শনিবার, ০১ এপ্রিল ২০২৩, ১৮ চৈত্র ১৪২৯
দৈনিক ইত্তেফাক

বন্যার কারণে বাংলাদেশে বাড়ছে জলবায়ু শরণার্থী

আপডেট : ২১ আগস্ট ২০২২, ১৬:৪৩

বন্যা ও নদী ভাঙনের কারণে বাংলাদেশে বাড়ছে জলবায়ু শরণার্থীর সংখ্যা। পরিসংখ্যান বলছে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রতিদিন রাজধানী ঢাকায় আসছে দুই হাজারেরও বেশি মানুষ। এদের বেশিরভাগই উপকূলের বাসিন্দা।

এক বছর আগের ঘটনা। ভোলা জেলার রামদাসপুর গ্রাম। মেঘনা নদী যখন প্রমত্তা হয়ে উঠেছিল তখন মোহাম্মদ জুয়েল এবং আরজু বেগম টিনের ঘরের চালে বসে রাত কাটিয়েছেন। তখনই সিদ্ধান্ত নেন আর এখানে নয়। পরদিন চার সন্তানকে নিয়ে পূর্বপুরুষের ভিটে-মাটি ছেড়ে তারা চলে আসেন রাজধানী ঢাকায়।

কেবল রামদাসপুর গ্রাম নয়, ভোলার বেশিরভাগ গ্রামের মানুষের অবস্থাই জুয়েলদের মত। জুয়েল সংবাদ সংস্থা এপিকে জানান, আমরা এই নদীতীরেই বড় হয়েছি। মাছ ধরেছি এই নদীতে। অথচ এই নদী আমাদের সব কেড়ে নিয়েছে। এই গ্রামে আমার জন্ম। গ্রামের জন্য মন কাঁদে। কিন্তু আমার কিছু করার ছিল না।

বাংলাদেশজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে ১৩০টি নদী। এদের মধ্যে বেশ কয়েকটি বন্যাপ্রবণ।বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশের আবহাওয়া অপ্রত্যাশিত আচরণ করছে। এর ফলে প্রায়ই নদী ভাঙনে গ্রামের পর গ্রাম বিলীন হয়ে যাচ্ছে। জুন থেকে অক্টোবর বাংলাদেশে বর্ষাকাল। এ সময়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা দেয় বন্যা। এর ফলে নদী তীরে থাকা বাজার, স্কুল, মসজিদ, ঘর-বাড়ি পানিতে ভেসে যায়। ফলে লাখো মানুষের গৃহহীন হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। অনেকেই পরিণত হন ‘জলবায়ু শরণার্থীতে'। 

বিজ্ঞানীরা বলছেন, কেবল বন্যা নয়, সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড়, নদী ভাঙন এবং অতিরিক্ত লবণাক্ত পানি মাটিতে প্রবেশ করার কারণেও বাড়ছে জলবায়ু শরণার্থীর সংখ্যা।

বিশ্ব ব্যাংকের গত বছরের রিপোর্ট বলছে, বাংলাদেশে যে হারে জলবায়ু শরণার্থীর সংখ্যা বাড়ছে তাতে ২০৫০ সালের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় তৃতীয় অবস্থানে চলে আসবে দেশটি। অর্থাৎ অভ্যন্তরীণ অভিবাসীর সংখ্যার দিক দিয়ে এটি দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে তৃতীয় অবস্থানে চলে যাবে।

ঠিক একবছর পর ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িতে ফিরেছিলেন জুয়েল। তখন দেখলেন কেবল তাদের বাড়ি নয়, আরও অনেক বাড়ি মেঘনাগর্ভে বিলীন হয়েছে। এই গ্রামে একসময় অনেক ছোট মুদি দোকান, চায়ের দোকান, বাজার বসতো। চারপাশটা সবুজে ঘেরা ছিল। এখানকার মাটি ছিল বেশ উর্বর। কিন্তু বছরের পর বছর বন্যা আর নদী ভাঙনের কারণে এখানকার জনবসতি হ্রাস পেয়েছে। আগে যেখানে দুই হাজার মানুষের বাস ছিলো, এখন মাত্র ৫০০ মানুষ এখানে থাকে।

আরজু বেগম বলেন, আমি যখন ঘরের কাজ করতাম, আমার বাচ্চাকে ঘরের খুঁটির সাথে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখতাম, যাতে পানিতে পড়ে না যায়। আমাদের বাড়ি আশপাশে যারা ছিলো তারা এখন রাস্তায় বা ভাড়া বাড়িতে থাকে। কেউবা বাঁধের পাশে তাবু বানিয়ে অস্থায়ীভাবে থাকছে। আমরা ঢাকায় থাকি এখন। নিজেদের বাড়ি বলতে আর কিছুই নেই। আমরা এখন উদ্বাস্তু।     

ঢাকার উত্তরেজলবায়ু শরণার্থীদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র বানিয়েছে সরকার। চেষ্টা করছে সেখানে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের। কিন্তু জুয়েলের ভাগ্যে সেই সুবিধা জোটেনি। মিরপুরের একটি বস্তিতে ছোট একটি ঘরে জুয়েল তার পরিবার নিয়ে থাকেন। এই শহরে মানিয়ে নিতে তাদের খুব কষ্ট হচ্ছে বলে জানান তিনি। বলেন, আমাদের নিজের বাড়ি ছিলো, ভাড়া গুণতে হয়নি কখনো। মাসে যা আয় হয় তা খুব সীমিত, যা দিয়ে সংসার চালানো কঠিন।

জুয়েল এখন মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বর্জ্য সংগ্রহের কাজ করেন, মাসে ১২ হাজার টাকা পান। আর তার স্ত্রী দুই বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করে চার হাজার টাকা পান। চার হাজার টাকা বাসা ভাড়া দিয়ে বাকিটা অন্যান্য খরচে ব্যয় হয়।

জুয়েল চান তার সন্তানরা ভালোভাবে মানুষ হোক। ভালো স্কুলে পড়ালেখা করুক। কিন্তু সবকিছু তার কাছে অসম্ভব মনে হয়, তার কাছে এখন টিকে থাকাটাই সবচেয়ে বড় কথা।

ইত্তেফাক/জেডএইচডি