে জড়িত, এটা আমার জানা নেই। তবে, সবসময় তাদের নজরে রাখা হয়। তাদের বিপদে-আপদে পাশে থাকার চেষ্টা করি। তারা প্রায় আড়াইশো পরিবার এখানে অস্থায়ীভাবে থাকে। তবে, তারা যেহেতু আমাদের এখানকার না, তাই তাদের ব্যাপারে কোনো বরাদ্দ নেই।’
বেদে সম্প্রদায়ের দুর্দিনের কথা উল্লেখ করে শিক্ষক ও সাংবাদিক অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, ‘সবচেয়ে প্রান্তিক সম্প্রদায় তারা। তাদের নিয়ে সিনেমা হয়, নাটক হয়, সাহিত্য হয়, কিন্তু তাদের বাস্তবতা নিয়ে কেউ তেমন ভাবেন না। সমাজসেবা অধিদপ্তর ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উচিৎ তাদের সঠিক সংখ্যাটা বের করে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। তাদের শিশুদের শিক্ষা-স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা। বেদে সম্প্রদায়ের একটি নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে, সেটাকে স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন। গণমাধ্যমের উচিত তাদের নিয়ে পজিটিভ নিউজ করা এবং তাদের সমস্যা, সম্ভাবনা ও দাবিগুলো তুলে ধরা।’
সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. শাহ-জাহান বলেন, ‘আমাদের সমাজসেবা অধিদপ্তর বেদে সম্প্রদায়ের তিনটি বিষয় নিয়ে কাজ করে। (১). ৫০ বছরের বেশি বয়স্কদের মাসে ৫০০ টাকা করে বয়স্ক ভাতা দেওয়া হয়। (২). বেদে পরিবারের সন্তানরা যারা পড়াশোনা করেন, তাদের উপবৃত্তি দেওয়া হয়। প্রাইমারিতে যারা পড়েন, তাদের ৭০০ টাকা করে, হাইস্কুলে যারা পড়েন, তাদের ৮০০ টাকা করে, কলেজে পড়ুয়াদের ১০০০ টাকা করে এবং অনার্স বা ডিগ্রি পর্যায়ে যারা পড়েন তাদের মাসিক ভিত্তিতে ১ হাজার ২০০ টাকা করে উপবৃত্তি দেওয়া হয়। (৩) জেলা প্রশাসক ও সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালকদের মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায়ে বেদে জনগোষ্ঠীকে বিভিন্ন কাজের ট্রেনিং দেওয়া হয়। যেমন, কেউ সেলাই মেশিনের কাজ শিখতে পারেন, আবার ড্রাইভিং। অর্থাৎ প্রয়োজন অনুযায়ী আমরা বেদে সম্প্রদায়ের সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেই। ইতোমধ্যে প্রায় ৫ শতাধিক বেদেকে বিভিন্ন কাজের ট্রেনিং দিয়েছি।’
জাতীয় পরিসংখ্যান ও তথ্য বিভাগের ডেপুটি সেক্রেটারি মো. দিলদার হোসেইন বলেন, ‘ইতোমধ্যে আমাদের আদমশুমারি শেষ হয়েছে। আগামী ২৭ জুলাই ঘোষণার দিন। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি দেশের সব নাগরিকের পরিসংখ্যান জোগাড় করার। বিশেষ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ও বেদে সম্প্রদায়কে গুরুত্ব দিয়ে গণনার আওতায় নিয়ে আসতে চেষ্টা করেছি। অভিযোগ পেয়েছি কেউ কেউ বাদ গেছেন, তাদেরও আওতায় নিয়ে আসতে কার্যক্রম চালাচ্ছি।
দিলদার হোসেইন আরও বলেন, ‘দুটি পদ্ধতিতে আমরা গণনার কাজ করেছি। একটি ডি-ফ্যাক্টো এবং অন্যটি ডি-জুরে। ডি-ফ্যাক্টো হচ্ছে ঠিক রাত ১২টায় যে যেখানে আছেন, তাদের সেখানেই গণনা করা এবং ডি-জুরে হচ্ছে স্থানীয়ভাবে সবার বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে পরিবারের সব সদস্যকে গণনার আওতায় নিয়ে আসা। সুতরাং সবাই গণনার আওতায় আসবে বলে আশাবাদী।'
বুধবার (২০ জুলাই) দুপুরে শিবচর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘সরকার সবসময় বেদে সম্প্রদায়ের পাশে আছে। বরাদ্দ অনুযায়ী তাদের ত্রাণ দিয়েছি, বয়স্ক ভাতা দিচ্ছি। তারা যদি চান পেশা পরিবর্তন করতে, তাহলে সরকারিভাবে সহযোগিতা করবো। তাদের ভিন্ন পেশায় নিয়ে যেতে আমরা চেষ্টা করেছি, কিন্তু তারা যেতে চান না। সরকারি বরাদ্দের ঘরও দেওয়া হচ্ছে তাদের। প্রশিক্ষণও দেবো আমরা, তারা যদি আমাদের কাছে আসেন। তাদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। তবে, আরও বেশি নজর দেওয়া প্রয়োজন।’