শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

কালো সূর্য

আপডেট : ২২ জুলাই ২০২২, ১০:০০

আমাদের দোতলা ভবন আর স্কুলের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে বৃদ্ধ বটগাছটা। দিনে স্কুলের বাচ্চা-কাচ্চারা গাছের নিচে খেলা করলেও রাতে এর ধারেকাছেও কেউ আসে না। কেউ কেউ নাকি বহু বছর আগে আত্মহত্যা করা এক নারীর কান্নার আওয়াজ শোনে। আবার নৃত্যরত আগুনের দলাও দেখে কেউ কেউ। আমার চোখে কোনোদিন কিছু পড়েনি, কখনো কিছু শুনিওনি।

আমি শুনি নানান পাখির চিৎকার; তাদের হাসি, কান্না; শুনি তাদের অট্টহাসি! ঢাকার অলিগলি, স্ট্রিট-লেনের মতো গাছটার সহস্র ডালপালা। কোনটার সঙ্গে কোনটা গিয়ে প্যাঁচ খেয়েছে— বোঝা মুশকিল। সেখানেই ঠিক বস্তির মতো অসংখ্য পাখির বাসা। আবার মগডালে মনে হয় যেন খয়েরি কিংবা ধূসর রঙের পলিথিনের বহু ঠোঙা ঝুলে আছে; আসলে সেগুলো বাদুড়।

আমাদের ছাদের ওপরের দক্ষিণ দিকটায় উন্মুক্ত ছাতার মতো কয়েকটা ডাল ছায়া দিয়ে যায়। আমি আর আমার ছোট্ট মেয়ে প্রায়ই হাওয়া খাই এখানে এসে। আমার ছোট্ট মেয়ের নানাবিধ প্রশ্ন—‘বাবা, এটা কী? বাবা, ওটা কী?’

অনেক সময় জবাব দিতে দিতে যদি ক্লান্ত হয়ে যাই। উলটো দম ধরে ওকেই সওয়াল করি—‘তুমিই বলো, কী নাম ওটার?’

সে সাবলীলভাবে জবাব দেয়—‘কাক!’

‘ওটা?’

‘বুলবুলি।’

‘আর ঐ যে ওটা?’

‘সারস!’

‘না, মা। ওটা সারস নয়। ওটা বক।’ আমি বলি।

আসলে সারস আর বকের খুব বেশি তফাত না থাকায় মাঝে মাঝে গুলিয়ে ফেলে সে। ছোট মানুষ, আমার কথায় মন ভরে না তার। আরো ব্যাখ্যা চায়। শেষমেশ যখন বলি সারস তো পরিযায়ী পাখি, এই ভরা গ্রীষ্মে ওরা আর এখানে থাকে না। ঠান্ডা কোনো অঞ্চলে চলে গেছে। গ্রীষ্ম গেলে ফের চলে আসবে। মেয়ে আমার নীরবে শোনে। হঠাত্ মেয়ে নাক সিঁটকে বলে, ‘বাবা, গন্ধ!’

‘কীসের গন্ধ?’

‘পাচ্ছ না তুমি? উহ! থু!’

আমি টের পাই। একটা চিল অদূরেই বসে তার ব্লেডের মতো ধারালো ঠোঁটে একটা মরা ইঁদুর ছিঁড়ে খাচ্ছে। ধীরে ধীরে দু-একটা কাক জুটে যায়। ভাগ বসাতে চায়, কিন্তু চিল উড়ে যায়। অন্য একটা ডালে। তারপর আকাশে হারায়।

মেয়ের মনোযোগ ভিন্ন খাতে নেওয়ার জন্যে বলি, ‘মা, বলো দেখি, চিল ওড়ে কেমন করে?’

সে দু হাত তুলে দেখায়। কিন্তু দুর্গন্ধের কথা ভোলে না। আমি সান্তনা দিই, বাতাস উঠলে কিংবা বৃষ্টি এলে এই গন্ধ আর থাকবে না, মা। সান্ত¾না দিতে দিতে সিঁড়ি ভেঙে নেমে আসি নিচে।

সূর্যটাও নামে, নামে বিকেলের পিছে গোধূলি। তার পিছনে নামে রাত। আঁধার রাত। আম-কাঁঠাল পাকা প্রচণ্ড গরম যেন খামছে ধরে আছে পৃথিবীটাকে।

হঠাৎ বজ্রপাতের শব্দে ঘুম ভাঙে আমার। তড়িঘড়ি উঠে খোলা জানালা বন্ধ করি। মনের গহিনেও ঝড় বয়ে যায়। প্যাঁচাটা ভিজছে। বাদুড়েরা ভিজছে। ভিজছে কাক, দোয়েল, শালিক সবাই। বৃষ্টি আর বজ্রপাতের সুরে চাপা পড়ে পাখিদের কান্নার শব্দ। আর চাপা পড়ে ঘুমে আমার বিলাসী অনুভূতিরা।

ঝড়ের কারণে শীতল হওয়াবশত একটু বেশিই ঘুমাই। তাছাড়া আজ শুক্রবারও, বন্ধের দিন। আমার মেয়ে এসে ‘বাবা, ওঠো; বাবা, ওঠো’—সরবে ডাকে। জেগে দেখি বেলা ন’টা বাজে। কোনো বৃষ্টি নেই, কোনো ঝড় নেই। জানালার থাই গ্লাস ভেদ করে তেজস্বী সূর্যের আলোয় আলোকিত আমাদের মুখ।

হঠাৎ একটা কাকের গোঙানির শব্দে আমার চোখে চোখ রাখে মেয়ে।

‘কোথায়?’

‘মনে হচ্ছে, ছাদে।’ আমি বলি।

জলদি ছাদে উঠি আমরা। খুঁজে ফিরি কাকটাকে। ছাদে নয়, স্কুল মাঠের এক প্রান্েত। রাতভর বৃষ্টিভেজা কাকটাকে ধরেছে কুকুর। কামড়াচ্ছে, হাতাচ্ছে, ভয় দেখাচ্ছে। একদম জেরবার কাক। মাঠে একটা কুকুর খেলে। আর দুই-তিনটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে, হাসে, লেজ নাড়ে।

সূর্যের আলোয় ঝলমলে এই দিনে সবকিছু দেখা যায়। শুধু দেখা যায় না অন্য কোনো কাককে। শালিক, ফিঙে কিংবা অন্য কোনো পাখিও চিৎকার-চেঁচামেচি করে না। কেমন গুমোট এক অন্ধকার আবহে ডুবে আছে সবাই, সবকিছু। স্কুলের বারান্দায় উঠতি বয়সের কিছু কিশোর দেখতে পাই।

তাদের সব ক’টা মাথা একসঙ্গে বৃত্তাকারে অবনত। খুব সম্ভব মোবাইল গেমসে ডুবছে। পাবজি অথবা ফ্রি ফায়ার। আমি হাঁক ছাড়ি—‘এয় জাফর, এয় জয়, এয়...!’

বার তিনেক ডাকার পরে মাথা তোলে জাফর। আমি ইশারা করে তাদেরকে কাকটাকে বাঁচাতে বলি। জাফর হিশহিশ শব্দ করে তাড়াতে চেষ্টা করে কুকুরদের। জয় মোবাইলে ভিডিও ধারণে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ততক্ষণে পরাজিত হয় কাকটা!

ইত্তেফাক/এসজেড

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন