বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

দুর্বৃত্তদের অভয়ারণ্য ফার্মগেট-কাওরান বাজার

আপডেট : ০৯ আগস্ট ২০২২, ০৮:৫৫

একটা সময় রাজধানীর ছিনতাইয়ের ‘হটস্পট’ হিসাবে পরিচিত ছিল গুলিস্তানের নাম। গুলিস্তানের ছিনতাই ও টানা পার্টি নিয়ে অনেক হাস্যরসাত্মক গল্পও প্রচলিত রয়েছে। অথচ এখন গুলিস্তানে আগের মতো ছিনতাইয়ের অভিযোগ নেই। রাজধানীর যে এলাকাটিতে এখন সবচেয়ে বেশি ছিনতাই ও টানা পার্টির ঘটনা ঘটে, সেটি হলো কাওরান বাজার। ছিনতাইয়ের নতুন ‘হটস্পট’ এখন কাওরান বাজার। ফার্মগেট থেকে কাওরান বাজারের সার্ক ফোয়ারা মোড় হয়ে এফডিসি ক্রসিং , সাতরাস্তা মোড় এবং ট্রাকস্ট্যান্ড হয়ে তেজগাঁও রেলগেট পর্যন্ত রীতিমতো ছিনতাইকারীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত এসব এলাকায় ছিনতাইয়ের রাজত্ব চলে।

জানা গেছে, কাওরান বাজারে যানজট বা ট্রাফিক সিগন্যালে দাঁড়িয়ে থাকা বাসের যাত্রীদের মোবাইল ফোন জানালা দিয়ে টান দিয়ে ভোঁ দৌড় দেওয়া এখানকার নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এসব এলাকায় বাসের জানালার পাশে বসে কেউ মোবাইল ফোনে কথা বললে সেই মোবাইল ফোন ঘরে নিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কম। ছিনতাইকারী কখন যে ছোঁ মেরে নিয়ে যাবে, টেরও পাবেন না মোবাইল ফোনের মালিক। যখন বুঝতে পারবেন, তখন অনেক দূরে চলে গেছে সে। ভুক্তভোগী যাত্রী বাস থেকে নেমে পিছু নিতে নিতে অলিগলিতে ঢুকে পড়ে হাওয়া হয়ে যায় তারা। কখনো রিকশাযাত্রীদের আটক করে ধারালো অস্ত্র দেখিয়ে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। আবার সড়কবাতির স্বল্প আলোতে ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাওয়া পথচারীরাও ছিনতাইয়ের শিকার হচ্ছেন। আবার গভীর রাতে ফার্মগেট থেকে কাওরান বাজারের মধ্যে দুইটি ফুটওভার ব্রিজও নেশাগ্রস্ত কিশোর ছিনতাইকারীর দখলে চলে যায়।

রাতে এফডিসি রেল ক্রসিংয়ের কাছে রিকশার যাত্রীরা ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন। তেজগাঁও সাতরাস্তা মোড় থেকে ট্রাক স্ট্যান্ডের মেয়র আনিসুল হক সড়কে মোটরসাইকেল বা প্রাইভেট কার ঠেকিয়ে রিকশাযাত্রীদের মূল্যবান জিনিসপত্র ছিনতাই করা হচ্ছে। এই এলাকার সড়কগুলো তেজগাঁও, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল ও শেরেবাংলা নগর থানাধীন। এই তিন থানার পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, ছিনতাইয়ের শিকার ভুক্তভোগীদের অনেকে হয়রানি মনে করে থানায় মামলার পরিবর্তে জিডি করেন। বিভিন্ন সময় পুলিশ ছিনতাইকারীদের গ্রেফতার করে। কিন্তু মাসখানেক পর জামিনে বের হয়ে আবারও তারা পুরোনো ‘পেশায়’ ফিরে যায়।

দিনের বেলা এভাবেই রাস্তার পাশে ঘুমিয়ে থাকে ছিন্নমূল শিশু-কিশোররা।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন শাখার উপকমিশনার ফারুক হোসেন বলেন, কাওরান বাজারের মূল সমস্যা—এখানে ভাসমান মাদকসেবীদের সংখ্যা অনেক বেশি। কিশোর বয়সের ভাসমান মাদকসেবী রয়েছে। এরা মাদকসেবনের টাকার জন্য ছিনতাই ও টানা পার্টির কাজ করে। এদের প্রতিরোধে সংশ্লিষ্ট থানাগুলোর টহল টিম ডিউটি করে। ডিবির একটি টিমও এই এলাকায় রাতে ডিউটি করে।

গত ২১ জুলাই কাওরান বাজারে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পারিশা আক্তারের মোবাইল ফোনটি বাসের জানালা দিয়ে ছিনতাই হয়ে যায়। ঐ শিক্ষার্থী ছিনতাইকারীকে ধাওয়া দিয়ে ধরতে পারেননি। ঐ সময় আরেক বাসের যাত্রীর মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেওয়ার সময় ঐ শিক্ষার্থী ছিনতাইকারীকে জাপটে ধরে ফেলেন। তাকে ধরে কিলঘুসি দিতে থাকলেও কেউ সহায়তা করতে এগিয়ে আসেনি। বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। পুলিশ ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করে। এই ঘটনার তিন মাস আগে তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ডে মেয়র আনিসুল হক সড়কে রিকশাযাত্রী সাংবাদিক তাপসী রাবেয়া আঁখির ভ্যানিটি ব্যাগ মোটরসাইকেল আরোহী ছিনতাইকারী ছোঁ মেরে নিয়ে যায়। গত বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে ফার্মগেটে সেজান পয়েন্টের সামনে সাংবাদিক জামালউদ্দীন ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন। ছিনতাইকারীরা তার হাতে থাকা ব্যাগ টান দিয়ে দৌড় দেয়। ঐ ব্যাগে ৭ হাজার টাকা, একটি মোবাইল ফোন ও অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড ছিল। পরে জামালউদ্দীন শেরে বাংলা নগর থানায় জিডি করেন।

শেরে বাংলানগর থানা

পুলিশের এক হিসাবে—জুলাই মাসে ফার্মগেট ও কাওরান বাজারে ২০০ ছিনতাই ও টানা পার্টির ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় তেজগাঁও, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল ও শেরে বাংলানগর থানায় শতাধিক জিডি হয়েছে। ছিনতাইয়ের ঘটনায় একটি মামলাও দায়ের হয়নি। প্রতিটি জিডিতে ভুক্তভোগী তার মোবাইল ফোন বা মানিব্যাগ বা হ্যান্ডব্যাগ হারিয়ে যাওয়ার অভিযোগ করেছেন। এই তিন থানা এলাকায় ছয়টি গ্রুপে ছিনতাইকারী সক্রিয়। এসব গ্রুপের সদস্যদের নামের তালিকা পুলিশের কাছে রয়েছে। কিন্তু এরা কিশোর ও মাদকসেবী হওয়ায় পুলিশ তেমন ভূমিকা নিতে পারে না। তেজগাঁও থানার ওসি অপূর্ব হাসান বলেন, বিভিন্ন সময়ে অন্তত ৪৩ শিশু-কিশোরকে আটক করে সংশোধনাগারে পাঠানো হয়েছে। অপকর্মে যুক্ত অন্যদের আটকের চেষ্টা চলছে। ছিনতাইয়ে জড়িত এসব পথশিশু-কিশোর দিনের বেলায় বিভিন্ন ঝুপড়ি ঘরে ঘুমিয়ে থাকে। রাতে তারা বের হয়ে খামারবাড়ি থেকে শুরু করে কাওরান বাজার পর্যন্ত সক্রিয় থাকে।

ইত্তেফাক/ইআ