বিপুল সুযোগ-সুবিধা পেয়েও একশ্রেণির চিকিৎসক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীর উচ্চাভিলাষী ও অযৌক্তিক দাবিতে আন্দোলনের কারণে হুমকির মুখে পড়েছে বেসরকারি কমিউনিটি বেজড মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালটি। তবে সরকারি পে-স্কেলের বাইরে এবং বেসরকারি হাসপাতাল পরিচালনার রুলসবহির্ভূত এ দাবিকে অযৌক্তিক হিসেবে আখ্যায়িত করে তা কখনো মেনে নেওয়া সম্ভব নয় বলে জানিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
তারা বলেন, করোনার দুই বছরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রায় বসিয়েই বেতন দিয়েছেন। ইতিমধ্যে চিকিৎসকরা দাবি আদায়ের জন্য ১৫ দিনের আল্টিমেটাম দিয়েছেন। এই সময়ের মধ্যে দাবি মেনে না নিলে হাসপাতাল বন্ধসহ আন্দোলনের হুমকি দিয়েছেন বলে কর্তৃপক্ষ জানান। অযৌক্তিক এই দাবি প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংসের নীলনকশা ছাড়া আর কিছু নয়। সরকারি নীতিমালার ব্যত্যয় ঘটানো কারোর উচিত নয়। অন্যদিকে ব্যয়ের চেয়ে আয় বেশি থাকাকে দাবি মেনে নেওয়ার যুক্তি হিসেবে তুলে ধরছেন আন্দোলনকারীরা।
আদর্শবান চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. মোফাখখারুল ইসলাম অবসর সময়ে সাধারণ মানুষের জন্য কিছু করার চিন্তা থেকে ১৯৯৪ সালে কমিউনিটি হেলথ ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। তার সঙ্গে আরো ৩০ জন সদস্য ছিলেন। ময়মনসিংহ শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে চুরখাইয়ের উইনারপাড় এলাকায় (ঢাকা-ময়মনসিংহ হাইওয়ের পাশে) ১৯৯৫ সালে কমিউনিটি হেলথ ফাউন্ডেশনের অধীনে ২২ একর জমির ওপর বেসরকারি কমিউনিটি বেজড মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠান করেন। ১৯৯৭ সালে হাসপাতাল চালু করা হয়। সাড়ে ৬০০ বেডের কমিউনিটি বেজড মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে প্রতি বছর ১৩০ ছাত্রছাত্রী এমবিবিএস কোর্সে ভর্তি হয়। ফলাফলে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোর মধ্যে শীর্ষ দশে আছে এটি। এ পর্যন্ত আড়াই হাজারের বেশি ডাক্তার বের হয়েছেন এই প্রতিষ্ঠান থেকে। নার্সিং ইনস্টিটিউট থেকে ডিপ্লোমা নার্স প্রতি বছর বের হচ্ছে ১৫০ জন। নার্সিং কলেজ থেকে বিএসসি নার্স প্রতি বছর তৈরি হচ্ছে ৫০ জন। কমিউনিটি বেজড মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে দুই শতাধিক ডাক্তার কর্মরত আছেন। নার্সসহ অন্যান্য জনবল আছে প্রায় ১ হাজার। রোগীদের ৩০০ টাকায় থাকা-খাওয়াসহ সব চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হয়। হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে রোগীরা বাড়িতে যাওয়ার পর তারা কেমন আছেন—তা জানতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে খবর নেওয়া হয়। প্রতিদিন এই হাসপাতালে সহস্রাধিক নিম্ন ও মধ্যবিত্ত রোগী চিকিৎসাসেবা নিতে আসেন। সুন্দর পরিবেশ বিরাজ করছে প্রতিষ্ঠানটিতে। তবে এক শ্রেণির চিকিৎসকের মধ্যে উচ্চাকাঙ্ক্ষা দেখা দিয়েছে। তিন গুণ সুযোগ-সুবিধা দাবি করছে। আর এ দাবির পরিপ্রেক্ষিতে হাসপাতালে বিশৃঙ্খল অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।
২০১৫ সালে সরকার ঘোষিত পে-স্কেল ২০১৬ সালের জুলাই থেকে বাস্তবায়ন করেছে এই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সরকারি মূল বেতনের সঙ্গে ২০ শতাংশ যোগ করে মূল বেতন নির্ধারণ করা হয়েছে। মূল বেতনের ৪০ থেকে ৫০ ভাগ বাড়িভাড়া, ১০ ভাগ চিকিত্সা ভাতা, ৫ ভাগ যাতায়াত ভাতা দেওয়া হচ্ছে। চাকরির বয়স পাঁচ বছর হলে মূল বেতনের ১০ ভাগ, চাকরির বয়স ১০ বছর হলে মূল বেতনের ২০ ভাগ ভাতা প্রদান করছে কর্তৃপক্ষ। এছাড়া ডাক্তারদের জন্য মূল বেতনের ১৫ ভাগ প্রফেশনাল এলাউন্স, সিনিয়র প্রফেসরদের মূল বেতনের ১৫ ভাগ স্পেশাল এলাউন্স, অতিরিক্ত কাজ করলে মূল বেতনের ২০ ভাগ চার্জ এলাউন্স, কর্মচারী সন্তানদের জন্য শিক্ষা ভাতা প্রদান করা হচ্ছে। শিক্ষা ভাতা এক সন্তানের জন্য ৫০০ টাকা করে সর্বোচ্চ দুই সন্তানের জন্য টাকা প্রদান করা হয়। এসব সুযোগ-সুবিধা সব কর্মকর্তা-কর্মচারী পাচ্ছেন। গত জুন পর্যন্ত হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সরকারি সুযোগ-সুবিধার বাইরে ৬০ কোটি টাকার বাড়তি সুবিধা প্রদান করেছে। তারপরও এক শ্রেণির ডাক্তার নতুন করে ৪০ থেকে ৬০ লাখ টাকার গ্রাচুয়েটি ও লিভ লেফট ওভার দাবি করে আসছেন। এই দাবি বাস্তবায়নে তারা হাসপাতাল বন্ধসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছিলেন। এই কর্মসূচির ফলে আগত রোগীরা সুচিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। কোনো বেসরকারি হাসপাতালে এত সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয় না। তাদের এই আন্দোলন প্রতিষ্ঠানটি ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র কি না, সেই প্রশ্ন করেছেন অনেকে। আন্দোলনের কারণে দীর্ঘ এক মাস প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ ছিল। গত জুন মাসে মন্ত্রণালয় থেকে হাসপাতালের গভর্নিং বডির কাছে চিঠি দিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিরসনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
কমিউনিটি বেজড মেডিক্যাল কলেজের গর্ভনিং বডির চেয়ারম্যান ডা. মোমেনুল হক বলেন, হাসপাতালে অযৌক্তিক দাবিতে আন্দোলন করা হচ্ছে। তাদের এই দাবি মেনে নেওয়া সম্ভব না। এটা অর্থনীতির নীতিমালার মধ্যে পড়ে না। তাদের দাবি মেনে নেওয়া হয় ২০১৬ সালে। ছয় বছরে তাদের প্রায় ৬০ কোটি টাকার অধিক বাড়তি সুযোগ-সুবিধা হিসেবে প্রদান করা হয়েছে। এখন আরো ব্যয়ভার বহন করা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সম্ভব না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. শাহরিয়ার নবী বলেন, সরকারি নীতিমালার চেয়ে বেশি সুযোগ-সুবিধা কমিউনিটি বেজড মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পাচ্ছেন। বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল পরিচালনার জন্য যে নীতিমালা আছে তা অনুসরণ করতে হবে। এই নীতিমালার বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
কমিউনিটি হেলথ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী সভাপতি ডা. এম এ মান্নান বলেন, আমরা সরকারের পে-স্কেল ঘোষণার আগে থেকে ছয় বছর তাদের বাড়তি সুযোগ-সুবিধা দিয়েছি। তারা আন্দোলন করে, জোরজবরদস্তি করে, হাসপাতাল বন্ধ রেখে, রোগীদের জিম্মি করে আদায় করেছে। এখন আমাদের পক্ষে দেওয়া সম্ভব না।
দাবি বাস্তবায়নে গঠিত সংগঠন অ্যালমোর সাধারণ সম্পাদক ডা. শহিদুল ইসলাম বলেন, শুরু থেকে প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে আমরা বেতন না নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করেছি। ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত কোনো পে-স্কেলে বেতন হয়নি। প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক ডা. মোফাখখারুল ইসলাম বলেছিলেন, কাজ কর, এক দিন অনেক বেতন পাবে। ২০০৩ সালে পে-স্কেলে বেতন প্রদানের ঘোষণা করা হয়। ২০০৫ সালে তা বাস্তবায়ন শুরু হয়। এখন অবকাঠামো বেড়েছে, প্রতিষ্ঠানটি এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। অতীতে আমরা অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছি। এই জন্য আমাদের দাবি ন্যায্য।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলোর ক্ষেত্রে সরকারের নীতিমালা রয়েছে। এর বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সাধারণত স্ব স্ব মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গর্ভনিং বডি আছে, কিংবা পরিচালনা কমিটি আছে। মালিকদের সংগঠন রয়েছে। তারা সাধারণত কোনো কিছু হলে নিজেরাই সমাধান করেন। সেখানে যদি সমাধান সম্ভব না হয়, তাহলে সরকারের দ্বারস্থ হলে নীতিমালা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।