মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের আকাশে এখনো ঝলমল করছে অসংখ্য তারকা। কিন্তু সে তারকারাজি থেকে আরেকটি তারকা খসে পড়ল। সে তারকা হলেন দুঃসাহসিক বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মেজর জেনারেল মুহাম্মদ আইন উদ্দিন, বীরপ্রতীক। ২ আগস্ট সকাল সাড়ে সাতটায় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে এ নশ্বর পৃথিবীর মায়া ছেড়ে তিনি মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে ফিরে গেলেন। ‘নিশ্চয় আমরা সবাই আল্লাহর জন্য এবং আমরা সবাই তারই সান্নিধ্যে ফিরে যাব।’—[সুরা বাকারা ২ :১৫৬]
সামরিক বাহিনীর সুপরিচিত এ মুক্তিযোদ্ধা জেনারেল বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির প্রতিষ্ঠার সঙ্গে জড়িত। তার অনবদ্ধ অবদান যেমন মুক্তিযুদ্ধে বিস্তৃত, একইভাবে সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর পুনর্গঠন ও শক্তিশালী প্রতিরক্ষা বাহিনীর গঠনেও তা কোনো অংশে কম নয়। তিনি সামরিক আইনজ্ঞ হিসেবেও সবার কাছে সম্মানিত ছিলেন। মহান এ বীর সেনানী ১৯৪৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি কিশোরগঞ্জ জেলার লক্ষ্মীপুরের কুলিয়ার চরে জন্ম গ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন জনাব সুরুজ আলী।
১৯৬৫ সালে তিনি প্রথম পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি (পিএমএ) ওয়ার কোর্সের ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন এবং ১৯৬৬ সালের ৮ তিনি সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে কমিশন লাভ করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের চতুর্থ ব্যাটালিয়ন, চার ইস্ট বেঙ্গলে যোগদান করেন। চার ইস্ট বেঙ্গল সামরিক বাহিনীতে ‘বেবি টাইগার’ হিসেবে পরিচিত। এ ইউনিটে তিনি লেফটেন্যান্ট ও পরবর্তীকালে ক্যাপ্টেন হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে পল্টনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদ ‘কোয়ার্টার মাস্টারে’র দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭১ সালে চার ইস্ট বেঙ্গলের অবস্থান ছিল কুমিল্লা ময়নামতি সেনানিবাসে। সে ইউনিটের অধিনায়ক ছিলেন লে. কর্নেল খিজির হায়াত খান (অবাঙালি), উপ-অধিনায়ক মেজর খালেদ মোশাররফ, আরো ছিলেন মেজর শাফায়াত জামিল। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর যখন গণহত্যা চালানোর জন্য সব পূর্বপ্রস্ত্ততি গ্রহণ করছে এবং এরই অংশ হিসেবে চার ইস্টবেঙ্গলকে বিভিন্ন ক্ষুদ্রাংশে বিভক্ত করে সেনানিবাসের বাইরে পাঠিয়ে ইউনিটকে দুর্বল করার দুঃর্ভিসন্ধি বাস্তবায়ন করার জন্য বাঙালি অফিসারগণকে ব্যবহার করছে; মহান আল্লাহ তাদের পরিকল্পনাকে স্বাধীনতা অর্জনের অনুকূলে কাজে লাগান।
ইউনিটের ‘কোয়ার্টার মাস্টার’ হিসেবে ক্যাপ্টেন আইন উদ্দিনের দায়িত্ব ছিল যুদ্ধের জন্য অস্ত্র গোলাবারুদ, যানবাহন, সাঁজ-সরঞ্জামাদি, খাদ্যসামগ্রী, রসদ ইত্যাদি জোগান দিয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্ত্তত করা। আর এ সুযোগটি তিনি শত ভাগ কাজে লাগিয়েছেন তার নিজের ইউনিটের বিচ্ছিন্ন হওয়া কোম্পানিগুলোকে রণসজ্জায় সজ্জিত করে। মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর সাফায়াত জামিল ও অন্যান্য অফিসার ও জওয়ানগণ এ কারণেই বিপুল শক্তি নিয়ে শত্রুকে সহজেই ঘায়েল করতে পেরেছিলেন। ইউনিট যখন সম্পূর্ণ প্রস্ত্ততি নিয়ে ব্রাম্মণবাড়িয়া ও সিলেটে অবস্হান করছে, ক্যাপটেন আইন উদ্দিন একদিন পাকিস্তানিদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে তার প্রিয়তমা স্ত্রী ও দুগ্ধপোষ্য কোলের দুই ছোট্ট মেয়েকে সেনানিবাসে ফেলে রেখে সাইকেলে করে সেনানিবাস থেকে পালিয়ে যুদ্ধের ময়দানে চলে আসেন মাতৃভূমিকে স্বাধীন করার জন্য। এরপর ক্যাপটেন আইন উদ্দিন চার ইস্ট বেঙ্গল ও দুই নম্বর সেক্টরের অধীনে বিভিন্ন অপারেশনে সফলতার সঙ্গে অংশ গ্রহণ করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে নাস্তানাবুদ করতে থাকেন। এক সময় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের নবম ইউনিট অর্থাত্ ৯ ইস্ট বেঙ্গল প্রতিষ্ঠা করার জন্য তাকে মেজর পদে পদোন্নতি দিয়ে অধিনায়কের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। চার ইস্ট বেঙ্গলের একটি কোম্পানি ও দক্ষ মুক্তিযোদ্ধাগণকে নিয়ে ক্যাপটেন আইন উদ্দিন অতি অল্প সময়ে পল্টনের প্রতিষ্ঠা করেন এবং যুদ্ধপোযোগী হিসেবে গড়ে তোলেন। ৯ ইস্ট বেঙ্গল একের পর এক যুদ্ধ শুরু করে তাঁর দক্ষ নেতৃত্বে। ১৯৭১ সালের ২১ অক্টোবর কসবাকে তিনি হানাদার বাহিনীর দখল থেকে মুক্ত করেন। মুক্ত করেন চন্দ্রপুর, লাকুমুড়া, কৃষ্ণপুর, বাগবাড়ি এবং কুমিল্লা শহর। এরপর মিরপুর মুক্তকরণেও তিনি অংশগ্রহণ করেন।
দেশ স্বাধীন হবার পর তিনি কঠিন পরিশ্রম করতে থাকেন সেনাবাহিনীর উন্নতির জন্য। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অসামান্য অবদান ও বীরত্ব প্রদর্শন ও বীরত্বসূচক অবদানের জন্য ১৫ ডিসেম্বর ১৯৭৩ তারিখে চতুর্থ সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় ও বীরত্বসূচক খেতাব ‘বীরপ্রতীক’ হিসেবে ভূষিত করা হয়। এরপর লে. কর্নেল, কর্নেল, ব্রিগেডিয়ার ও মেজর জেনারেল পদ লাভ করেন। তিনি কঠোর পরিশ্রম করতে থাকেন নবগঠিত সেনাবাহিনী তথা সামরিক বাহিনীকে একটি শক্তিশালী অবয়ব দেওয়ার জন্য। তিনি দেশে-বিদেশে উচ্চতর সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তিনি সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ যেমন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের প্রধান প্রশিক্ষক, প্রশাসনিক স্কুলের কমান্ড্যান্ট, ৭২ পদাতিক ব্রিগেডের কমান্ডার, বাংলাদেশ রাইফেলসের উপমহাপরিচালক, ঢাকা লজিস্টিক এরিয়ার কমান্ডার হিসেবে অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সামরিক ও বেসামরিক আইনের ওপর বিশেষজ্ঞ ছিলেন। সর্বশেষ তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ১৯ পদাতিক ডিভিশন, যা ঘাটাইল সেনানিবাসে অবস্হিত। অতঃপর দীর্ঘ ত্রিশ বছর চাকরি করার পর ১৯৯৬ সালের ১৪ জুন তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
একটি আদর্শ ও সুখী পরিবারের জনক জেনারেল আইন ছিলেন তিন কন্যা ও এক পুত্র সন্তানের জনক। তার বড় মেয়ের স্বামী একজন ব্যাংকার, আল-আরফাহ ব্যাংকের ডিএমডি, দ্বিতীয় মেয়ের স্বামী বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সুপরিচিত অফিসার লে. কর্নেল মেসবাহ রবিন (অব.), তৃতীয় মেয়ের স্বামী মেজর জাহেদ এবং একমাত্র পুত্র মুহাম্মদ ফখরুদ্দিন। আরো রেখে যান সাত প্রপৌত্র ও দুই প্র-প্রপৌত্র। আমরা এ বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের মৃতু্যতে গভীর শোক ও তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।
লেখক : কর্নেল, পিএসসি (অব.), সামরিক ইতিহাস ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ