শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

নড়াইলের বুকে কলঙ্কের যাতনা

আপডেট : ২১ জুলাই ২০২২, ০৬:২৯

নড়াইল এখন কলঙ্কের বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছে। গত ১৫ জুলাই শুক্রবার। ঘড়ির কাঁটায় ৪টা বেজে ৪৬ মিনিট। হঠাত্ ৯৯৯ ফোন। এক প্রান্তে পুলিশ। অন্য প্রান্তে এক নারীর বোবা কান্না। শুধু বললেন দীঘলিয়া গ্রামে সনাতনীদের ওপর হামলার আশঙ্কার কথা। তারপর কেটে গেল প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা। রাত ৮টার কিছু আগে বা পরে হবে—একদল দুষ্কৃতকারী লাঠিসোঁটা নিয়ে ধর্মীয় উসকানিমূলক স্লোগান দিয়ে দীঘলিয়া গ্রামে ঢুকে পড়ল। আর বিভিন্ন উপদলে ভাগ হয়ে শতাধিক দুষ্কৃতকারী হামলা চালাতে শুরু করল। কথাগুলো বলছিলেন ঐ গ্রামের এক ভুক্তভোগী নারী। যিনি ঘটনার শিকার। তার বাড়ি থেকে স্বর্ণালংকার, টাকা লুট হলো। তারপর মারধর ভাঙচুর। গত মঙ্গলবার তার স্বামীসহ তাকে গৃহে ফেরত আনা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি জানালেন, তারা তখনো ভীতসন্ত্রস্ত।

সরেজমিন পরিদর্শনকালে জানা যায়, ঐ গ্রামটিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ১১০ ঘর সনাতনী বসতি রয়েছে। প্রায় এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে দুষ্কৃতকারীরা একের পর এক বাড়ি বাড়ি, ধর্মীয় উপাসনালয়ে হামলা ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। এর মধ্যে অবশ্য কিছু মানুষ নিজেদের রক্ষা করেছেন একপ্রকার মুক্তিপণ দিয়ে।

কিন্তু কেন এই হামলা?

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, আকাশ সাহার দেওয়া একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে প্রথমে উত্তেজনা পরে ঐ হামলার ঘটনা। দীর্ঘসময় ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী ও প্রশাসন নীরব ভূমিকার সুযোগে আওয়ামী লীগ বিরোধী ধর্মান্ধ গোষ্ঠী ঐ ঘটনা ঘটিয়ে গেছে।

ঘটনাস্হল পরিদর্শনের সময় স্হানীয় সংসদ সদস্য মাশরাফি বিন মুর্তজা বারংবার উচ্চারণ করেছেন একটি কথা যা সবার কানে এখনো বাজছে। তিনি তার সঙ্গে থাকা দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশ করে বলেছেন ‘ঘটনার সময় আপনারা কোথায় ছিলেন’। আপনারা থাকলে তো দুষ্কৃতকারীরা এ ঘটনা ঘটাতে পারত না। উল্লেখ্য, এই ইউনিয়নে মনোনয়নবঞ্চিত ইউপি চেয়ারম্যান হয়েছেন বোরহান উদ্দিন। আর হেরেছেন নৌকার প্রার্থী। তবে বিস্ময়কর বিষয় হলো জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা মঙ্গলবার পর্যন্ত ঘটনাস্হলে আসেননি বলে জানান স্হানীয়রা।

বোঝাই যায়, ঘটনার সময় ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের প্রতিহত করার কোনো মানসিকতা ছিল না। যদিও মাশরাফির ঐ আবেদন সমগ্র দেশবাসীর নজর কেড়েছে। দলীয় নেতাকর্মীরা কেন নীরব থাকলেন সে প্রশ্নের জবাব মেলেনি।

জানা যায়, ঘটনাটি ঐ রাতেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবহিত হয়ে তাত্ক্ষণিক ব্যবস্হা নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছিলেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে খুলনা বিভাগীয় পুলিশকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্হা নিতে বলা হয়। সে মতে জেলা পুলিশ কিছু শর্টগানের গুলি আর কিছু গ্যাস গান ব্যবহার করে দুষ্কৃতকারীদের হটাতে সক্ষম হয়।

স্হানীয়রা অনেকেই প্রশাসনের ভূমিকার সমালোচনা করে বলেছেন, অনেক সময় হাতে পেয়েও তারা নির্বিকার থাকায় দুর্ঘটনা এড়ানো যায়নি। অনেকে বলেছেন স্হানীয় এমপিও প্রত্যাশিত সমর্থন পাননি সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে।

পুলিশ বলছে, তারা ইচ্ছা করলেই গুলি চালাতে পারতেন কিন্তু তাতে হিতে বিপরীত হয় কি না সে নিয়ে সংশয়ে ছিলেন তারা। রাতের অন্ধকারে গুলি চালানো হলে অনেক নিরীহ লোকজনের ক্ষতি হতে পারত। কিন্তু পুলিশের এ কথায় খুশি নয় এলাকাবাসী।

পদোন্নতিপ্রাপ্ত অতিরিক্ত উপ-মহাপুলিশ পরিদর্শক ও নড়াইলের এসপি প্রবীর রায় জানান, ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়া আকাশ সাহার বিরুদ্ধে মামলা ও তার তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হয়েছে।

অপরদিকে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে একটি মামলায় আট জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এরমধ্যে সাত জনকে তিন দিন করে রিমান্ড নেওয়া হয়েছে। প্রবীর রায় জানান, হামলার সময়কার ভিডিও ফুটেজ রয়েছে। সেটি দেখে আসামিদের গ্রেফতার করা হয়েছে।

একটি সূত্র থেকে জানা যায়, গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে একজন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সমর্থক। অন্যরা আওয়ামী লীগবিরোধী বলে পরিচিত। তবে মজার বিষয় হচ্ছে আওয়ামী লীগের স্হানীয় নেতারা ঘটনার জন্য গোষ্ঠী কোন্দলকে দুষছেন। নিজেদের মধ্যকার নেতৃত্বের এবং গত ইউপি নির্বাচনকে ঘিরে সৃষ্ট কোন্দলের জের ধরে হামলার সময় দলীয় নেতাকর্মীরা নিশ্চুপ থেকেছেন বলে বলা হচ্ছে।

এদিকে প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার নির্দেশে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ফরিদুলহক খান এমপি, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য এমপি, হুইপ পঞ্চানন বিশ্বাস এমপি, সাবেক প্রতিমন্ত্রী ড. বীরেন শিকদার, মনোরঞ্জন গোপাল শীল এমপি, উসিম কুমার উকিল এমপি, পংকজ দেব নাথ এমপি, হিন্দু ধর্ময় কল্যাণ ট্রাস্টের ভাইস চেয়ারম্যান সুবু্রত পাল, ট্রাস্টি শ্যামল সরকার মঙ্গলবার ঘটনাস্হল পরিদর্শন ও স্হানীয় সুধীসমাজের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। জেলা প্রশাসকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় স্হানীয় হিন্দু বৌদ্ধ খ্িরষ্টান পরিষদ, পূজা পরিষদ, ইমাম পরিষদ নেতৃবৃন্দ উপস্হিত ছিলেন।

বক্তারা উভয় ঘটনায় দায়িত্বের শাস্তির আওতায় আনার ওপর গুরুত্ব দিয়ে বলেন—তা না হলে এ রকম ঘটনা আরো ঘটবে। তারা বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্যে দিয়ে দেশে যে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সূচনা করা হয় তারই ধারাবাহিকতায় দেশের বিভিন্ন জায়গায় সম্প্রতি নষ্টের মতো জঘন্য কর্মকাণ্ড চলছে।

সভায় হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত চারটি মন্দিরের জন্য ৫০ হাজার করে ২ লাখ টাকার চেক তুলে দেন ট্রাস্টের চেয়ারম্যান ফরিদুল হক খান এমপি। এ ছাড়া স্বপন ভট্টাচার্য দীঘলিয়া গ্রামের সব কাঁচা রাস্তা পাকা করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।

এদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বুধবার ঢাকার একটি সেমিনারে বলেছেন, নড়াইল ঘটনায় কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করা হয়েছে। গ্রেফতার হয়েছে সাত জন। আরো অভিযান চলছে।

এদিকে জেলা প্রশাসন তাত্ক্ষণিক নগদ টাকাসহ খাদ্যসহায়তা ঘোষণা করেছেন। আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে বাড়িঘর মন্দির নির্মাণের কাজ শুরু হয়ে গেছে।

গতকাল বুধবার আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল দীঘলিয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িঘর ও উপাসানালয় পরিদর্শন করেন। পরে এক মতবিনিময় সভায় সভাপতিত্ব করেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট সুভাষ চন্দ্র বোস। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হক, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক কবিরুল হক মুক্তি এমপি, মাশরাফি বিন মোর্ত্তজা এমপি, জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দসহ সনাতন ধর্মাবলম্বীর নেতারা বক্তব্য দেন।

ইত্তেফাক/জেডএইচডি

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন