শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

লঘুচাপের প্রভাবে উত্তাল সমুদ্র

তীব্র ঢেউয়ে বিলীন হচ্ছে সৈকতের বালিয়াড়ি

আপডেট : ১২ আগস্ট ২০২২, ০৫:০০

বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপের প্রভাবে সমুদ্র উত্তাল রয়েছে। কক্সবাজার সমুদ্র বন্দরে চলছে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত। ফলে স্বাভাবিকের চেয়ে দু'থেকে চার ফুট বাড়ছে জোয়ারের পানি। বাড়ন্ত পানির ঢেউয়ের তোড়ে ক্রমে ভাঙছে কক্সবাজার সৈকত বালিয়াড়ি। অস্বাভাবিক জোয়ারের তাণ্ডবে ভাঙ্গন আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। ঢেউয়ের ঝাঁপটায় ক্ষয়ে যাচ্ছে সৈকতের বালু। তলিয়ে যাচ্ছে ঝাউগাছের সারি। ক্ষতবিক্ষত সৈকত হারাচ্ছে তার চিরচেনা সৌন্দর্য। ভাঙ্গনে ঝুঁকির মুখে রয়েছে সৈকতের ছাতা ও ঝিনুক মার্কেট। পূর্ণিমার জোয়ারের পানি আরো উচ্চতায় বাড়লে ভাঙন তীব্র হবার আতঙ্কে রয়েছে পর্যটন সংশ্লিষ্টরা।

সরেজমিনে দেখা যায়, সৈকতের ডায়াবেটিক পয়েন্ট থেকে কলাতলীর ডলফিন মোড় পর্যন্ত সৈকত এলাকায় বড় বড় ঢেউয়ের তোড়ে বিভিন্ন এলাকার বালু সরে গেছে। এতে ভাঙন দেখা দিয়েছে সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে। এই ভাঙনে ক্ষতবিক্ষত হয়ে সৌন্দর্য হারাচ্ছে বিশ্বের দীর্ঘতম কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত। ভাঙ্গনের কবলে সাগরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে বিস্তীর্ণ বালিয়াড়ি, ঝাউগাছ। ঢেউয়ের তোড়ে ভাঙ্গন সৈকতের লাবনী পয়েন্টে জেলা প্রশাসন নির্মিত উন্মুক্ত মঞ্চ পর্যন্ত চলে এসেছে। কিছু কিছু জায়গায় পানি উন্নয়ন বোর্ড বালু ভর্তি জিও টিওব দিয়ে ভাঙ্গন রোধের চেষ্টা করেও কোনো লাভ হচ্ছে না। 

কক্সবাজার আবহাওয়া অফিসের প্রধান আবহাওয়াবিদ আবদুল হামিদ মিয়া জানান, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপের কারণে কক্সবাজার সমুদ্র বন্দরে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখানো হয়েছে। লঘুচাপের প্রভাবে সমুদ্র উত্তাল। উপকূলীয় এলাকায় মাঝারি বৃষ্টিপাত ও দমকা ঝড়ো হাওয়া চলছে। বুধবার সকাল হতে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত কক্সবাজারে বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে ৪৫ মিলিমিটার। জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে ২-৪ ফুট বাড়ছে। শুক্রবার পূর্ণিমার জোয়ারে পানি আরো বাড়তে পারে। গভীর সাগরে অবস্থানরত সকল মাছধরা ট্রলার সমূহকে পরবর্তী সংকেত না দেয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার বিকেলে সৈকতের লাবণী পয়েন্টে উচ্চ জোয়ারের আঘাতে ঝুঁকির মুখে পড়ে ট্যুরিস্ট পুলিশের ডিউটি ঘর। সৈকতের অন্যতম পয়েন্ট লাবণী জোয়ারের পানিতে ভেঙে তছনছ হচ্ছে। কক্সবাজার ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রেজাউল করিম বলেন, জোয়ারের বাড়ন্ত পানির ঢেউয়ের তোড়ে পড়ে আমাদের ডিউটি ঘরটি তলিয়ে যাচ্ছিল। আমরা দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে ঘরটি কোন মতে খুলে সাগরে বিলীন হওয়া থেকে রক্ষা করেছি।

লাবণী পয়েন্টে দায়িত্বরত লাইফ গার্ড কর্মী ওসমান বলেন, এত উচ্চতায় জোয়ার বিগত বছরগুলোতে দেখিনি। সৈকতের কবিতা চত্বর পয়েন্ট থেকে কলাতলী পয়েন্ট পর্যন্ত বালিয়াড়ি ভাঙছে। একই সঙ্গে ঝুঁকির মুখে পড়েছে ট্যুরিস্ট পুলিশের স্থাপনা। সৌন্দর্যহীন হয়ে পড়ছে সৈকত। ঢেউয়ের তোড়ে ফুট ওয়ের ইট উঠে গিয়ে এলোমেলো হওয়ায় সৈকতে নামতে গিয়ে আহত হচ্ছেন অনেক পর্যটকরা।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, প্রতি বর্ষা মৌসুমে সাগরে পানি বৃদ্ধি পায়। তবে ভাঙন এরকম তীব্র হয় না। আর সৈকতে অতীতে কোনো সময় এধরনের ভাঙন দেখা যায়নি। বিশেষজ্ঞদের মতে, কক্সবাজারের বালুকাময় সৈকতে কোনো ধরনের স্থাপনা গ্রহণযোগ্য নয়। নাজিরারটেক থেকে ইনানী পর্যন্ত বালুকাময় সৈকতে যেকোনো ধরনের স্থাপনা নির্মাণ করা হলে তাতে সাগর ফুঁসে ওঠে। এরকম অনেক নজির অতীতে দেখা গেছে। সম্প্রতি কক্সবাজার লাবনী পয়েন্ট থেকে কলাতলী পর্যন্ত সৈকতের একেবারেই কাছে গড়ে উঠেছে অনেক সুরম্য অট্টালিকা। অভিজ্ঞজনেরা মনে করছেন এই কারণেই সৈকতে ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। প্রশাসন যন্ত্র এগুলো দেখেও না দেখার ভান করে রয়েছেন।

কক্সবাজার সৈকত এবং দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনকে ইকোলজিক্যাল ক্রিটিক্যাল এরিয়া (ইসিএ) ঘোষণা করে যে কোনো বহুতল ভবন নির্মাণে রয়েছে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা। এই নিষিদ্ধ এলাকায় যে সকল বহুতল সুরম্য অট্টালিকা নির্মিত হয়েছে এগুলো ভেঙে ফেলার নির্দেশনা দেয়া হয়। কিন্তু সে নির্দেশনা কার্যকর হচ্ছে না।

পাউবো সূত্র মতে, ২০২১ সালে সৈকতে ভাঙ্গন শুরু হলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সিনিয়র সচিব কবির বিন আনোয়ারের নির্দেশে সৈকতের ভাঙ্গন রোধে সীমিত আকারে উদ্যোগ নেওয়া হয়। সৈকতের লাবনী পয়েন্ট থেকে এয়ারপোর্ট হয়ে নুনিয়াছড়া নাজিরারটেক পর্যন্ত কক্সবাজার শহর রক্ষা প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই বা ফিজিবিলিটি স্টাডি চলছে। ২০১৮/১৯ অর্থ বছরে পানি উন্নয়ন বোর্ড জরুরী ভাঙ্গন রোধের আওতায় ১৫-১৬ মিটার এলাকায় জিও টিউব দিয়ে দুই কোটি টাকার অস্থায়ী মেরামত কাজ করা হয়েছে।

কক্সবাজারের তারকা হোটেল ওশান প্যারাডাইসের পরিচালক আবদুল কাদের মিশু বলেন, সৈকতের এই ভাঙ্গন আশঙ্কাজনক। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। এছাড়াও সেনাবাহিনী হিমছড়ি এলাকায় ট্রিট্টা ব্যবহার করে ভাঙ্গন রোধে সফল হয়েছেন। এখানেও ট্রিট্টা ব্যবহার করা যায় কিনা সম্ভাব্যতা যাচাই করা যেতে পারে।

সুগন্ধা পয়েন্ট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আবুল কালাম বলেন, বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার শুধু চিত্ত বিনোদনের প্রাণ কেন্দ্র নয়; বিশ্বের অন্যতম স্বাস্থ্যকর স্থান। সরকার কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ বাড়াতে রেল লাইন প্রকল্প বাস্তবায়ন  করছে। অথচ সেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যভরা সমুদ্র সৈকত হুমকির মুখে।

আমরা কক্সবাজারবাসীর সমন্বয়ক শেখ মহসীন বলেন, দেশের জাতীয় ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতকে রক্ষার দাবি সবার। কারণ, সমুদ্র সৈকত ঘিরে নানা কার্যক্রমে হাজারো কর্মসংস্থান হয়েছে। সমুদ্র সৈকত ধ্বংস হলে দেশের পর্যটন শিল্প ধ্বংসের পাশাপাশি এসব কর্মজীবীদের জীবনেও বিপর্যয় নেমে আসবে। 

কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী তানজির সাইফ আহমেদ বলেন, গত কয়েক বছর ধরে সৈকতে ডায়বেটিক পয়েন্ট থেকে কলাতলী পয়েন্ট পর্যন্ত বর্ষা মৗসুমে ভাঙনের কবলে পড়ছে। তা রোধে প্রাথমিকভাবে সৈকতের কবিতা চত্বর পয়েন্ট থেকে লাবণী পয়েন্টের কিছু অংশ জিও ব্যাগ বসানো হয়েছে। তবে ভাঙ্গন রোধের স্থায়ী সমাধান নিয়ে পর্যালোচনা চলছে। শুক্রবার ভাঙ্গন পরিদর্শনে আসছেন পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মহোদয়। 

কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. আবু সুফিয়ান জানান, জেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড সৈকতের লাবণী পয়েন্টের কিছু অংশে আপাতত জিও ব্যাগ দিয়ে ভাঙন রোধের চেষ্টা করছে। শুক্রবার (১২ আগস্ট) পূর্ণিমার জোয়ারে সাগর আরও উত্তাল হতে পারে। বিষয়টি মাথায় রেখে জেলা প্রশাসন ও পাউবো একসঙ্গে কাজ করছে। 

ইত্তেফাক/জেডএইচডি