পবিত্র নগরী মক্কায় আসা এবং এখানের আচার-অনুষ্ঠান সম্পাদন, ভ্রমণ ইত্যাদি কার্যক্রমের মধ্যেই শুধু হজের উদ্দেশ্য শেষ হয়ে যায় না বরং হজ-পরবর্তী সময়েও রয়েছে তাদের জন্য বিশেষ জীবনযাপন ও আমলি জিন্দেগি। একনিষ্ঠ একত্ববাদের আলোকে জীবন পরিচালনার জন্য অন্যতম সহায়ক হলো হজ। সুতরাং হজ-পরবর্তী জীবন হবে তাওহিদ-নির্ভর। হজ-পরবর্তী এমন কোনো কাজই করা যাবে, যেখানে তার সঙ্গে শিরক বা অংশীদারত্বের ন্যূনতম সম্পর্ক রয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ ও তার রসুলের পক্ষ থেকে মহান হজের দিনে মানুষের প্রতি (বিশেষ) বার্তা হলো, আল্লাহর সঙ্গে শিরককারীদের কোনো সম্পর্ক নেই এবং তার রসুলের সঙ্গেও নেই।’ (সুরা তাওবা: আয়াত ৩)
হজের পর গোনাহমুক্ত জীবনযাপনই হলো হজ কবুল হওয়ার লক্ষণ। হজের পর হজ পালনকারীদের উচিত আল্লাহর বিধি-বিধান পালনের প্রতি যথাযথ গুরুত্বারোপ করা। হজ পালনকারীদের উদ্দেশ্যে তাদের বাকি জীবনের করণীয় সম্পর্কে মহান আল্লাহ তাআলা কোরআনুল কারিমে ঘোষণা করেন—অর্থ ‘অতঃপর যখন তোমরা (হজের) যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করে নেবে, তখন (মিনায়) এমনভাবে আল্লাহর (জিকির) স্মরণ করবে, যেমন (জাহেলি যুগে) তোমরা তোমাদের পিতৃপুরুষগণকে স্মরণ করতে অথবা তার চেয়েও বেশি গভীরভাবে (স্মরণ করবে)। এমন কিছু লোক আছে যারা বলে—হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে দুনিয়াতে (সাওয়াব) দান করো।’ মূলত তাদের জন্য পরকালে (কল্যাণের) কোনো অংশ নেই।’ (সুরা বাকারা: আয়াত ২০০) পক্ষান্তরে তাদের মধ্যে এমন কিছু লোক আছে যারা বলে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে দুনিয়াতে কল্যাণ দান করো এবং পরকালেও কল্যাণ দান করো। আর আমাদেরকে দোজখের যন্ত্রণা থেকে রক্ষা করো।’ (সুরা বাকারা: আয়াত ২০১)
ইসলাম-পূর্ব যুগে আরবের লোকেরা হজ সম্পাদন করেই মিনায় মেলার আয়োজন করত। তাই আল্লাহ তাআলা জাহেলি যুগের সে রীতির পরিবর্তন করে মানুষকে নির্দেশ দেন যে, হজের পর মেলা নয় বরং আল্লাহর স্মরণই সর্বোত্তম। আর তা মৃত্যু পর্যন্ত অব্যাহত রাখা আবশ্যক।
হজের পর করণীয়:১. মহল্লার মসজিদে শুকরিয়া নামাজ আদায় করা—হজরত কাব বিন মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন কোনো সফর থেকে ফিরে আসতেন, তখন মসজিদে (নফল) নামাজ আদায় করতেন।’ (বুখারি) আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে আর্থিক ও শারীরিক ইবাদত হজের দীর্ঘ সফর শেষে যখন কোনো মানুষ নিজ বাড়িতে ফিরবে তার উচিত নিজ মহল্লার মসজিদে গিয়ে দুই রাকাআত নামাজ আদায় করা, অতঃপর ঘরে ফেরা। ২. বাসায় শুকরিয়া নামাজ আদায় করা—নিজ ঘরে প্রবেশের পরও শুকরিয়াতান দুই রাকাআত নামাজ আদায় করা মোস্তাহাব। হাদিসে এসেছে—রসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘যখন তুমি ঘর থেকে বের হবে, তখন দুই রাকাআত নামাজ পড়বে। এ নামাজ তোমাকে ঘরের বাইরের বিপদাপদ থেকে হেফাজত করবে। আর যখন ঘরে ফিরবে, তখনো দুই রাকাআত নামাজ আদায় করবে। এ নামাজ তোমাকে ঘরের অভ্যন্তরীণ বালা-মুসিবত থেকে হেফাজত করবে।’ (মুসনাদে বাজ্জার)
৩. খাদ্য দান করা: নিরাপদে হজ পালন করে দেশে ফিরে আসার পর শুকরিয়াস্বরূপ গরিব-মিসকিন ও আত্মীয়স্বজনকে খাবারের দাওয়াত দেওয়াও বৈধ। হাদিসে এসেছে—হজরত জাবের বিন আবদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, ‘রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মদিনায় এসেছেন, তখন একটি পশু জবাইয়ের নির্দেশ দেন। জবাইয়ের পর সাহাবায়ে কেরাম তা থেকে আহার করেছেন।’ (বুখারি) ইসলামি ফিকহের পরিভাষায় সে খাবারকে ‘নকিয়াহ’ বলা হয়।
৪. বেশি বেশি এ জিকির করা: উচ্চারণ—রাব্বানা আতিনা ফিদ্দুনিয়া হাসানাতাও ওয়া ফিল আখেরাতি হাসানাতাও ওয়া কিনা আজাবান নার।’ অর্থ: ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে দুনিয়াতে কল্যাণ দান করো এবং পরকালেও কল্যাণ দান করো। আর আমাদেরকে দোজখের যন্ত্রণাদায়ক আগুন থেকে রক্ষা করো।’
৫. অভ্যর্থনা ও শুভেচ্ছা জানানো: যারা হজ করে এসেছেন তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ, মুসাফাহ ও কোলাকুলি করা এবং তাদের দিয়ে দোয়া করানো মুস্তাহাব। কিন্তু ফুলের মালা দেওয়া, তাদের সম্মানার্থে স্লোগান ইত্যাদি দেওয়া সীমা লঙ্ঘনের অন্তর্ভুক্ত। এসব কাজ থেকে বিরত থাকা উচিত। (আপকে মাসায়েল আওর ইনকি হল, খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা: ১৬২) ৬. জমজমের পানি বিতরণ—হজে গেলে হজযাত্রীরা জমজমের পানি সংগ্রহ করেন। বাড়িতে আসার সময় নিয়ে আসেন। এটা একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। জমজমের পানি নিয়ে এসে লোকদের পান করানো মুস্তাহাব। অসুস্থ রোগীদের গায়ে ব্যবহার করাও বৈধ। (মুয়াল্লিমুল হুজ্জাজ, পৃষ্ঠা: ৩০৩) আয়েশা (রা.) জমজমের পানি সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন এবং বলতেন, ‘রসুল (সা.) জমজমের পানি সঙ্গে নিয়ে যেতেন।’ (তিরমিজি, হাদিস: ১১৫)
পরিশেষে নামাজ পড়েন বিধায় নামাজি; হজ করেছেন বিধায় হাজি ইত্যাদি উপাধি ব্যবহার থেকে বিরত থাকা জরুরি। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে লোক দেখানো ইবাদাত-বন্দেগি থেকে হিফাজত করুন।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি