শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

থাই মহাকাব্য রামাকীইন-কথা

আপডেট : ২২ জুলাই ২০২২, ০৯:৩৯

ব্যাংককের সুবর্ণভূমি এয়ারপোর্টের ভেতরে অনেক ছবি, ভাস্কর্য আছে যা প্রায় সবই রামায়ণ-মহাভারত থেকে নেয়া। সেইসঙ্গে সুর-অসুরের যৌথ সমুদ্রমন্থনের বিশাল আকারের ভাস্কর্যটাকে এয়ারপোর্টের মূল আকর্ষণ বলা যায়। এখানে দানব ও দেবতার ঘাম ঝরানো যৌথ প্রয়াস, মন্থনদ হিসাবে মন্দর পর্বত, রজ্জুরূপে বাসুকি নাগ, মন্থনে উঠে আসা মনি-মানিক্য, অমৃত-হলাহল সবই বিস্তারিত দেখানো হয়েছে। এর বাইরে শহরে পুরানো রাজবাড়িতে মূর্তি যা আছে সবই প্রায় রামায়ণ-মহাভারত থেকে নেয়া। একটা বিষয় সেখানে ব্যতিক্রম মনে হয়েছে। মন্দিরের রক্ষীর যে মূর্তি, নাম তার রাবণ। গাত্রবর্ণ নীলাভ কালো, যেখানে অন্য সব মূর্তিই দুধেআলতা রঙের।

ব্যাংকক থেকে ঘণ্টা দুয়েকের রাস্তা পেরিয়ে একটা পুরানো শহরে যাওয়া যায়, নাম তার আয়ুথিয়া। ওরা বলে এটাই আদি অযোধ্যা। রাম এখানেই জন্মেছিলেন। অনেক পুরানো মন্দির স্থাপনার দেখা মেলে সেখানে। একটা নদীর পারে শহরটি, নদীর নাম ভুলে গেছি। সিয়াম রাজাদের রাজধানী ছিল। এই সিয়াম থেকেই শ্যামদেশ। থাইল্যান্ডের প্রধান ব্যাংক—ব্যাংক অব সিয়াম। থাইল্যান্ড মিয়ানমার বর্ডারের কাছাকাছি কাঞ্চনাবুরি নামে একটা জায়গা আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতি জড়ানো কাওয়াই নদী, তার ওপর রেল সেতু। ‘দ্য ব্রিজ অন দ্য রিভার কাওয়াই’।

থাইসংস্কৃতি একেবারেই ভারতীয় সংস্কৃতির কাছাকাছি। শ্যামদেশ, কম্বোজে এই সংস্কৃতিই আজো আছে। আছে ইন্দোচীন বা ভিয়েতনাম; এমনকি মালয় বা ইন্দোনেশিয়াতেও। ইন্দোনেশিয়াতে সরকারি বিমানের নাম গারুডা এয়ারলাইন্স। গরুড় এয়ারলাইন্স। গরুড়পুরাণ হলো হিন্দুধর্মের ১৮টি মহাপুরাণের অন্যতম। হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী, গরুড় বিষ্ণুর বাহন। গরুড় শব্দের অর্থ বাক্যের ডানা। তিনি বৈদিক জ্ঞানের প্রতীক। ভারতীয় রামায়ণের মূল চরিত্র ‘রাম’ হিন্দু দেবতা বিষ্ণুর অবতার। থাই মহাকাব্য ‘রামাকীইন’ ভারতীয় মহাকাব্য ‘রামায়ণ’-এর অনুরূপ। যদিও মহাকাব্য দুটির মধ্যে সুনির্দিষ্ট কিছু পার্থক্য রয়েছে। অন্যতম পার্থক্যটি হচ্ছে, রামাকীইন থাইল্যান্ডের বৌদ্ধ ধর্মের পটভূমির ওপর প্রতিষ্ঠিত কাব্য; রামায়ণ হিন্দু পৌরাণিক দেবদেবীর ওপর প্রতিষ্ঠিত কাব্য।

ভারতীয় রামায়ণের মতো একইভাবে রামাকীইনও থাইল্যান্ডের নাট্য, সংগীত, নৃত্যকলা ও ছায়ানাট্যকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে এবং এখনো করছে। মৌলিক গল্পটি রামায়ণের গল্পের সঙ্গে বেশ মিলে যায়, রামাকীইনের নায়ক রামা ও তার পত্নী সীতা বনবাসী হয়, তারপর সীতার অপহরণ ও মুক্তি, একইভাবে দেবতা হনুমানের সহায়তায়।

রামাকীইনের মূল চরিত্র ‘রামা’ একজন থাই রাজপুত্র যে পূর্ব জন্মে ‘বুদ্ধ’ ছিল। রামায়ণে দৈত্যরাজা রাবণ ছিল ভয়ংকর দুষ্টপ্রকৃতির। অপরদিকে রামাকীইনের তশাকান্ত চরিত্র ছিল সীতার প্রণয়াসক্ত, সে যুদ্ধ করেছিল প্রকৃত ভালোবাসার আবেগ দ্বারা তাড়িত হয়ে, অন্যদিকে যুদ্ধে রাবণ ছিল পঙ্কিল অহংকার ও ঘৃণা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে।

পণ্ডিতরা এখনো সঠিকভাবে নির্ণয় করতে পারেননি প্রথম কখন ও কীভাবে ভারতীয় রামায়ণ থাই পৌরাণিকের সঙ্গে মিশে যায়। তবে তাঁরা এটাই ধারণা করে সেই সময়টা প্রথম শতাব্দীতে অর্থাত্ আজ থেকে প্রায় ২০০০ বছর পূর্বে যখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ভারতীয় সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত ছিল। রামাকীইনের সবচেয়ে জনপ্রিয় সংস্করণটি লেখা হয় আঠারো শতকে রাজা রামা ১-এর সময়, আর দ্বিতীয় সংস্করণটি লেখা হয় তার পুত্র রামা ২-এর সময়। পরেরটি লেখা হয় থাইল্যান্ডের জনপ্রিয় খন থিয়েটার আর ঐতিহ্যগত ক্লাসিক্যাল নাচে ব্যবহারের জন্য।

‘রামায়ণ’কে হিন্দুরা যেমন পবিত্র ধর্মগ্রন্থ হিসেবে মেনে চলে ঠিক তেমনি থাইল্যান্ডের বৌদ্ধরা ‘রামাকীইন’কে মেনে চলে পবিত্র গ্রন্থ হিসেবে। রামাকীইন থাইল্যান্ডে এতই জনপ্রিয় যে সেখানকার ছেলেমেয়েদের নাম আজো রাখা হয় সেই অমর কাব্যগ্রন্থের বিভিন্ন চরিত্রের সঙ্গে মিলিয়ে।

ইত্তেফাক/এসজেড

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন