‘ঐ দ্যাখ জোড়া শালিক। আইজগো মোগো বাড়ি অতিত আইবে।’ তিন বছর বয়সি খোকন অদূরেই এক গাছের ডালে বসে থাকা একজোড়া শালিকের দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে।
‘এহ, মুই তো পরশুও জোড়া শালিক দেখলাম, কই মোগো বাড়ি তো এহনো অতিত আয় নাই!’
তার পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা প্রায় সমবয়সি সোহেল খানিকটা ব্যঙ্গ করে বলে। খোকনের খানিকটা মন খারাপ হয়। তার দাদি বলেছে, জোড়া শালিক দেখলে নাকি বাড়িতে অতিথি আসে। কিন্তু সোহেলের সঙ্গে এ মুহূর্তে সে তর্ক করতে পারে না, কারণ প্রতিবার সোহেলের সঙ্গে তর্ক হলে সেটা শেষমেশ মারামারিতে গিয়ে ঠেকে। আর প্রতিবারই তাকে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরে যেতে হয়।
সে সোহেলের কথার উত্তর না দিয়ে বিষণ্ন মনে বাড়ি ফেরে। যাওয়ার আগে আরো একবার গাছের ডালে বসে থাকা শালিক জোড়ার দিকে তাকায়। তার দৃঢ় বিশ্বাস তাদের বাড়িতে আজ নিশ্চয়ই কোনো অতিথি আসবে।
‘কী গো দাদু, মুখটা ব্যাজার ক্যা?’ বাড়ি ফিরতেই খোকনের দাদি জিজ্ঞেস করেন।
‘দাদি, গাছের ডালে জোড়া শালিক দেখছি। তুমি তো কইছো জোড়া শালিক দেখলে বোলে বাড়ি অতিত আয়, আইজগো মোগো বাড়ি কোনো অতিত আইবে?’
দাদি পানের ডালাটা হাতে নিয়ে মুচকি হাসি দেন। একটা পান বানিয়ে মুখে পুরতে পুরতে বলেন, ‘আইজগো না আউক, কাইলগো আইলে আইতেও পারে!’
খোকন তার দাদির হেঁয়ালিপূর্ণ কথার কিছুই বুঝতে পারে না। সে ফ্যালফ্যাল করে দাদির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। খোকনের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে তার দাদিই রহস্যের খোলাসা করেন, ‘তোর আব্বায় আর বড় কাক্কু আইতেয়াছে। আইজগো লঞ্চে ওডবে। কাইলগো বেইন্নাহালে বাড়ি আইয়া পরবে।’
হঠাত্ যেন জগতের সব আনন্দ এসে খোকনের ছোট্ট মনের দরজায় ভিড় করে। তার বাবা আর বড় চাচা দুজনেই ঢাকায় থাকেন। বছরে তিন-চারবার তাঁরা বাড়ি আসেন। সেই সময়টা যেন তার জন্য ঈদের মতো। দাদির কথা শুনে সে কোলাব্যাঙের মতো তিড়িংবিড়িং করে শূন্যে হাত-পা ছুড়ে লাফ দেয়। এরপর দাদিকে একবার জড়িয়ে ধরে তার বুড়ো হয়ে যাওয়া চামড়ায় একটা চুমু দেয়। দাদি মৃদু হাসেন, নাতির আনন্দ তাকেও ছুঁয়ে যায়।
বিকালে বাবাকে ফোন করে খোকন, ‘আব্বা আওয়ার কালে মোর লইজ্ঞা একটা লাল শাট আনবা। নাইলে কিন্তু ঘরে ঢুকতেই দিমু না।’
ছেলেমানুষি আবদার শুনে ফোনের অপর প্রান্ত থেকে খোকনের বাবা হাসেন, ‘আনমু বাবা, তোমার লইজ্ঞা আনমু না তো কার লইজ্ঞা আনমু। এহন রাখি বাবা, লঞ্চে উডমু।’
খোকনের ছোট্ট মনে খুশি রাখার যেন জায়গা নেই। বাবা আর বড় চাচা আসছে সেই খুশি তো আছেই, কাল যখন সোহেলের কথার পালটা জবাবটা দিতে পারবে তখনকার কথা ভেবেও তার আরো খুশি লাগছে।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়, সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। শীতের দিনগুলো ছোট হলেও, রাতটা যেন ফুরোতে চায় না। বিছানায় শুয়েও তাই নানা চিন্তায় খোকন এপাশ-ওপাশ করতে থাকে। এভাবে কখন যে বুকভরতি আনন্দ নিয়ে সে গভীর ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যায় তা টের পায় না।
সকালে খোকনের ঘুম ভাঙে বাড়ির উঠোনে চিত্কার-চেঁচামেচি শুনে। তবে কি তার বাবা চলে এসেছে? সে বিছানা ছেড়ে এক দৌড়ে উঠোনে চলে যায়। উঠোনে আশেপাশের বাড়ির কয়েকজন মানুষ। সবার মুখ থমথমে। তার মা আর দাদি ঘরের এক কোণে বসে কাঁদছেন। পাশের বাড়ির মহিলাদের কেউ কেউ তাদের সান্ত¾না দিচ্ছে।
খোকন বেশ বিরক্ত হয়। আজ তার বাবা আসবে, অথচ সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই কি না তার এসব কান্নাকাটি দেখতে হচ্ছে। সে কাউকে কিছু না বলেই বাড়ির সামনের দিকে রাস্তার দিকে চলে যায়। এসব কান্নাকাটি দেখার সময় তার নেই। তার চেয়ে রাস্তায় বসে বাবার জন্য অপেক্ষা করাই তার কাছে ঢের ভালো মনে হয়।
আলস্যে-ঢাকা শীতের সকাল ধীরে ধীরে দুপুরে পরিণত হয়। কিন্তু খোকনের কাঙ্ক্ষিত অতিথি আর আসে না! মধ্যে দুয়েকবার সে বাড়িতে গিয়েছিল। প্রতিবারই তার মা আর দাদি তাকে জড়িয়ে ধরা মরাকান্না কেঁদেছে। সে বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করেও তাদের কান্নার কারণ জানতে পারেনি। শেষমেশ তাই বিরক্ত হয়ে রাস্তায় চলে এসেছে। সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যতক্ষণ না বাবা আসছে সে বাড়ি ফিরে যাবে না।
দুপুর গড়িয়ে বিকেলও চলে আসে। কিন্তু খোকনের বাবা আর আসে না। এবার তার বাবার ওপরেও রাগ হয়। ঢাকা থেকে বরগুনা আসতে কি এত দেরি হয় নাকি?
পেটের ক্ষুধায় টিকতে না পেরে আবার বাড়ি ফিরে যায় সে। বাড়িতে এখন আর তেমন কোনো লোকজন নেই। তার দাদি এখনো বিলাপ করে কাঁদছেন, ‘ওরে আমার আল্লাহরে, এইডা তুমি কী করলা রে...আমার পোলাগো ফিরাইয়া দেও রে...’
এবার সে বুঝতে পারে। বাবা আর চাচার আসার দেরি দেখেই দাদি কান্নাকাটি করছে। কী বোকা তারা! আসতে দেরি হতেই পারে, তাই বলে কি এত কাঁদতে হয় নাকি! দাদি না-হয় বুড়ো মানুষ তাই বোকার মতো কাঁদছে, মা কেন কাঁদছে? তারও কি আজ বুদ্ধিসুদ্ধি সব চলে গেল নাকি!
খোকন বাড়ি ফিরতেই তার মা তাকে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কেঁদে ওঠেন। কেন যেন খোকনের বুকটাও বেশ ভারী হয়ে যায়। তার ফোলা গাল বেয়ে ঝরে পড়ে দু’ফোটা নির্মল অশ্রু।
দুইদিন পার হয়ে গেছে।
সোহেলের কথাই তবে ঠিক! জোড়া শালিক দেখলেই অতিথি আসে না। খোকনের মন খুব খারাপ। সোহেলের কথা সত্যি হয়েছে সেজন্য নয়, বরং বাবা তাকে মিথ্যে কথা বলেছে এজন্য। বাড়ি আসার কথা বলেও আসেনি। অদূরেই এক মেহগনি গাছের ডালে দুটো শালিক পাখি বসা। খোকনের আজ আর কাউকে সেগুলো দেখাতে ইচ্ছে করছে না। সে জানে আজ আর কোনো অতিথি আসবে না।
ঠিক তখনই দূরের রাস্তায় ধুলো উড়িয়ে ‘পুউউউউ’ শব্দ করে একটা গাড়ি এগিয়ে আসতে থাকে। এই গাড়িগুলো খোকন আগেও দেখেছে, এগুলোকে বলে অ্যাম্বুলেন্স। খোকন অবাক চোখে তাকিয়ে দেখে গাড়িটা ধীরে ধীরে তাদের বাড়ির সামনে এসেই থামে। তবে কি তাদের বাড়িতে আজ সত্যিই কোনো অতিথি এসেছে?
জীবন-মৃতু্যর কঠিন সমীকরণ সম্পর্কে অজ্ঞ খোকন জানে না, রাতের অন্ধকারে আগুন-পানির সংমিশ্রণ কেড়ে নিয়েছে তার কাঙ্ক্ষিত অতিথিদের। আজ যে অতিথি তাদের দরজায় এসেছে এমন অতিথি কেউ কখনো চায় না!