রোববার, ০২ এপ্রিল ২০২৩, ১৯ চৈত্র ১৪২৯
দৈনিক ইত্তেফাক

উত্তরার গার্ডার ট্রাজেডি

ঠিকাদারের শতভাগ গাফিলতি, দায় নিতে চান না বিআরটি এমডি

আপডেট : ১৭ আগস্ট ২০২২, ০০:০৯

রাজধানীর উত্তরায় নির্মাণাধীন বাস র‍্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের কাজ চলার সময় ক্রেন থেকে ছিটকে প্রাইভেটকারে গার্ডার পড়ার ঘটনায় প্রাথমিক প্রতিবেদন দিয়েছে তদন্ত কমিটি। তদন্তে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না গ্যাঝুবা গ্রুপ করপোরেশনের (সিজিজিসি) শত ভাগ গাফিলতির বিষয়টি উঠে এসেছে। তাই ঐ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটি গতকাল মঙ্গলবার (১৬ আগস্ট) সকালে মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে সুপারিশসহ প্রাথমিক তদন্ত রিপোর্ট জমা দিয়েছে। এ সময় বিষয়টি ঢাকাস্থ চীনা দূতাবাসকেও অবহিত করা হবে বলে জানানো হয়।

এদিকে গতকাল সকালে দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বিআরটি প্রকল্পের সব ধরনের কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, বিআরটি প্রকল্পের কাজে ন্যুনতম নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা রাখা হয়নি। কমপ্লায়েন্স (নিরাপত্তা ব্যবস্থা) নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ঢাকায় এ প্রকল্পের সব ধরনের কাজ বন্ধ থাকবে। তিনি আরো বলেন, শুধু এই প্রজেক্টই নয়, ঢাকা শহরে যতগুলো প্রজেক্ট চলছে, সবগুলো বন্ধ থাকবে। এ সময় বিআরটি প্রকল্পের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

গত সোমবার (১৫ আগস্ট) বেলা সাড়ে ৩টার দিকে উত্তরার জসীমউদ্দিন সড়কে ক্রেন দিয়ে একটি গার্ডার ওপরে তোলার সময় নিচে পড়ে যায়। এ সময় চলন্ত একটি প্রাইভেট কার গার্ডারের নিচে চাপা পড়ে। এতে পাঁচ জন নিহত ও একজন আহত হন। হতাহতরা দক্ষিণখান এলাকায় বউভাতের অনুষ্ঠান শেষে আশুলিয়া যাচ্ছিলেন।

উত্তরায় প্রাইভেট কারে গার্ডার চাপা থেকে বেঁচে যাওয়া নবদম্পতি গতকাল সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে স্বজনদের লাশ নিতে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন।

  • ক্রেনচালক ও ঠিকাদারের বিরুদ্ধে মামলা 

‘অবহেলাজনিত মৃত্যুর’ অভিযোগে মামলা হয়েছে চীনা ঠিকাদার কোম্পানি, ক্রেনচালক এবং প্রকল্পের নিরাপত্তার দায়িত্বপ্রাপ্তদের বিরুদ্ধে। নিহত ফাহিমা আক্তার ও ঝর্ণা আক্তারের ভাই মো. আফরান মণ্ডল বাবু সোমবার রাতে উত্তরা পশ্চিম থানায় মামলাটি করেন। এ ব্যাপারে উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি মোহাম্মদ মোহসীন বলেন, থানায় যে মামলা হয়েছে, সেখানে অবহেলার কারণে প্রাণহানির অভিযোগ করা হয়েছে। মামলায় ক্রেন চালকের পাশাপাশি প্রকল্পের অন্যতম ঠিকাদার কোম্পানি চায়না গ্যাঝুবা গ্রুপ করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এবং নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে দায়িত্বপ্রাপ্ত অজ্ঞাত ব্যক্তিদের বিবাদী করা হয়েছে। দুর্ঘটনার সময় যিনি ক্রেন চালাচ্ছিলেন, তাকে গ্রেফতারে পুলিশ কাজ করছে।

  • দুর্ঘটনার চার কারণ 

প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে বিকালে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফিং করেন সড়ক বিভাগের সচিব। তিনি জানান, এ ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি প্রাথমিকভাবে ঘটনার চারটি কারণ জানিয়েছে। প্রথমত, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের শতভাগ অবহেলা এর কারণ। গতকাল ছুটি ছিল, তবু কাজ চালানো হয়। কোনো ওয়ার্ক প্ল্যান ছিল না। দ্বিতীয়ত, ট্রাফিক পুলিশকে জানানো হয়নি। তৃতীয়ত, দুর্ঘটনাস্থলে সড়কটির একাংশ উঁচু এবং অপর অংশ নিচু ছিল। ক্রেনটি চালানোর সময় একটি চেইন উঁচু অংশে এবং আরেকটি নিচু অংশে ছিল। ফলে ক্রেনটি ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। চতুর্থত, বিকালের দিকে হঠাৎ যানবাহনের সংখ্যা বেড়ে যায় এবং সেগুলো ক্রেনের খুব কাছাকাছি চলে আসে। অপারেটর বিচলিত হয়ে হঠাৎ ব্রেক করলে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনাটি ঘটে।

গার্ডার চাপায় দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া সেই প্রাইভেটকারের ভিতরের অংশ।

আমিন উল্লাহ নুরী বলেন, ছুটির দিনে ঠিকাদারের কাজ করার কথা না। তারা কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা না নিয়েই কাজ করছিল। এভাবে উন্মুক্ত রেখে কাজ করার কোনো সুযোগ নেই। নিয়মানুযায়ী কাজ করতে হলে আগের দিন তারা একটি ওয়ার্ক প্ল্যান দেবে, তাদের কত জন লোক থাকবে, কতগুলো ক্রেন লাগানো হবে, পুলিশকে জানাবে। গতকাল ঠিকাদার এগুলো না করেই কাজটা করেছেন। কোনো অবস্থাতেই নিরাপত্তার ব্যবস্থা না করে এ ধরনের কাজ করার কোনো সুযোগ নেই।

ঠিকাদারের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে জানতে চাইলে সড়ক সচিব বলেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে চুক্তি অনুযায়ী জরিমানা করা হয়, কাজ থেকে টার্মিনেট করা হয় এবং তারা যেন আর কোনো কাজ করতে না পারে এজন্য ব্ল্যাকলিস্ট করা হয়। চূড়ান্ত রিপোর্টটা আসুক। আমি আজকেই চিঠি ইস্যু করব, তাদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এত বড় ক্ষতির জন্য শুধু জরিমানা করা যাবে না। সর্বোচ্চ ব্যবস্থা যদি নেওয়া হয় তবে তাদের লাইসেন্স চলে যাবে। বাংলাদেশে তারা আর কোনো কাজ করতে পারবে না।

এ ঘটনায় মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের গাফিলতি থাকলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার ইঙ্গিত দেন তিনি। সচিব বলেন, আমি যতটুকু জেনেছি আগের ঘটনাগুলোতে যারা গাফিলতি করেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কেউ দায় এড়াতে পারে না। এক দিনে একটি তদন্ত হয় না। যেসব কমকর্তা মনিটরিংয়ের দায়িত্বে ছিলেন, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব এবং তদন্ত কমিটির প্রধান নীলিমা আখতার, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের চিফ ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম মনির হোসেন পাঠানসহ অন্য কর্মকর্তারা এসময় উপস্থিত ছিলেন।

গার্ডার চাপায় প্রাইভেটকারে থাকা নিহতদের লাশ উদ্ধার করছেন ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা।

  • কাল নগর ভবনে বৈঠক 

বিআরটি প্রকল্পের কাজ আপাতত বন্ধ থাকবে বলে জানিয়েছেন ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম। দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে মেয়র বলেন, এ প্রকল্পের কাজে ন্যুনতম নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। ফলে কিছুদিন পরপরই দুর্ঘটনা ঘটছে। জনদুর্ভোগ বাড়ছে। এভাবে উন্নয়নকাজ চলতে দেওয়া যাবে না। আগে নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, ঢাকায় বিআরটি, মেট্রোরেলসহ অনেকগুলো প্রকল্পের কাজ চলমান। সব প্রকল্পের পরিচালকদের আগামীকাল বৃহস্পতিবার নগর ভবনে ডাকা হয়েছে। তারা নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করলেই কাজ শুরু করতে পারবেন।

ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম

  • হাইকোর্টে রিট 

গার্ডারচাপায় পাঁচ জনের মৃত্যুর ঘটনায় হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হয়েছে। রিটে ঘটনার তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া এবং এ ধরনের নির্মাণকাজের সময় জনগণের নিরাপত্তায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সাগুফতা আহমেদ গতকাল মঙ্গলবার হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় রিটটি করেন। রিটে স্বরাষ্ট্র সচিব, সড়ক ও জনপথ সচিব, স্থানীয় সরকার সচিবসহ সংশ্লিষ্টদের বিবাদী করা হয়েছে। আজ বুধবার বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি কাজী মো. ইজারুল হক আকন্দের দ্বৈত হাইকোর্ট বেঞ্চে এ রিটের ওপর শুনানি হতে পারে।

  • দায় নিতে নারাজ বিআরটি এমডি 

প্রাণঘাতী এই দুর্ঘটনার পর বিআরটির প্রকল্প পরিচালক থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সবাইকে তদন্তের আওতায় আনার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সরকার প্রধান যাদের তদন্তের আওতায় আনার কথা বলেছেন, তাদের মধ্যে বিআরটির প্রকল্প পরিচালক সফিকুল ইসলামও রয়েছেন। তবে এই দায় নিতে নারাজ বিআরটি এমডি। গতকাল গণমাধ্যমকে তিনি জানান, তদন্ত কমিটিই ঠিক করবে দায় কার। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে এই প্রকল্পের কাজ আপাতত বন্ধ থাকবে। জনসাধারণের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করার পর আবার কাজ শুরু হবে।

ইত্তেফাক/ইআ