বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

আফগানিস্তানে তালেবান শাসনের এক বছর

সেই তালেবান যোদ্ধারা এখন অন্যরকম জীবনে

আপডেট : ১১ আগস্ট ২০২২, ০১:৩৫

আফগানিস্তানে তালেবানের পুনরায় ক্ষমতারোহনের এক বছর পার হয়েছে। এই এক বছরে দেশটির নাগরিকদের জীবন অনেকটাই বদলে গেছে। বিচরণের ক্ষেত্র সীমিত হয়েছে নারীদের, শিক্ষার সুযোগ হয়েছে সঙ্কুচিত। দারিদ্র্যও বাড়ছে দেশটিতে। কিন্তু এর বিপরীতে সংঘাত-সহিংসতাও কমেছে। যে তালেবান যোদ্ধারা অস্ত্র হাতে লড়ছিলেন, তাদের জীবনেও এখন এসেছে পরিবর্তন। এক বছর পর বিবিসির এক প্রতিবেদনে তা উঠে এসেছে।

  • যুদ্ধের ময়দান থেকে চাকরির টেবিলে

গত গ্রীষ্মে তালেবান বাহিনী যখন কাবুল দখলে এগোচ্ছিল, যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্রদের সেনারা যখন আফগানিস্তান ছেড়ে যাচ্ছিল, তখন আইনুদ্দিনের সঙ্গে আলাপ হয়। তালেবান যোদ্ধা হিসেবে উত্তরাঞ্চলীয় বালখ জেলায় লড়ছিলেন তিনি। শীতল, অথচ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আইনুদ্দিন তখন বলেছিলেন, সাধারণ নাগরিকদের ক্ষতি যাতে না হয়, সেজন্য আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি, কিন্তু এটা যুদ্ধ এবং মানুষ মারা যাবে। আফগানিস্তানে আমরা ইসলামিক ব্যবস্থা ছাড়া অন্য কোনো ব্যবস্থা মেনে নেব না। তার কয়েক মাস পর আবার আইনুদ্দিনের সঙ্গে কথা হলে আফগানিস্তান ও উজবেকিস্তানকে আলাদা করা আমু দরিয়া নদীর পাশে ভাজা মাছ খেতে খেতে তিনি বলছিলেন, তালেবান বাহিনীতে তিনি ছিলেন একজন ‘স্নাইপার’। তার হিসাবে, তিনি আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর ডজনখানেক সদস্যকে হত্যা করেছেন এবং নিজেও ১০ বার আহত হয়েছেন। তালেবান ক্ষমতা গ্রহণের পর বালখ প্রদেশের ভূমি ও নগর উন্নয়ন বিভাগের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া আইনুদ্দিনের কাছে প্রশ্ন ছিল, বছরের পর বছর ধরে তিনি যে ‘জিহাদ’ করছিলেন, তা ‘মিস’ করেন কি না? দ্বিধা না করেই তিনি উত্তর দিয়েছিলেন- ‘হ্যাঁ’।

তার এক বছর পর কাঠের ডেস্কের ওপাশে বসা আইনুদ্দিনকে দেখে মনে হয়, তিনি যেন এখনো এই পরিবেশ মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। ইসলামিক আমিরাতের সাদা-কালো পতাকার পাশে বসে আইনুদ্দিন অবশ্য স্বীকার করেন, তার এই নুতন দায়িত্বটাও গুরুত্বপূর্ণ। আমরা আমাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে লড়াই করেছি, খোদাকে ধন্যবাদ আমরা তাদের পরাজিত করেছি এবং এখন আমরা আমাদের কলম দিয়ে আমাদের জনগণকে সেবা করার চেষ্টা করছি। আইনুদ্দিন বলেন, যুদ্ধ করার সময় তিনি খুশি ছিলেন, এখনো খুশিই আছেন।

অবশ্য তালেবানের আরো কয়েক জন সদস্য ব্যক্তিগত আলাপে বলেন, তারা বরং কিছুটা ক্লান্তিবোধ করছেন তাদের এই নতুন দপ্তরভিত্তিক দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে। যদিও শহরের অন্যত্র কিছু কিছু বাসিন্দা অভিযোগ করেছেন যে তাদের চাকরি কেড়ে নিয়েছে তালেবান। আইনুদ্দিনের কাছে প্রশ্ন ছিল, তিনি প্রশাসনিক এই পদের জন্য যোগ্য কি না ? তার উত্তর, ‘আমরা সামরিক ও আধুনিক উভয় ধরনের শিক্ষাই অর্জন করেছি। আমরা সামরিক বাহিনী থেকে আসলেও এখন আমরা এই জায়গায় কাজ করছি। আগের সরকারের সঙ্গে আমাদের কাজের তুলনা করে দেখতে পারবেন এবং জানতে পারবেন কে ভালো ফল বয়ে আনছে।’ অবশ্য তিনি এটাও বললেন যে গেরিলা যুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করলে লড়াই করার চেয়ে সরকার পরিচালনা কঠিন কাজ। তালেবান আন্দোলনের কাছে এটা একটা সংকট। কারণ এই গোষ্ঠী এখন বিদ্রোহী গোষ্ঠী থেকে শাসক গোষ্ঠীতে রূপান্তরিত হচ্ছে।

  • ইউটিউবার এখনও ভিডিও নির্মাণে

গত বছর তালেবান যোদ্ধারা কাবুলে ঢোকার পর অনেক বাসিন্দাই আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। এই শহরে তালেবান সদস্যরা বছরের পর বছর আত্মঘাতী বোমা হামলা এবং চোরাগোপ্তা আক্রমণ চালিয়েছে। তার পরেও তরুণী রোয়েনা, যিনি ইউটিউবে ভিডিও নির্মাণ করেন, ঘর থেকে বেরিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলার সিদ্ধান্ত নেন। গত আগস্টে রোয়েনা বলেছিলেন, তিনি নিশ্চিত নন যে পুরুষের পাশাপাশি কাজ চালিয়ে যেতে পারবেন কি না? এক বছর পরেও অস্বস্তির এই বাতাবরণ কাটেনি। শুধু রোয়েনার জন্যই নয়, আফগানিস্তান জুড়ে একই পরিস্থিতি।

মেয়েদের মাধ্যমিক স্কুল বন্ধ রাখার বিষয়ে তালেবান নেতৃত্বের সিদ্ধান্ত নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে, আফগানদের বড় একটি অংশের মধ্যে এমনকি তালেবানের বিভিন্ন পর্যায়েও হতাশা রয়েছে। তবে ১৯৯০-এর দশকে প্রথম তালেবান সরকারের পথে না হেঁটে বর্তমান তালেবান সরকার অবশ্য ছোট মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার অনুমতি এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছেলে ও মেয়েদের আলাদা করার ব্যবস্থা করে বর্তমান নারী শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা শেষ করার সুযোগ দিয়েছে। যদিও তালেবান নেতৃত্বের প্রভাবশালী ও কট্টরপন্থিরা কিশোর বয়সি মেয়েদের বিদ্যালয়ে পাঠানোর ঘোর বিরোধী এখনো। ফলে মনে হচ্ছে, গত ২০ বছরে সেদেশে নারী অধিকারের যতটুকু অগ্রগতি হয়েছিল, তা এখন ভেস্তে যেতে বসেছে। একইভাবে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা ছাড়া যেসব সরকারি চাকরিতে নারীরা নিয়োজিত ছিলেন তাদের অফিসে ফিরতে নিষেধ করে দেওয়া হয়েছে। এর পরেও ব্যক্তিগত ব্যবসায় নিয়োজিত হাতেগোনা নারীরা তাদের কাজ করে যাচ্ছেন।

  • তালেবানের প্রত্যাবর্তনের এক বছর : স্বাধীনতা ফিরে পেতে লড়ছেন নারীরা

রোয়েনা এখনো ভিডিও নির্মাণ করে চলেছেন, নিজের মুখ ঢেকে রাখছেন না, তবে হিজাবের বাঁধন এখন আগের চেয়ে শক্ত করতে হয়েছে। এখন কাবুলে চলাফেরার সময় তিনি আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন হয়ে চলাফেরা করেন, একটি কালো আবায়া (বোরখার মতো পোশাক) ও মুখে মাস্ক থাকে তার। তালেবান গোষ্ঠী নির্দেশ জারি করেছে যে নারীদের প্রকাশ্যে চলাফেরার সময় মুখ ঢেকে চলতে হবে।

ইত্তেফাক/ইআ