শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

চীন-তাইওয়ান সংঘাত, দুশ্চিন্তায় বিশ্ব

আপডেট : ০৮ আগস্ট ২০২২, ০১:৫৭

তাইওয়ানের উত্তর উপকূলে একটি মাছের বন্দরে বসে ছিলেন এক মৎস্যজীবী। তার নিজের একটি মাছ ধরার ট্রলার আছে। তিনি বিবিসিকে বলেন, ‘যখন রাজনীতিবিদরা লড়াই করে তখন আমাদের মতো ক্ষুদ্র মানুষ জন সেটির খারাপ ফলাফল ভোগ করে।’ এর প্রমাণ রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ। এটা চলছে গত ছয় মাস ধরে। অনেক দেশ থেকে হাজার হাজার মাইলে দুটি দেশ অবস্থিত হলেও পুরো বিশ্বকেই এই যুদ্ধের মাশুল গুনতে হচ্ছে। বিশ্ব বাজারে তেলের দাম হু হু করে বাড়ছে। ফলে বাড়ছে মূল্যস্ফীতি, বাড়ছে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম। অনেক দেশে সরকার পতনেরও আশঙ্কা করা হচ্ছে। অর্থনৈতিক অস্থিরতা রূপ নিচ্ছে রাজনৈতিক অস্থিরতায়। শ্রীলঙ্কা এর সাম্প্রতিক উদাহরণ হিসেবে রয়ে গেছে। এই আতঙ্কের মধ্যেই চীনের সঙ্গে তাইওয়ানের এক প্রকার সংঘাত বেঁধে গেছে। মার্কিন কংগ্রেসের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির সফরকে ঘিরে তাইওয়ান প্রণালিতে যেন যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে। যদিও বিশ্লেষকরা বলছেন, চীন কিংবা আমেরিকা কেউই এখন যুদ্ধের ময়দানে পা বাড়াবে না। তবে চীন যে তাইওয়ান দখল করে নিতে পারে, সেটা দেখাতেই বেইজিং যুদ্ধের রিহার্সেল দিতে সামরিক মহড়ার মাধ্যমে আতঙ্ক তৈরি করছে।

  • যে কারণে দুশ্চিন্তায় বিশ্ব

ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে খাদ্যশস্য রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এবং রাশিয়ার তেলের ওপর পশ্চিমা বিশ্ব নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় বিশ্ব বাজার এখন অস্হিতিশীল হয়ে উঠছে। এর মধ্যে তাইওয়ান ও চীনের মধ্যকার সংঘাত আতঙ্ক আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। কারণ তাইওয়ানও এশিয়া তথা বিশ্বের জন্য কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাইওয়ানকে মাত্র ১৩টি দেশ স্বীকৃতি দিলেও পুরো পৃথিবী এর ওপর নির্ভর করে। তাইওয়ান সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে। বিশ্বে সেমিকন্ডাক্টরের যে বাজার তার ৬৪ শতাংশই তাইওয়ানের নিয়ন্ত্রণে। শুধুমাত্র তাইওয়ান সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং কো বা টিএসএমসি বিশ্বের অর্ধেকের বেশি সেমিকন্ডাক্টর তৈরি করে।


স্মার্টফোন থেকে শুরু করে যুদ্ধবিমান, সব জায়গায় দরকার পড়ে এই সেমিকন্ডাক্টর। দেশটির রপ্তানির ৪০ শতাংশই আসে সেমিকন্ডাক্টর থেকে, জিডিপিরও ১৫ শতাংশ নির্ভর করে এর ওপর। এই সেমিকন্ডাক্টরের কারণেই কৌশলগত দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোর কাছে তাইওয়ান গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া প্লাস্টিক ও প্লাস্টিক সামগ্রী, অপটিক্যাল, চিকিৎসা যন্ত্রপাতি, যানবাহন, লোহা, ইস্পাত, জৈব রাসায়নিক, তেলসহ খনিজ জ্বালানি, তামা, মত্স্যজাত পণ্য, চা, মধু, প্রাকৃতিক বালু ও আনারসসহ আরো অনেক কিছু বিশ্বে রপ্তানি করা হয়। এসব পণ্যের রপ্তানি বন্ধ হয়ে বিশ্ব অর্থনীতি বড় ধরনের ধাক্কা খাবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। আবার নিজেদের মোট রপ্তানির ৩০ ভাগই চীনে পাঠায় তাইওয়ান। তাই চীনের যে কোনো নিষেধাজ্ঞাই বড় প্রভাব ফেলে দেশটির উপরে। ইতিমধ্যে তাইওয়ানগামী অনেক বিমানের ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে। সমুদ্রপথেও জাহাজ চলাচল বন্ধ প্রায়। তাইওয়ানের প্রধানমন্ত্রী সু সেং-চাং শুক্রবার সাংবাদিকদের বলেন, চীন নির্বিচারে সামরিক মহড়া চালিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে ব্যস্ত জলপথ ধ্বংস করে দিচ্ছে। আবার বিশ্বে এখন আরো যেসব সংকট মোকাবিলায় বড় দুই পরাশক্তির মনোযোগ দেওয়া দরকার, সেই চেষ্টায় আগে থেকেই ঘাটতি দেখা যাচ্ছিল, এখন সেটা যেন আরো বেশি ভেস্তে যাবে।

  • যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তাইওয়ান কতটা গুরুত্বপূর্ণ

আমেরিকার কাছে তাইওয়ানের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব আছে। চীনের সামরিক প্রভাব খর্ব করতে আমেরিকা তাদের প্রভাব রাখতে চায় ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া থেকে শুরু করে জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়া পর্যন্ত। তাইওয়ান এর মাঝখানে এবং চীনের খুব কাছাকাছি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আমেরিকার সামরিক বিশেষজ্ঞরা বুঝতে পারছিলেন যে, পশ্চিমাপন্থী কিংবা নিরপেক্ষ তাইওয়ান আমেরিকার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চীন যদি শক্তি প্রয়োগ করে তাইওয়ান দখল করে নেয় এবং আমেরিকা যদি সেটি আটকাতে ব্যর্থ হয়, তাহলে এশিয়ায় আমেরিকার প্রভাব খর্ব হয়ে যাবে। ১৯৭৯ সালে প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের সময় ‘তাইওয়ান রিলেশন অ্যাড’ করা হয়। এর মাধ্যমে তাইওয়ানকে সামরিক সহায়তা ছাড়াও অন্যান্য সহায়তা দেয় আমেরিকা। স্টেট ডিপার্টমেন্টের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, স্বাধীন তাইওয়ানের বিষয়টিকে আমেরিকা সমর্থন করে না। অন্যদিকে, তাইওয়ানকে যেভাবে চীন তাদের অংশ বলে দাবি করছে, সেটিও মানে না আমেরিকা। তবে স্বাধীন রাষ্ট্র বলে স্বীকৃত না হলেও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় তাইওয়ান যাতে সদস্যপদ পেতে পারে, সেজন্য আমেরিকা সমর্থন দেয়। গত ২ আগস্ট তাইওয়ান সফরে গিয়েছিলেন মার্কিন কংগ্রেসের স্পিকার পেলোসি। গত ২৫ বছরে এই পদমর্যাদার কোনো মার্কিন রাজনীতিক তাইওয়ানে যাননি। বস্তুত, তাইওয়ানের সঙ্গে আমেরিকার সুসম্পর্ক থাকলেও দুই দেশের মধ্যে সরকারিভাবে কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। তাইওয়ান স্বশাসিত একটি অঞ্চল। চীনের একাধিপত্য তারা মেনে নেয় না।

  • ভয়াবহ যুদ্ধমহড়া চীনের রিহার্সেল!

মার্কিন কংগ্রেসের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি তাইওয়ানে এলে তার ফল ভালো হবে না বলে আগেই সতর্ক করেছিল চীন। এবার কার্যত তাইওয়ান ঘিরে ধরে তারা সামরিক মহড়া শুরু করেছে। চীনের দাবি—রুটিন সামরিক মহড়া চলছে। কিন্তু যেভাবে তারা এই মহড়া শুরু করেছে, তাতে চিন্তিত তাইপেই। গত বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় বেলা ১২টা থেকে চীন এই মহড়া শুরু করেছে। গতকাল রবিবার পর্যন্ত এই মহড়া চলে। জল, স্থল এবং আকাশে মহড়া চলে। একের পর এক যুদ্ধবিমান তাইওয়ান প্রণালির ওপর দিয়ে তাইওয়ানের আকাশসীমা লঙ্ঘন করে উড়ে যায়। যুদ্ধজাহাজ কার্যত ঘিরে রাখে তাইওয়ানকে। তাইওয়ানের ২০ কিলোমিটারের মধ্যে যুদ্ধজাহাজ রাখা হয় বলে অভিযোগ। নৌ এবং স্হলসেনা লাগাতার গোলা বারুদ ছুঁড়ছে বলে অভিযোগ। একের পর এক ব্যালেস্টিক মিসাইলও তাইওয়ান প্রণালিতে সমুদ্রের জলে নিক্ষেপ করা হয়। সামান্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হলেই তা তাইওয়ানের মূল ভূখণ্ডে আঘাত হানতে পারত। তাইওয়ান প্রণালি চীনের মূল ভূখণ্ডে এবং তাইওয়ানকে আলাদা করে‌ছে।

মহড়ায় নেমেছে চীনের স্থলসেনাও। চীন লিবারেশন আর্মি অবশ্য জানিয়েছে, এটি তাদের রুটিন মহড়া। জাপানের অভিযোগ, সমুদ্রে অবস্থিত জাপানের এক্সক্লুসিভ ইকনোমিক জোনে প্রপেলড মিসাইল ছুঁড়েছে চীন। বেইজিং জানিয়েছে, পেলোসির তাইওয়ান সফরের জবাবেই তারা এ কাজ করছে। তাইপেই জানিয়েছে, তাইওয়ানের ওপর দিয়েও মিসাইল ছুঁড়েছে চীন। তাইওয়ান পার করে যা পানিতে গিয়ে পড়েছে। তাইওয়ানে রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে। এর আগে তাইওয়ানের এত কাছে কোনো সামরিক মহড়া চালায়নি চীন।

ওয়াশিংটন এখনো বিশ্বাস করে প্রেসিডেন্ট শি এমনভাবেই সব পদক্ষেপ নিচ্ছেন, যাতে করে একটা যুদ্ধ লেগে না যায়। কারণ কোনো পক্ষই আসলে যুদ্ধ চায় না। এশিয়া সোসাইটি পলিসি ইনস্টিটিউটের বিশ্লেষক ও সাবেক কূটনীতিক ড্রানি রাসেল বলেন, ‘পেলোসির এই সফরের পর চীনে কট্টরপন্থী লাইনের চিন্তা-ভাবনা আরো দৃঢ় হবে, এর পাশাপাশি ধৈর্য এবং সতর্কতার কথা যারা বলেন, তাদের অবস্থান সংকুচিত হবে।’ তবে চীন এখন যে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে, ঠিক একই ধরনের প্রতিক্রিয়া তারা দেখিয়েছিল ১৯৯৬ সালে। তখন তাইওয়ান আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি চেয়েছিল। এটা পরিষ্কার যে, চীনের সামরিক মহড়া তাইওয়ানকে ভয় দেখানোর জন্য। তাইওয়ানেরও অধিকাংশ মানুষ মনে করেন চীন তাইওয়ান আক্রমণ করবে না। কারণ তারা গত ৭০ বছর যাবত এমন হুমকির মধ্যে বসবাস করছে বলে বিবিসিকে জানিয়েছেন এক মৎস্যজীবী। চীনা রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত গ্লোবাল টাইমস জানায়, তাইওয়ানকে যে চীন যুক্ত করতে সক্ষম সেটা দেখানোর জন্যই এই রিহার্সেল। র‍্যান্ড করপোরেশনের সিনিয়র নীতি বিশ্লেষক লাইল মরিস বিজনেস ইনসাইডারকে বলেছেন, ‘চীনের মহড়ার তাত্ক্ষণিক উদ্দেশ্য হলো পেলোসির সফরের প্রতিক্রিয়া জানাতে শক্তি প্রদর্শন করা ও অসন্তোষ প্রদর্শন করা এবং সম্ভবত ভবিষ্যতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা অন্যান্য দেশকে এই ধরনের সফর করা থেকে বিরত রাখা।’

তথ্যসূত্র : দ্য গার্ডিয়ান, বিবিসি ও বিজনেস ইনসাইড

ইত্তেফাক/ইআ